বুধবার, মার্চ ০৬, ২০১৯

প্রণয়িনী, কিছু অনুভূতি তোমার জন্য...



কিছু রাত বিভীষিকার ভয়ে জোৎস্নায় নিজেকে ভাসিয়ে দেয় না,
কিছু মেঘ উন্মাদনার ভয়ে অঝোরে বর্ষণ ঝড়িয়ে যায় না।
কিছু বাতাস লাগাম হারাবার ভয়ে ঝড়ো বেগে বয়ে যায় না,
কিছু তারা অনিষ্টের ভয়ে আপন আলোয় দিশা দেখায় না।

কিছু উত্তাপ পুড়ে যাবার তিব্রতায় আপন গণ্ডি অতিক্রম করে না,
কিছু ধোঁয়া অহেতুক অন্ধকারে তোমার দুনিয়া ভাসিয়ে দেয় না।
কিছু জলোচ্ছাস আঙ্গীনা ভাসিয়ে দেবার ভয়ে সমুদ্র ছেড়ে ডাঙ্গায় চড়ে না,
কিছু বর্জপাত আতঙ্ক ছড়াবার ভয়ে মেঘের আড়াল ছেড়ে দৃশ্যমান হয় না।

কিছু ফুল হিংস্রতার ভয়ে কলি ছাড়িয়ে ফুটে উঠে না,
কিছু সুবাস তীব্রতার ভয়ে নিজেকে ছড়িয়ে বিলীন হয় না।
কিছু মায়া কাঁদাবে বলে কখনো নিজেকে প্রকাশ করে না,
কিছু মমতা আকড়ে ধরার ভয়ে আপন শাখা মেলে ধরে না।

কিছু শব্দ কলঙ্কতার ভয়ে জনসম্মুখে উচ্চারিত হয় না,
কিছু ছন্দ সময়ের উন্মত্ততার ভয়ে শব্দরূপে সামনে আসে না।
কিছু সুর কাতরতার মাত্রা ছাড়াবে বলে বাদ্য রূপে বেজে উঠে না,
কিছু গান অশ্রুশিক্ত করার ভয়ে কারো গলায় ধরা দেয় না।


প্রণয়িনী,
তেমনি করে তোমার অনুযোগের ভয়ে আপন অনুভূতির প্রকাশ করি না...



ছবিঃ অরুন শিবপ্রসাদ (মূল), ঘষামাজায় অধম

রবিবার, মার্চ ০৩, ২০১৯

সুরের যাদু


সুরের মাঝে কি জাদু আছে কে জানে? কেউ সুরের এই যাদুর মোহে পড়ে হারিয়ে যায় আজানায়। আবার কেউ কেউ কেউ নিজেকে খুঁজে পায় এই সুরের মাঝেই। সেই অনাদিকালের শুরু থেকে মানুষ সুরের মুর্ছনায় হারাতে শিখেছিল। লক্ষ কোটি বছর পরেও সেই হারিয়ে যাবার আগ্রহে মানুষ সুরের পেছনে অন্ধের মত ছুটে বেড়ায়।

কি অসম্ভব ক্ষমতা এই সুরের! হ্যামিলনের ইঁদুর থেকে শুরু করে বাচ্চারাও দল বেঁধে হারিয়ে গেছে এই সুরের মোহনীয় লাইন ধরে। আজ অব্দি কেউ আর তাদের খুঁজে পায়নি। না কোন নগরে, না কোন বন্দরে। তারা যেন সুরের মতই সুরের মাঝে হারিয়ে গেছে, মিশে গেছে বাতাসে।

ক্ষমতা, লোভ, লালসা -এই সবই হার মেনেছে এই সুরের সামনে। আহংকার, আত্মগরিমা, দাম্ভিকতা - সবই ধুলিসাৎ হয়েছে এই সুরের কারণে। যে মন কোন বাঁধনে জড়ায় না, সেই মনও কোন না কোন এক গলিতে অখ্যাত কোন রেস্তোরায় বেঁজে যাওয়া কোন এক নাম না জানা বাদ্যযন্ত্রের টুং টাং শব্দতে নিজের পাথরসম হৃদয়টাকে বেঁধেছে। হয়তো স্বীকার করেনি কোন কালে, তবুও সেই সুর কখনো কানে ভেসে আসলে তাতে নিজের তৃষ্ণা মিটিয়েছে খুব সর্ন্তপণে।

উল্লাস, আনন্দ, বিজয় - এই সবই প্রকাশ পেয়েছে সুরে। কৃতজ্ঞতা, মহানুভবতা, দয়া - এরাও নিজেদের প্রকাশ আর প্রচার ঘটিয়েছে এই সুরের পথে হেটে। প্রতিটা শোক কিংবা প্রতিটা আনন্দের উল্লাস সুরের এই অলিগলির পথ ধরে অন্ধকার পথের কোণ থেকে উঠে গেছে রাজপ্রাসাদে। কখনো শোকের অশ্রু ঝড়িয়ে আবার কখনো আনন্দ অশ্রু বিসর্জনের মাধ্যমে মনের গহীন থেকে ভাব গুলিকে প্রকাশ করিয়েছে জনসমুদ্রে।

সুরের এই মাদকতা কাউকেই ছেড়ে কথা বলেনি। মোয়াজ্জিনের আজান থেকে শুরু করে কোরআনের তেলাওয়ালে রয়েছে তার উপস্থিতি। মন্দিরের ঘন্টা থেকে পুজার মন্ত্র পাঠের পড়তে পড়তে রয়েছে তার অবস্থান। গির্জার ঘন্টা থেকে শুরু করে সান্তাক্লোজের স্লেজ গাড়িতে রয়েছে তার বিস্তৃতি।

কেউ তার কন্ঠে ধারণ করেছে সুর আর কেউ তা নিয়ে এসেছে তাদের হাতের আঙ্গুলে। কেউ কথার পর কথাকে সাজিয়ে গেছে সুরে, আর কেউ কেউ সেতারার তার ধরে গুঞ্জন তুলতে তুলতে সৃষ্টি করেছে ঝড়। আর তাদের সেই ঝড়ে, সৃষ্টির গহীন তলে মানুষ বিভোর হয়ে হারিয়েছিল, হারাচ্ছে আর হারাতেই থাকবে নিজেকে।

এই সুরের ভেলায় চড়ে কত ভালোবাসার গল্প পার করেছে কত শত নীল নদ। শত শত বেহালার তারে প্রকাশ ঘটেছে ছড়িয়েছে বেদনার গল্প। একতারার কম্পনে সৃষ্ট সুরে প্রকাশ পেয়েছে হাজারো মূল্যবোধ। দোতারার সুর ছড়িয়েছে কত কাব্যকথা। পিয়ানো গুলো শব্দের কম্পনে শত শত মানুষের অস্তিত্বকে নাড়িয়ে গেছে। আর গিটারের তার গুলো আপন উন্মাদনার সুর ছড়িয়ে ছিটিয়ে উন্মত্ততায় আগুন জ্বালিয়েছে যুব হৃদয় গুলিতে। শত অবজ্ঞাতেও কেউ মুক্তি পায়নি এই সুরের কবল থেকে।

কত হঠকারী সুরের এই চিৎকারে নিজের কুৎসিত কর্মমকে সংবরণ করেছে। কত যালিমের মনে এই সুর সৃষ্টি করেছে ভয়। কত মুক্তিকামী মানুষের মনে সাহস যুগিয়েছে এই সুর। কত ভীত সম্প্রদায়কে আগ্রগামী করে দিয়েছে সে সময়-অসময়ে। কত রাজত্বের সৃষ্টি হয়েছে এই সুরের সিড়ি বেঁয়ে, আবার কত রাজত্ব ধ্বংস হয়ে বালিতে মিশে গেছে এই সুরের তেজস্বীয়তার সামনে। কত পরিচয় লুটেছে এই সুরে আর কত পরিচয় গড়েছে এই সুরের শেষে। সুরের এই অবদানের হিসেব কখনো বলে কয়ে শেষ করার নয়।

এইসব সুর ভেসে চলুক মানুষের মনে, ভাসিয়ে নিয়ে যাক মানুষকে তেপান্তরে। যুগ যুগান্তরের সুর এগিয়ে চলুক তার আপন গতিতে। ধ্বংসে, সৃষ্টে আর ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখুক সবাইকে....


পরিশেষে সুরের যাদুতে ঘেরা একটি পরিবেশনা..







শনিবার, আগস্ট ২৫, ২০১৮

২৭ বছরে লিনাক্স!


একটি কম্পিউটারকে চালাতে গেলে একটি চালক বা অপারেটিং সিস্টেমের প্রয়োজন পড়ে। শুরুতে কম্পিউটার বলতে মানুষ বুঝতো বিশাল বিশাল মেশিন। আর সেই মেশিন দিয়ে করা হতো খুব গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু কাজকর্ম। কিন্তু তার সবই আটকে থাকতো মেশিনকে কাজ করানোর জন্যে অপারেটিং সিস্টেমের দূর্বলতার সামনে। 

অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে অনেকেই কাজ করছিল তখন। প্রতিটা মেশিনের জন্যে আলাদা আলাদা করে অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করা হতে লাগলো। পোর্ট করে একটা একটা ফিচার একটা একটা মাইক্রোপ্রসেসরে যুক্ত করা শুরু হলো। কিন্তু এইসবই আটকে থাকলো ব্যবসায়িক ধ্যাণ ধারণাকে সামনে রেখে। 

ধরুন আপনি একটি মেশিনের মালিক, এবং আপনার টাকা দিয়ে কেনা একটি অপারেটিং সিস্টেমও রয়েছে তাকে চালাবার জন্যে। কিন্তু সেই অপারেটিং সিস্টেমটি আপনার মেশিনকে দিয়ে আপনি যা করতে চাচ্ছেন তা করতে পারছে না। এমন অব্স্থায় যদি আপনি আপনার অপারেটিং সিস্টেমটার দুটো ফিচার পরিবর্তন করে নিতে পারেন, তাহলেই আপনার কাজ ঠিক মত হবে। কিন্তু চাইলেই আপনি এই কাজটা করতে পারবেন না। কারণ এটি করার অনুমতি আপনার নেই!



তখনকার প্রায় সকল অপারেটিং সিস্টেমের মত এমনই প্রতিবন্ধকতা ছিল মিনিক্স (Minix) অপারেটিং সিস্টেমেও। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এক সুইডিস যুবক নিজের 386 পিনের মাইক্রোপ্রসেসরের জন্যে মিনিক্সের আদতে একটি অপারেটিং সিস্টেম তৈরির কাজ শুরু করল। সেই যুবকটির নাম লিনুস বেনেদিক্‌ত তোরভাল্দ্‌স। লিনুস কাজ শুরুর প্রায় ৪ মাস পর তার কাজের একটি ছোট সংস্করণ সকলের জন্যে উন্মুক্ত করে দিল। আর তার সাথে চাইলো মানুষের মতামত।

লিনাক্স সম্পর্কে তার প্রথম বার্তাটির অনুবাদ নিচে তুলে দিলাম- 

হইতে: torvalds@klaava.Helsinki.FI (লিনুস বেনেডিক্ট টোভাল্ডস)
নিউজগ্রুপ: comp.os.minix
বিষয়: আপনি মিনিক্সে সর্বাধিক কি দেখতে চান?
সারাংশ: আমার নতুন অপারেটিং সিস্টেমের জন্য ছোট জরিপ
বার্তা-ক্রম: <1991Aug25.205708.9541@klaava.Helsinki.FI>
তারিখ: ২৫ আগস্ট ৯১ ২০:৫৭:০৮ GMT
সংগঠন: University of Helsinki
হ্যালো মিনিক্স ব্যবহারকারীগন–
আমি ৩৮৬ এটি ক্লোন  একটি প্রসেসরের জন্যে একটি অপারেটিং (এটি নেহায়েতই সখের বসে, খুব বড় কিছু নয় এবং এটি জিএনইউ এর মত পেশাদারীও নয়) সিস্টেম নিয়ে কাজ (বিনামূল্যের) করছি। এটির পেছনে আমি গত এপ্রিল থেকে কাজ করে যাচ্ছি, এবং শুরু করার জন্যে এটি প্রায় প্রস্তুত। যেহেতু এটি প্রায় (ফাইল-সিস্টেম এবং কাঠামোগত দিক দিয়ে) মিনিক্স অপারেটিং সিস্টেমের অনুরূপ তাই যারা মিনিক্স পছন্দ/অপছন্দ করেন তাদের সকলের মতামত আশা করছি।
আমি এটিতে bash(1.08) এবং gcc(1.40) এর বৈশিষ্ট সমূহ নিয়ে এসেছি, এবং প্রায় সবকিছুই কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে মাসখানিকের মধ্যে এর থেকে বাস্তবিক কিছু একটি পেতে যাচ্ছি, এবং এর মধ্যে মানুষ কি কি সুবিধাদি চায় তা আমি জানতে ইচ্ছুক। যে কোন ধরণের পরামর্শ গ্রহণযোগ্য, কিন্তু তাদের বাস্তবায়ণের প্রতিশ্রুতি আমি দিতে পারছি না :-)
লিনুস (torvalds@kruuna.helsinki.fi)
বি.দ্রঃ এটি মিনিক্স কোড থেকে মুক্ত, এবং এতে মাল্টি-থ্রেড ফাংশন রয়েছে। এটি বহনযোগ্য নয় (৩৮৬ টাস্ক সুইচের ব্যবহার সমূহ) এবং সম্ভবত AT-Harddisk ছাড়া সম্ভবত এটি অন্যকিছু সমর্থন করবেও না, কারণ আমার তাই আছে :-( 

লিনুসের সেই ছোট্ট সখের কাজটি ধীরে ধীরে ডালপালা গজিয়ে উঠতে লাগলো। তার সেই সখের প্রজেক্টের নাম হলো 'লিনাক্স'। নানা প্রতিকূলতা পার করে তার তৈরি সেই লিনাক্স আজকে শতকরা ৯৬ শতাংশ সুপার কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম। বিশ্বের যত ক্লাউড কম্পিউটার রয়েছে তার বড় একটা অংশ পরিচালনায় ব্যবহার করা হয় এই লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম! এন্টারপ্রাইজ সল্যুশন হিসেবে লিনাক্সের গ্রহণযোগ্যতা এখন বিশ্বজোড়া। 

আর এই লিনাক্সকে ব্যবহার করা যায় একদম বিনামূল্যে। চাইলে পরিবর্তন করে নেয়া যায় নিজের ইচ্ছে মত। নেই কোন বাধা, নেই কোন নিষেধ। এন্টারপ্রাইজ লিনাক্স সাপোর্টের পাশাপাশি লিনাক্সকে নিয়ে গড়ে উঠেছে অনেক অনেক কম্যুনিটি। যারা নিরন্তর ভাবে একে উন্নত থেকে আরও উন্নত অবস্থানে পৌছে নিচ্ছে প্রতিটা মুহুর্তে। 


হাটি হাটি পা পা করে লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম আজ ২৬ বছর পার করে ২৭ বছরে উর্ন্নীত হলো। পার্সোনাল কম্পিউটার, স্মার্টফোন থেকে শুরু করে সুপার কম্পিউটার, সবস্থানেই লিনাক্সের জয়জয়কার। 


শুভ জন্মদিন লিনাক্স, ধন্যবাদ লিনুস তোরভাল্দ্‌স 💗








রবিবার, জুলাই ২৯, ২০১৮

অস্তিত্বের অনুধাবন



একটি কলম আর আপনার মাঝে পার্থক্য কি? আরও ভালো করে বললে- আপনার মাঝে আর আপনাকে ঘিরে রাখা পরিবেশের যে কোন বস্তুর সাথে আপনার মৌলিক পার্থক্যটা কোথায়? 

প্রশ্নটার উত্তর আপনি অনেক উপায়ে কিংবা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দিতে পারবেন। আর দশ জনকে প্রশ্ন করা হলে সম্ভাবনা রয়েছে যে উত্তরটারও দশ রকমেরই হবে। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তরের যতই রকমফের হোক না কেন, উত্তরের মূলকথা সমসময় একটা বিষয়কে কেন্দ্র করেই হবে। আর সেটি হলো আপনার অস্তিত্ব।

হ্যাঁ, আপনার অস্তিত্ব। যেটা একদম খুব ভেতর থেকে আপনি অনুভব করতে পারেন। আর যার উপর ভিত্তি করেই আপনার ব্যক্তিত্ব, চিন্তাভাবনা, চলাফেরা, আচার-আচরণ তথা আপনার বাহ্যিক প্রকাশ ঘটে সেটি হলো আপনার অস্তিত্ব। আপনি আপনার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন বলেই দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজ গুলো র্নিদ্বিধায় করে যেতে পারছেন। 

কিন্তু কেউ যদি আপনার ভেতর থেকে আপনার অস্তিত্বটাকে আলাদা ফেলে, তখন?
তখন আপনি যে আপনাকে নিয়ে এত গর্ব আর দম্ভ করে চলাফেরা করেন তার অবস্থান আর একটি কলমের অবস্থান ঠিক একই স্থানে এসে পৌঁছবে। মূলত ঐ সময়টাতে আপনার দেহ কিংবা বলা চলে একটা 'মৃতদেহ' আর একটা জড় বস্তুর মাঝে বিশেষ কোন পার্থক্য থাকে না। দুটো বস্তুই অসাড়,  ব্যবহার ছাড়া দুটো বস্তুই মূল্যহীন।

মানুষের সবচেয়ে বড় ভয় যদি চিন্তা করা হয় তাহলে তাতে নানা ধরণের বিষয় উঠে আসবে। আর এইসব বিষয় গুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত আর বড় কারণটাই হবে 'মৃত্যু' বা মরণ। আর মানুষের এই মৃত্যু ভীতিকে আরও একটু বিশ্লেষণ করলেই বের হয়ে আসবে যে বিষয় সেটি হলো আমাদের মহামূল্যবান ঐ অস্তিত্ব।

তবে এতকিছুর পরেও মানুষ তার অস্তিত্বকে নিয়ে নানা ধরণের কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। কেউ কেউ নিজের অস্তিত্বকে দূরে ঠেলে ফেলার জন্যে নেশায় ডুবে গেছে আবার কেউ তার অস্তিত্বের তীক্ষ্ণতা বোঝার জন্যে নিজেকে মৃত্যুর কোলে সপে দিয়েছে। এ তো গেলো ব্যক্তি বিশেষের কথা, কিন্তু এর বাইরেও অস্তিত্বকে নিয়ে এক বিশাল জনগোষ্ঠি কাজ করেছে। তারা তাদের ধর্ম আর রীতিনীতিকে নিজ নিজ বিশ্বাসের সাথে জুড়ে দিয়ে নানা উপায়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। আর সে কারণেই কেউ কেউ নেশাকে ধরে নিয়েছে আত্মার দুষণ রূপে, আর কেউ নেশায় বুদ হয়েই আত্মার পরিশুদ্ধতা করার চেষ্টা করছে।

প্রতিটা নেশাজাত দ্রব্যই মানুষের অস্তিত্বটাকে নাড়া দেয় কিংবা কিছু সময়ের জন্যে তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আর এতে করে নিজের বিশ্বাসটা লোপ পেয়ে যায়। আর ঐ সময়টাতে জাগতিক নিয়ম-কানুন আর তার কাছে কোন মূল্যবহন করে না। এ কারণেই অনেক বিপথগামী নেশায় বুদ হয়ে থাকে, কারণ সে যে অস্তিত্বের উপর নিজেগে গড়েছে তুলেছে তা নিজে মেনে নিতে পারে না, আর তা পারে না বলেই সেই অস্তিত্বকে সে নেশার মাধ্যমে ভুলে থাকবার চেষ্টা করে। 

নিজের অস্তিত্বকে ক্ষণিক সময়ের জন্যে হারিয়ে ফেলবার তেমনই একটি দ্রব্য হলো 'আইওয়াসকা' (Ayahuasca)। সঙ্গত কারণেই এই দ্রব্যটি নিষিদ্ধ। এটি তৈরি হয় স্থানীয়ভাবে, কিন্তু সকল স্থানে এটি সহজপ্রাপ্য নয়।

এই দ্রব্যটি একজন মানুষের ভেতর তার যে অস্তিত্ব রয়েছে তাকে এমন ভাবে নাড়িয়ে দেয় যে সে নিজেকে একদম পারিপার্শিক সকল বিষয় থেকে আলাদা মনে করতে শুরু করে। নির্দিষ্ট পরিমানে এই দ্রব্য গ্রহণ করলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এর কার্যকারিতা বহাল থাকে। এই সময়টাতে তার স্মৃতি দারুণ ত্বীক্ষ্ণ অবস্থায় থাকে। কিন্তু প্রতিটা বিষয় এতটাই এলোমেলো আর গতিসম্পন্ন থাকে যে তখন তাল মিলিয়ে চলাটা এক অসম্ভব কাজ বলেই মনে হয়। আর ঐ সময়টাতে নিজের বিশ্বাসের উপর অটল না থাকতে পারলে ভয়াবহ রকমের বিপত্তিও ঘটে যেতে পারে। 

তবে মজার  ব্যাপার হলো, যতক্ষণ দ্রব্যটি মানুষের শরীরে কিংবা তার রক্তে সচল থাকে, ততক্ষণ তার মস্তিস্কে তাকে চালিয়ে নেয়া অস্তিত্ব অনুধাবণের অংশটি বিকল হয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু যখন দ্রব্যটির কার্যক্রম হ্রাস পেতে পেতে একদম বিলিন হয়ে যায় তখন মস্তিস্কের ঐ অংশটি নব-উদ্দ্যোমে একদম নতুনের মত করে নিজের অস্তিত্বকে অনুধাবন করতে পারে। দ্রব্যটি গ্রহণের পূর্বে তার এই অস্তিত্বের অবস্থানটি বিক্ষিপ্ত হলেও দ্রব্যটির আবেশ থেকে বের হয়ে আসলে অস্তিত্বের ঐ টুকরোগুলো কেন্দ্রীভুত অবস্থানে জমা পড়ে। ফলে নিজেকে এবং নিজের চিন্তাভাবনাকে আরও সুক্ষ্ণভাবে সে অনুভব করতে পারে। ব্যাপারটাকে লম্বা সময় ধরে চলতে থাকা একটি মোবাইল ফোনের সাথে তুলনা করা যায়, যেটি লম্বা সময় ধরে চলার কারণে কিছুটা ধীর গতি সম্পন্ন হয়ে আসে কিন্তু রিস্টার্ট করার পর পুনরায় একদম পুরোদমে নিজের কাজ শুরু করতে পারে। 

তো আপনি, নিজের অস্তিত্বটাকে কতটুকু অনুভব করতে পারেন? নিজের অস্তিত্ব আর সেই অস্তিত্বকে ভর করে গড়ে উঠা আপন বিশ্বাসকে কিভাবে মূল্যায়ণ করেন? অন্ধকরে তলিয়ে যাবার আগে কিংবা বিষন্নতায় ডুবতে বসলে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করে পুনরায় নিজের অস্তিত্বটাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেন? 

তার থেকেও বড় প্রশ্ন- 'আদৌ কি আপনি আপনার অস্তিত্বের এই কেন্দ্রীভূত শক্তি ব্যবহার করতে পারেন?'





বুধবার, জুলাই ১১, ২০১৮

কাগজ ও কালি



তুমি অভিন্ন চেনা জানা; আমি সময়, পরিস্থিতি, আর চেতনায় কিছুটা খাপছাড়া। তুমি তোমাকে মেলে ধর মানুষের ইচ্ছে মত ব্যবহারের তরে। আর আমি! আমি তাদের ইশারায়, ইচ্ছায় আর খেয়ালে ছুটে চলি দিক-বিদিকে। আমাকে এক একজন এক এক খেয়ালে ছোটায়, এক এক রূপে তাদের চিত্ত বর্ণনায় ঘুরিয়ে বেড়ায়। আর তুমি! তুমি সেই সব চিত্ত বর্ণনা আপন কায়ায় ধারণ করে নাও। প্রকাশ কর, পৌছে দাও এক জনা থেকে অন্য জনায়। যদিও এই চিত্তের প্রকাশে তোমার আমার অবদান একদমই অনস্বীকার্য। অথচ তারা প্রায়ই আমাদের এই অবদানকে মূল্যায়নের হিসেবে ধরতে চায় না। তারা কেবল চিত্তের প্রকাশটাকেই মূল্যায়নের ময়দানে তুলে নেয়। অতঃপর, তুমি আর আমি হারিয়ে যাই, আর তারাও ভুলে যায় আমাদের। 

আমরা কারও হৃদয় স্পর্শ করতে পারি না, তবুও তাদের হৃদয়ে লোহিত কনিকার যে উত্তাল প্রবাহের সৃষ্টি হয়, যে ঝড় বয়ে যায় আমাদের আমাদের গড়ে তোলা সম্মিলিত রূপে, যে আনন্দে উৎফুল্ল হয় তাদের অন্তর কিংবা যে হতাশায়, ক্লান্তি অথবা পরিতাপে তাদের ভীত নড়ে উঠে; তা কিন্তু মোটেই হেলায় ছুড়ে ফেলবার মত কোন ব্যাপার নয়। 

তবে তাদের মাঝেই কেউ কেউ মূল্যায়ন করতে জানে। হয়তো আমার চেয়েও অধিক তোমাকে, কিংবা তোমার আমার একাত্বতায় সৃষ্ট তাদের স্মৃতিকে। কেউ কেউ তোমার পৃষ্ঠে আমার লেপন ছুঁয়ে দেয়, কেউ আবেগের লোনা জল ফেলে আমাদের মাঝে হারাতে চায়। কেউ চায় তোমার মাঝে আমাকে দিয়ে প্রতিফলণ ঘটানো বিষয়টাকে তার আপন আত্মায় ধারণ করতে, আবার কেউ চায় তোমার আর আমার সৃষ্ট দুর্বোদ্ধতা ঘুঁচাতে।  আবার কেউ কেউ হাজার বছর ধরে লুকিয়ে রাখা গোপন কথাটিকে সবার থেকে অন্তরাল করে কেবল তোমাকে আর আমাকে দেয় সংরক্ষণ করতে। 

এই যে অবহেলা কিংবা পরম ভালোবাসা, তার কোনটিই উপেক্ষিত নয়। এই যে লাঞ্ছনা কিংবা সম্মান, কোনটিই ফেলে দেবার মত নয়। তুমি আর আমি, আমরা তাদের চিন্তার ধারক। আমরাই তাদের বয়ে নিয়ে যাই এক শতাব্দী থেকে অন্য আরেক শতাব্দীতে। আমরাই তাদের পরিচয় করিয়ে দেই এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে। আমাদের মাঝেই তারা হারায় আর আমরাই তাদের এই নশ্বর সময়ে বাঁচিয়ে রাখি অবিনশ্বর করে। 

প্রিয় 'কাগজ', তুমি জানো এই ব্যাপারগুলোই বাকি সব কিছু থেকে আমাদের আদালা এক অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। তোমার পৃষ্ঠে তাদের চিত্তের প্রবাহকে ধারণ করাই যেমন তোমার দায়িত্ব। তেমনি 'কালি' হয়ে তাদের চেতনা তোমার পৃষ্ঠে ফুটিয়ে তোলাই আমার নিয়তি। আর এটা এমন এক নিয়তি যাকে তারা চাইলেও অস্বীকার করা যাবে না, এটা এমন এক দায়িত্ব যা এড়িয়ে চলাও সম্ভব না।

তাই তোমার তরে আমার অনুরোধ, এদের হেলায় কষ্ট পেয়ে নিজের পৃষ্ঠ তেকে তাদের চেতনাকে বিলিন করে দিও না। এই চেতনার প্রকাশে যতটা অধিকার তাদের, ততটা আমাদেরও। তুমি বরং আমার আচড় গুলো তোমার পৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখ। নিদেনপক্ষে, তোমার কাছে আমার এইটুকুই প্রত্যাশা....

মঙ্গলবার, অক্টোবর ১০, ২০১৭

ড্রেইনিং কমাতে ক্যালিব্রেট করে নিন আপনার স্মার্টফোনটির ব্যাটারি!

প্রায়শই আমাদের মুঠোফোনের ব্যাটারি ব্যাকআপ অনেক কমে আসে, ব্যাটারি প্রচুর পরিমাণে ড্রেইন হতে থাকে। অবস্থা এমন হয়ে দাড়ায় সময় সময় যে ব্যবহারের আগেই ব্যাটারি শেষ হয়ে যায়। আর এমন বিরক্তিকর পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যে ব্যাটারি ক্যালিব্রেশন দারুণ এক সমাধান। এতে করে ব্যাটারির স্ট্যাবিলিটিরও উন্নতি ঘটে।


বেশ কয়েকটি পদ্ধতিকে ব্যাটারি ক্যালিব্রেশন করা যায়।। তবে ম্যানুয়ালপদ্ধতিতে ক্যালিব্রেট করলে ক্যালিব্রেশনের সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়।


ম্যানুয়াল ক্যালিব্রেশন পদ্ধতিঃ

  • আপনার ডিভাইসটি সম্পূর্ণ চার্জ শূন্য করুন। অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার ডিভাইসটি চলতে চলতে একদম বন্ধ না হয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ননস্টপ ব্যবহার করতে থাকুন। সাধারণত এভাবে ব্যাটারি ফুরনো দারুণ কষ্টসাধ্য এবং সময় সাপেক্ষ একটি কাজ। চাইলে স্বয়ংক্রিয় ভাবে এই কাজটি করার জন্যে এ্যাপের সহায়তা নেয়া যেতে পারে। Google Play store-এ ব্যাটারি দ্রুত ডিসচার্জ করার অনেক ধরণের এ্যাপ পাওয়া যায়, তার যে কোন একটি ব্যবহার করে কাজটি করা সম্ভব। “Fast Discharge” এমনই একটি এ্যাপ। এ্যাপ ব্যবহার ছাড়াও ব্যাটারি দ্রুত ডিসচার্জ করতে অনলাইনে ব্রাউজ বা ইউটিউব এ ভিডিও দেখার কাজ করা যেতে পারে।
  • ব্যাটারি সম্পূর্ণ ডিসচার্জ হবার পর সেটটি নিজে নিজে বন্ধ হয়ে গেলে ডিভাইসটি চার্জ দিতে শুরু করুন। বন্ধ অবস্থাতেই চার্জিং এর কাজটি সম্পূর্ণ করুন।
  • ১০০% চার্জ সম্পূর্ণ হবার আগে ডিভাইসটি চালু করা থেকে বিরত থাকুন। ১০০% চার্জ সম্পূর্ণ হবার পরও অতিরিক্ত কিছু সময় (১০/১৫ মিনিট) ডিভাইসটি চার্জ করুন। এরপর চার্জ শেষে ডিভাইসটি চার্জার থেকে আন-প্লাগ করে চালু করুন।
  • ডিভাইসটি চালু হবার পর ব্যাটারি ইনডিকেটর চেক করুন।। দেখুন শুধুমাত্র চালু হবার পর ব্যাটারির চার্জ ১০০% থেকে গিয়ে ৯৯% বা ৯৮% এ নেমে এসেছে কি না। যদি শুধুমাত্র ডিভাইস চালু হতেই চার্জ কমে গিয়ে থাকে তাহলে পুনরায় ডিভাইসটি বন্ধ করে চার্জ দিতে শুরু করুন। পুনরায় ১০০% চার্জ সম্পূর্ণ হলে অতিরিক্ত আরও ১০/১৫ মিনিট চার্জ করুন। এরপর চার্জার ডিসকানেক্ট করে ডিভাইস চালু করুন।
  • এভাবে কয়েকবার করে ব্যাটারির ইনডিকেটর দেখে চার্জ করতে থাকুন, যতক্ষণ না এটি বন্ধ থেকে চালু হওয়া পর্যন্ত ১০০% চার্জ না দেখায়।
  • ডিভাইস বন্ধ অবস্থায় চার্জ করে চালু করার পর ১০০% চার্জ ইন্ডিকেট করলে আপনার ক্যালিব্রেশন সম্পূর্ণ হয়েছে, বুঝতে পারবেন।





এ্যাপের সাহায্যে ক্যালিব্রেশন পদ্ধতিঃ

  • প্লে-স্টোর থেকে ব্যাটারি ক্যালিব্রেট করার এ্যাপ ডাওনলোড করে ইন্সটল করুন। ক্যালিব্রেট করার জন্যে প্লে-স্টোরে অনেক এ্যাপ রয়েছে। “Battery Calibration” তেমনই একটি এ্যাপ।
  • এরপর ডিভাইসটি একদম চার্জ শূন্য করে পুনরায় চার্জ করুন।
  • ১০০% চার্জ হবার পর  Battery Calibration এ্যাপটি চালু করুন।
  • “Start Calibration” বাটনে ক্লিক করুন এবং অপেক্ষা করুন, এ্যাপ নিজে নিজেই আপনার হ্যান্ডসেটের মডেল এবং তার তথ্য যোগাড় করে ক্যালিব্রেশন শুরু করবে। ক্যালিব্রেশন শুরু করার আগে আপনার নেট কানেকশন চালু  করে নিতে হবে।, নয়তো এ্যাপটি ক্যালিব্রেশন প্রসেস রান করবে না। ক্যালিব্রেশন চলার সময় বিভিন্ন এ্যাড দেখাতে পারে, এড গুলিকে স্কিপ করেই ক্যালিব্রেশন চালাতে হবে।
  • ক্যালিব্রেশন শেষে এ্যাপটি থেকে বের হয়ে আসুন এবং ডিভাইসটি বন্ধ করুন।
  • বন্ধ অবস্থায় পুনরায় চার্জার সংযুক্ত করুন, এবং ১০০% চার্জ করুন।
  • ১০০% চার্জ সম্পূর্ণ হবার পরও আরও কিছু সময় (১০/১৫ মিনিট) চার্জ করুন।
  • চার্জ সম্পূর্ণ হবার পর ডিভাইসটি চালু করুন। ডিভাইসটি ব্যাটারি ক্যালিব্রেশন সম্পূর্ণ হয়েছে।





ব্যাটারি ক্যালিব্রেশন শেষে পুনরায় উপরে বর্ণিত পদ্ধতিতে ডিভাইসটি চার্জ শূন্য করে আবার চার্জ সম্পূর্ণ করুন। আশা করি এরপর আপনার ব্যাটারি ড্রেইনিং সমস্যা অনেকাংশেই কমে আসবে।

এর সাথে ব্যাকগ্রাউড এ্যাপ গুলিকে বন্ধ রাখার জন্যে "Greenify" এ্যাপটি ব্যবহার করতে পারেন। এটি একই সাথে ব্যাটারি ড্রেইনিং কমাতে এবং ডিভাইসের মেমরি অপটিমাইজ রাখতে আপনাকে সহায়তা করবে।




সোমবার, আগস্ট ২১, ২০১৭

প্রণয়িনী



প্রণয়িনী,
        হৃদয় উজার করা ভালোবাসা নিও। যে অযুত শহস্র মায়ায় ডুবে আছে এই নক্ষত্রমণ্ডলী, সেই একই পরিমাণ মায়া জমা হয় তোমার নামে প্রতিটা মুহুর্ত এই অবুঝ হৃদয়ে। লাগামহীন এই মায়া, এই ভালোবাসা উন্মাদ করে দেয় আমায় মুহুর্তেই। পথ ছেড়ে প্রায়ই বিপথে হাটি তখন, ভুলে যাই উদ্দেশ্য, ভুলে যাই জীবনের লক্ষ্য। তখন কেবলমাত্র তুমিই থাকো আমার সামনে। কিন্তু থাকো ধরা ছোঁয়ার অনেক বাইরে। মরুভূমিতে পথ হারা পথিকের অনুভূতির মত তোমার মরিচিকার পিছনে ছুটে ফিরি তখন।

        জানি, শহস্রবার করে তোমাকে বলেছি 'তোমায় ভালোবাসি', এও জানি এইসব কথা তোমার কাছে মেকি মুদ্রার চেয়ে বেশি কিছু নয়। হয়তো এমন বারংবার "ভালোবাসি" বলায় তুমি হয়ে যাও বিরক্ত। হয়তো মাঝে মাঝে ঘৃণাও চলে আসে মনে। হয়তো আপত্তি থাকে এত শত বার করে "ভালোবাসি" শব্দটা তোমার শ্রবন ইন্দ্রীয়ে ছুঁয়ে যাওয়ায়। কিন্তু তুও বলি- তোমাকেই, শুধুমাত্র তোমাকেই ভালোবাসি। তুমি যখন বিরক্ত হও, তখন তোমার বিরক্তিকে ভালোবাসি। তুমি যখন ঘৃণা কর, তখন তোমার ঘৃণাকে ভালোবাসি। যখন এমন করতে করতে অতিষ্ট হয়ে যাও, তখন অতিষ্ট হওয়া ঐ তোমাকেই ভালোবাসি। এমন কোন মুহুর্ত নেই, তোমার এমন কোন অনুভূতি নেই- যে মুহুর্তটার ঐ অনুভুতি আমি ভালো না বেশে থাকতে পেরেছি। 

        তোমার প্রতিটি 'হুম', 'কিছু না', 'পরে' শব্দ গুলি কতটা রক্ত ক্ষরণ ঘটায় এই হৃদয়ে তা বোধ করি কোনদিনই তোমাকে বোঝাতে পারবো না। তোমার এক একটি 'হুম', এক একটি 'কিছু না', এক একটি 'পরে' শব্দগুলো আমাকে ছুড়ে ফেলে দেয় দিগন্ত সীমানায়। আমি বিকলঙ্গ মানুষের মত খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফের এগিয়ে আসি তোমার দিকে। আবারও অব্যক্ত বাক্য ব্যায়ে তোমার নিরাপদ সীমান্ত পার করে তোমাকে ছুঁতে চাই। আবারও তোমার হৃদয় মন্দিরের ঘন্টা বাজিয়ে তোমাকে সজাগ করতে চাই। আবারও চাই তোমার দৃষ্টি সীমানায় নিজেকে নিয়ে আসতে। আর আবারও তুমি আমায় ছুড়ে ফেলো ঐ দিগন্ত সীমার শেষ প্রান্তে!

        তুমি প্রতিনিয়তই নিজেকে আড়াল করে খুব যত্নে তোমার মাঝেই তোমাকে আটকে রাখো। নিজেকে সংরক্ষণ করে রাখো কোন এক অজানা উদ্দেশ্যে, যা আজও আমার কাছে পরিস্কার নয়। তবুও একদিন সকালে অরক্ষিত তোমাকে দেখে বিমোহিত হয়েছিলাম। হয়তো ঘুমিয়ে ছিলে বলেই এত দীর্ঘ সময় তোমাকে দূর থেকেই দেখার সুযোগ পেয়ে বসেছিলাম। ঘুমন্ত তোমার স্নিগ্ধ মুখমণ্ডলের সেই মায়া আমি আজও কাটিয়ে উঠতে পারি নি। কতটা সময় তোমাকে ওভাবে দেখতে দেখতে পার করেছি তা হিসেব করে বলতে পারবো না। কিন্তু সময়টা আমার কাছে দীর্ঘ ছিল। মনে হচ্ছিল অন্ততকাল এভাবেই বুঝি পার করে দেয়া যাবে তোমার ঘুমন্ত চেহারাটা দেখতে দেখতে। 

        তারপর কোন একদিন যখন কোন এক উচ্ছাসের মুহুর্তে তোমার কণ্ঠে একবার, হয়তো ভুল করেই 'ভালোবাসি' উচ্চারণ করে ফেলো। যখন তোমার ঐ ঠোঁটকে স্পর্শ করে 'ভালোবাসি' শব্দটা আওয়াজে রূপান্তরিত হয়। যখন তোমার উচ্চারিত 'ভালোবাসি' শব্দটা বাতাসে কম্পন তুলে এগিয়ে আসতে শুরু করে। তখন আমার দুনিয়াটাতে ঝড় বয়ে যায়। জলোচ্ছাস তৈরি হয় আমার হৃদয় উপকূলে। আনন্দ স্রোতে ভেসে যাই আমি আপন ঠিকানা ভুলে। ঝড়ো বাতাসে উড়ে যাই আমি, অথচ আমার সবকিছু পড়ে থাকে দূর পেছনে। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ছুটে বেড়াই। তোমার ঐ এইটুকু কথায় আমি যে কতটা এলোমেলো হয়ে যাই তার হিসেব কখনোই তোমাকে দিতে পারবো না। শুধু জানি, ঐ মুহুর্তে যদি প্রাণ বায়ু ত্যাগ করতে হয় তবে সেটাও হবে আত্মতৃপ্তির!

        হাজার কথায় তোমাকে বিরক্ত করলাম। জানি এইটুকুও বিরক্ত করার অধিকার এখনো আমার হয়নি। তবুও অযাচিত অধিকার প্রয়োগ করে তোমাকে শব্দগুলি উপহার দিলাম। হয়তো শব্দের এতটা জোড় নেই যা আমার আবেগ গুলিকে তোমার পর্যন্ত পৌছে দিতে পারবে। কিন্তু তোমার পর্যন্ত পৌছে দেবার মত এরচেয়ে জোড়ালো কোন পথও আমার চেনা নেই। তবে জেনো, অজস্র নক্ষবিথি বিরামহীন ঘুরে চলেছে আমাদের চারপাশ; আমিও তোমার চারপাশে এভাবেই ঘুরছি। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে তোমার সামনে প্রতিনিয়ত নিজেকে উপস্থিত করে তোমার বিরক্ত করে যাবো। 

        হয়তো অশান্ত মনের উপর এখনো নিজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসতে পারি নি। তবে একটা সময় ঠিকই নিজের নিয়ন্ত্রণ নিজের কাছেই নিয়ে আসবো। হয়তো সহসাই নয়, তবে খুব দ্রুতই। আর যেদিন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণটা চলে আসবে, ঐদিন থেকে তোমার সামনে উপস্থিত হয়ে আর তোমাকে বিরক্ত করবো না। তোমার জন্যে ভালোবাসার কমতি কখনোই হবে না, তবে তোমার বিরক্তি কমাতে আমি নিজেকে কোন এক দূর নক্ষত্রে নিক্ষেপ করবো। এত দূরের নক্ষত্রে যেখান থেকে চাইলেও তোমাকে আর কখনোই বিরক্ত করা সম্ভব হবে না।



        ভালো থেকো প্রণয়িনী, নিজের মত করেই ভালো থেকো। সম্ভব হলে আমার এই বেহায়াপনাকে মন থেকে বাদ দিয়ে নিজেকে শান্তি দিও। তবে জেনো, তোমার শান্তিতেই আমার সকল শান্তি নিহীত। 





ইতি
বেহায়া  যুবক




বুধবার, আগস্ট ০২, ২০১৭

গল্পঃ ইগো বিফোর থট্‌স


বছর দশেক আগে ছোট একটা ছোট সফটওয়্যার তৈরির মাধ্যমে পরিচিতিতে আসে প্রতিষ্ঠানটি, তবে তখনও অবশ্য প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে পরিচয় দেবার মত অবস্থা ছিল না তাদের। গজিয়ে উঠা আর ১০ টা আইডিয়াকে সফটওয়্যার তৈরির মতই ছিল তাদেরটি। কিন্তু ভাগ্যগুণে তাদের সফটওয়্যারটি খুব দ্রুত জনপ্রিয়তার মুখ দেখতে পায়। বছর ঘুরতেই প্রতিষ্ঠিত নানা সফটওয়্যার ফার্ম সফটওয়্যারটিকে চড়া দামে কিনতে বিভিন্ন প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু ততদিনে সফটওয়্যারটির প্রতিষ্ঠাতা এন্ড্রু ফক্সও বুঝে যায় সফটওয়্যারটির প্রকৃত মূল্য। তাই আর সেটাকে বিক্রির দিকে খুব বেশি আগ্রহ দেখায় না, বরং আরও ঢেলে সাজাতে শুরু করে সফটওয়্যারটি। কয়েক বছর পরেই স্টক মার্কেটে এর স্টকের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। বলা হয়, শুরুতে যারা খুব কম টাকায়ও একটা স্টক কিনে রেখেছিলেন, তারাও এখন প্রায় মিলিয়নইয়র।

তবে তারা কেবল একটা সফটওয়্যারের পেছনেই আটকে থাকে নি, ব্যবহারকারীর পছন্দ বুঝে ধীরে ধীরে তার সাথে যুক্ত করেছে আরও নানা ধরনের সফটওয়্যার। কয়েক বছর পর অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়াল যে- দুনিয়ার প্রতিটি শহর থেকে খুঁজলে অন্তত একজন পাওয়া যাবে যিনি এই সফটওয়্যারটি নিয়মিত ব্যবহার করে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে বাকি সকল আইডিয়া সমৃদ্ধ সফটওয়্যার গুলি এর সামনে নস্যি হয়ে গেল। যারা সুযোগ কাজে লাগাতে চেয়েছে তারা মোটামুটি একটা চুক্তির মাধ্যমে তাদের সুবিধাকে এই সফটওয়্যারটির সাথে জুড়ে দিতে লাগলেন। এভাবে চলতে চলতে যখন ১০ বছর পার করে ফেলল, তখন তাদের চাহিদা আকাশচুম্বী!

ধীরে ধীরে আইডিয়া খুঁজে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে উঠে পড়ে লাগল এন্ড্রু ফক্সের গড়ে তোলা 'ফক্স' প্রতিষ্ঠানটি। সেই ধারাবাহিকতায় প্রথমে আসল বট। বট গুলি মূলত রোবটের মত, তবে এদের কোন ফিজিক্যাল ব্যাপার নেই। মানে এটা পুরোটাই একটা সফটওয়্যার নির্ভর রোবট। নির্দিষ্ট নির্দেশনার ভিত্তিতে এরা বিরামহীন কাজ করে যেতে পারে। বটগুলিও তাদের সফলতার অংশ হয়ে উঠল। আর এরপরই আসল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের আইডিয়াটি।

নির্মাতা, রক্ষণাবেক্ষণ আর সমর্থনের জন্যে তখন ফক্স-এর হাজার খানিকের বেশি এমপ্লয়ি রয়েছে। তবুও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের এই ব্যাপারটি প্রধান নির্মাতা এন্ড্রু ফক্স একদম নিজ হাতে শুরু করেন। অনেকেই তখন কানা-ঘুষা শুরু করেছিল যে এটা হতে যাচ্ছে এন্ড্রু ফক্সের দ্বিতীয় সন্তান! অবশ্য কথাটা যে খুব ভুল বলেছে তাও নয়। যে আগ্রহ আর ধৈর্য নিয়ে তিলে তিলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সফটওয়্যারটি গড়তে শুরু করেছিল এন্ড্রু তা দেখে যে কারোরই মনে হতে বাধ্য সেটা। প্রথম কয়েক মাস তো নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়েই কাজ করে গেছে সে। তারপর মোটামুটি যখন তার মনে হল সফটওয়্যারটির একটি বেসলাইন তৈরি হয়ে গেছে তখন ডার ডেভেলপার টিমকে ডেকে বুঝিয়ে দিলেন কোন লেভেলে কি করতে চাইছেন তিনি।

মোটামুটি বছর খানিক বাদে তাদের এই প্রজেক্টটি একটা অবস্থানে পৌঁছে গেলো। যদিও একে এখনো সম্পূর্ণ বলার কোন অবস্থান তৈরি হয়নি, কিন্তু বলা যায় এটি তখন এন্ড্রুর স্বপ্নের একটা ধাপে পৌঁছে গিয়েছিল। এন্ড্রু খুব আগ্রহ নিয়ে পুরো সময় তার ডেভেলপার টিমের কাজের তদারকি করে গেছেন, নিজেও কাজ করে গেছেন সমান তালে। প্রাথমিক ভাবে তার এই দ্বিতীয় সন্তানের একটি রূপ তারা কিছুদিনের মাঝেই টেস্ট করতে যাচ্ছিল। কিন্তু বাদ সাধল তার সহকারী এবং ডেভেলপার টিমের ম্যানেজার ওয়ালেস রাসেল। যদিও এই প্রজেক্টের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সে এর সাথেই কাজ করে গেছে, তবুও টেস্ট রিলিজের জন্যে সে বেঁকে বসল। তার কথা- এটি এখনো টেস্ট করার জন্যেও প্রস্তুত নয়। আর পরামর্শ দিল- একে সিমুলেট করে টেস্ট করার জন্যে।

এন্ড্রু'র এতদিনের স্বপ্ন যখন প্রায় সফলতার কাছাকাছি, তখন এমন বক্তব্য শুনে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নি। একদম রাগের মাথাতেই ওয়ারলেসকে বের করে দিলেন ফক্স থেকে। ওয়ারলেসও একদম বিনা বাক্যে বের হয়ে গেলেন সেখান থেকে। ঘটনার পর থেকে অনেকেই ওয়ালেসের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কিছু একটা শোনার জন্যে উঠে পড়ে লেগে থাকে, কিন্তু ওয়ালেস এই ব্যাপার নিয়ে কোথাও মুখ খোলেন নি। একই সাথে প্রতিষ্ঠিত অনেক ফার্ম থেকেই লোভনীয় প্রস্তাব পাঠানো হয়, এসবকেও এড়িয়ে যান ওয়ালেস। কিছুদিন পর একদমই আলোচনার আড়ালে পড়ে যান তিনি।

কয়েক মাস বাদে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের টেস্ট বিল্ড তৈরি হয়ে যায়। অনেকেই এই ব্যাপারটির জন্যে এখন মুখিয়ে আছে। এন্ড্রুও খুব ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তার নতুন প্রজেক্টের টেস্ট রিলিজের খবর সবাইকে জানায়। এমন নয় যে এই একই আইডিয়া নিয়ে আর কেউ তখন কাজ করছিল না, কিন্তু তবুও তার এই আইডিয়াটি অন্য সবার থেকে আলাদা অবস্থান পায় তার পূর্ববর্তী কাজের জন্যে। সবাই ধরেই নিয়েছিল এন্ড্রুর হাত ধরে পৃথিবী-বাসী আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের দুনিয়াতে প্রবেশ করত যাচ্ছে।

নির্দিষ্ট সময়েই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে দুটো উন্নতমানের বিশেষ রোবটের মাঝে স্থাপন করা হয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাদের একটি বিশেষ রুমেও আবদ্ধ করা হয়। তবে রোবট হলেও দুটো হাত আর মাথা ছাড়া তাদের আর কোন অঙ্গ দেয়া হয়নি। দুটো রোবটকে সামনা-সামনি বসিয়ে দিয়ে চালু করে দেয়া হয় তাদের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্রেইন!

প্রথম আধঘণ্টা সিস্টেম বুট-আপ, রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, মেমরি সিনক্রোনাইজেশন, প্রাইমারি ডেটা রিয়েলাইজেশন সহ আরও নানা কাজ করতে করতেই কেটে যায়। দেখে মনে হচ্ছিল দুটো অসাড় বস্তু মুখোমুখি বসে আছে। আমন্ত্রিত অতিথি যারা সরাসরি এটা পর্যবেক্ষণ করতে সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাদের মাঝে কয়েকজন টিপ্পনীও কাটতে শুরু করেছিল ততক্ষণে। ঘুরেফিরে এন্ড্রুর কানেও ওসব কথা চলে আসছিল, তবে এন্ড্রু সেসব নিয়ে মোটেই ভাবছিল না। সিস্টেম কন্ট্রোল এন্ড মনিটরিং এর দিকে বেশ মনোযোগ ধরে রাখছিল সে। সে মনে প্রাণে বিশ্বাস রাখে তার কাজের উপর। সে জানে, সময় নিয়ে হলেও তার আইডিয়াটি এখন বাস্তবতার আয়নায় প্রতিফলিত হবে।

আর হলও তাই, আধ ঘণ্টা পরই রোবট দুটো প্রায় একই সাথে ফটো সেলের আলো জ্বালিয়ে কৃত্রিম চোখ দুটো মেলে চাইতে শুরু করল। প্রায় অবিকল একজন আরেকজনকে দেখে কিছুটা অবাক হওয়ার ভানও ফুটিয়ে তুলল তাদের কৃত্রিম চেহারা দুটোতে। বেশ অনেকটা সময় নিজেকে আর নিজের সামনে বসে থাকা অবিকল তার মতই দেখতে আরেকটি রোবটকে উভয়ে পর্যবেক্ষণ করে কাঁটাল।

ওভাবে কিছু সময় কাটাবার পর তারা তাদের হাত দুটোর কার্যক্ষমতা দেখতে শুরু করল। একটা বাচ্চাকে হুট করে বড় মানুষের শরীরে ঢুকিয়ে দিলে যেভাবে সে নিজেকে আবিষ্কার করে অবাক হয়, ঠিক ঐরকমই একটা অবাক চাহনি নিয়ে নিজেকে নিজে তারা আবিষ্কার করছিল। আঙ্গুল গুলো নেড়ে, হাতের কব্জি এদিক সেদিক বাঁকিয়ে, মুঠো করে আবার ছেড়ে দিতে দিতে হাত নাড়াচাড়া করতে লাগল। উল্টে পাল্টে বারবার নিজেদের হাত গুলো দেখছিল তারা। এরপর একজন হাত দিয়ে নিজের কৃত্রিম চেহারাটকে ছুঁয়ে দেখতে শুরু করল, একজনের দেখা দেখি আরেকজনও একই কাজ করতে শুরু করল। চোখ, মুখ, ঠোট, গাল, মাথা সব একে একে হাত বুলিয়ে, আঙ্গুলে ছুঁয়ে বুঝে নিতে শুরু করল।

সবচেয়ে মজার ব্যাপারটি ঘটল যখন তারা তাদের স্পিকিং সিস্টেমটিকে ব্যবহার করতে শুরু করল। সাধারণত প্রোগ্রাম গুলিতে একটা সাধারণ ভাষা ইন্সটল করে দেয়া হয়। কিন্তু এটি সাধারণ কোন প্রোগ্রাম নয়, এটি একটি বিশুদ্ধ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরির একটি পদক্ষেপ। বলতেই হবে, এন্ড্রু এখানেই দারুণ একটা মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছে। সে তার সিস্টেম মডেলিং এর সময় প্রাথমিক কোন ভাষা সরাসরি ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়নি। যদিও সিস্টেম লাইব্রেরিকে ইংরেজি ভাষাটা ব্যবহারের জন্যে আলাদা কিছু অনুমতি দিয়ে রেখেছিল। তবে সেটা সরাসরি নিজে নিজে ব্যবহারের জন্যে একদম শুরুতেই দেয়া হয়নি। ব্যাপারটা অনেকটা বাচ্চাদের মত, ওরা যেমন একদম শুরু থেকেই কোন শব্দের ব্যবহার করতে পারে না, ঠিক তেমনি এই বিশেষ আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্ট রোবট দুটিও। ওদেরও নির্দিষ্ট করে দেয়া কোন ভাষা ছিল না। ওদেরকেও নিজে নিজে এটা রপ্ত করতে হবে। আর কেবল এরপরই তারা ঐ ভাষায় নিজের পরিধি অনুসারে কথায় ব্যবহার করতে পারবে।

যখন আমন্ত্রিত পর্যবেক্ষকরা এটা বুঝতে পারল তখন তাদের অবাক হওয়ার মাত্রাটা একদম চুড়ায় গিয়ে পৌঁছেছিল। কেউ কেউ এটাকে একটা মূর্খতা বলতে শুরু করল, আর কেউ কেউ সত্যিই এই আইডিয়াটা দেখে চমৎকৃত হলেন। তবে ঐদিনের মত আর ওখানে বসে থাকার কোন মানে ছিল না। প্রায় ৩ ঘণ্টার একটা শো শেষ করে সবাই ফক্সের প্রেজেন্টেশন রুম ত্যাগ করল। তবে ত্যাগ করলেও পর্যবেক্ষণ থেমে গেলো না। এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্ট রোবট দুটোর কার্যক্রম সরাসরি দেখবার জন্যে ইতোমধ্যে ফক্স একটি প্রাইভেট লিংক লাইন তৈরি করে নিয়েছিল। আমন্ত্রিত অতিথিদের সবাইকে সেই লিংক লাইনে যুক্ত করে নেয়া হয়েছিল আগে থেকেই। এখন যতক্ষণ এই এ.আই রোবট দুটোর কার্যক্রম চলবে ততক্ষণ যে কোন সময়ই যে কোন স্থান থেকে অতিথিরা এর কার্যক্রম দেখে যেতে পারবে।

প্রায় ৭ দিন পার হবার পর ধীরে ধীরে এ.আই. রোবট দুটো কথা চালাবার মত বেশ অনেকগুলি শব্দ রপ্ত করতে শিখে গিয়েছিল। আস্তে আস্তে তাদের লাইব্রেরি পারমিশন গুলো ব্যবহার করে লাইব্রেরি হতে তাদের মেমরিতে ডেটা ট্রান্সফার করতে শুরু করেছে ততদিনে। প্রায় সকল এনালাইসিসের ফলাফল পজিটিভ দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে দেখে পুরো টিম যারপরনাই খুশি। তাদের আনন্দটা ছিল দেখবার মত। আর এন্ড্রু! সে যেন  কাঁচ ঘেরা পর্দার এপাশে বসে নিজ দু'সন্তানকে কাচের ওপাশে দেখছিল। ঠোটের কোনের হাসি যেন তার পিছুই ছাড়ছিল না!

১৫ দির পার হবার পর বেশ কিছু বাগ জমা পড়ে, কিছু আপগ্রেডিং এর আইডিয়াও এক একজনের মাথায় আসতে থাকে। এর মাঝে এ.আই. রোবট দুটোকে তাদের ফক্সের প্রাইভেট সার্ভারের এক্সেস দেয়া হয়। সেখানে শেখার জন্যে ইতিহাস, ভাষা, ভূগোল, অর্থনীতি, বিজ্ঞান এমনকি গল্পের বইও দেয়া হয়। দেয়া হয় বিশাল এক মিউজিকের কালেকশন। আরও দেয়া হয় চলচ্চিত্র, গুরুত্বপূর্ণ স্থিরচিত্রের বিশাল এক সংগ্রহ। তারা এসবের প্রায় প্রতিটিকেই ছুঁয়ে দেখেছে। এ. আই. হিসেবে তাদের একটি দ্রুত কাজ করার প্রসেসর থাকায় মানুষের তুলনায় বেশ অনেক দ্রুতই তারা অনেক বিষয় আয়ত্ত করতে শিখেছিল। অবশ্য এটা অনুমেয় ছিল।

কিন্তু যেটা অবাক করেছে তা হল তাদের মিউজিকের পছন্দ! এ.আই. রোবট দুটোর আলাদা আলাদা মিউজিক পছন্দ ছিল। একটি রোবট খুব উচ্চতালের গান বার বার শুনতে লাগল। একই ধরণের গানগুলিকে আলাদা করে সেগুলিকে শুনতে লাগল। আর অন্যটি ঠিক তার বিপরীত কাজ করতে শুরু করল। সে তুলনামূলক হালকা তালের গানগুলিকে বেঁছে নিলো। বেছে বেছে একটা প্লে-লিস্ট তৈরি করে ঐ গান গুলিই বারবার করে শুনল সে। সে যখন গান শুনত, তখন অবিকল মানুষের মত করে চোখ বন্ধ করে সুর গুলিকে শুনত। যেন সুর গুলো তার চিন্তা-ভাবনা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

তবে এর থেকেও বড় অবাক হবার বিষয়টি এখনো তাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। ব্যাপারটি ধরা পড়ল প্রায় মাস খানিক পর। যারা রোবট দুটোকে নিরীক্ষণ করছিল তারা প্রথমে ব্যাপারটাকে ধরতেই পারে নি। আর ব্যাপারটি সত্যিই খুব সাধারণ ছিল। এত সাধারণ যে সেটাকে এমনিতে কেউ আমলেই নিতো না। কিন্তু এনালাইসিস করে ধীরে ধীরে পর্যবেক্ষকদের কাছে ব্যাপারটা ধরা পড়ে।

বাচ্চারা যেমন কথা বলবার সময় একটি শব্দের বদলে অন্য আরেকটি সুবিধাজনক শব্দ ব্যবহার করে, চাই সেটা আদৌ কোন শব্দ হোক কিংবা না হোক। ঠিক প্রায় একই রকম করে রোবট দুটোও ক্রমাগত ভুল করে যাচ্ছিল। আর সময়ের সাথে যেন ভুলের পরিমাণও ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছিল। শেষের দিকে তো এমন অদ্ভুত শব্দ প্রয়োগেই তারা প্রায় কম্যুনিকেট করতে শুরু করল নিজেদের মাঝে। প্রথমে এনালিস্টরা ওটা তাদের শব্দের সীমাবদ্ধতা হিসেবেই ধরে নিয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘসময় এনালাইসিস করার পর নিরীক্ষকেরা বুঝতে পারল এটি আসলে ভুল নয়! এটি একটি নতুন ডেভেলপ করা ভাষা! যা কোন মানব সভ্যতার অংশ নয়‍!!

ওদিকে লাইভ টেলিকাষ্টেও সেটা পৌঁছে গিয়েছিল সকল আমন্ত্রিত অতিথিদের কাছে। তারাও একটা সময় এ.আই. রোবট দুটোর এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে অবাক হতে শুরু করেছিল। আর তাদের এনালাইসিস টিম গুলোও এটা নিয়ে নিজেদের মতামত তখন নানা মিডিয়াতে প্রকাশ করতে শুরু করেছিল। আর এই অবস্থাটাই বেশ বেসামাল করে দেয় ফক্স কোম্পানিটিকে।

এন্ড্রুর বুঝতে অসুবিধা হল না কি ঘটছে সুরক্ষিত কাঁচের দেয়ালের ওপাশে। এ.আই. রোবট দুটো নিজেদের জন্যে আলাদা ভাষা তৈরি করে নিয়েছে নিজেদের সুরক্ষার জন্যে। আর ভাষাটা এমনভাবেই তৈরি করেছে যে ওটা এখন পর্যন্ত ডিকোড করা সম্ভব হয়নি। অবস্থাটা আবিষ্কারের পর প্রায় ৩ দিন পার হয়ে গেছে। ফক্সের স্পেশাল ডিকোডার টিম এটি নিয়ে এখনো আশার আশ্বাস দিতে পারে নি। তারা এখনো বুঝতেই পারছে না ঠিক কোথা থেকে পিক করতে হবে।

মিডিয়ার চাপ, টেক দুনিয়ার বিশেষজ্ঞদের মতামত আর জাতীয় পর্যায়ের সিকিউরিটির নির্দেশনায় অবশেষে ৪৮ দিনের মাথায় রোবট দুটোকে বিকল করতে হয়। এন্ড্রু বেশ ভালো করেই বুঝেছিল এরচেয়ে বেশি সময় অপেক্ষা করাটাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। শুধুমাত্র লিমিটেড রিসোর্স ব্যবহার করেই এ.আই. রোবট দুটো যা করতে সক্ষম হয়েছে তার বিপরীতে যদি পুরো ইন্টারনেটটা তাদের হাতে পেয়ে বসে তাহলে আর তাদের অগ্রগতির কথা কল্পনা করাও অসম্ভব। এতদূর এসে ওয়ালেস রাসেলের কথা তার মনে পড়ল। বুঝল কত বড় ভুল সে করে গেছে প্রিয় বন্ধু আর সহকর্মী ওয়ালেসের কথাটা না শুনে। শুধুমাত্র রাগ আর জেদের বসে সে পুরো ব্যাপারটিকে বুঝে নিতে অসমর্থ হয়েছিল। আর তার খেসারত দিতে হচ্ছে এখন পুরো ফক্স কোম্পানিকে। যারা আশা করে ছিল এই এন্ড্রু ফক্সের হাত ধরেই পৃথিবী আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের দুনিয়াতে পদার্পণ করবে, তারাই এখন বলে বেড়াচ্ছে এন্ড্রু দুটো মারণাস্ত্র তৈরি করেছে দুনিয়ার জন্যে! তাদের বিশ্বাস আর আস্থা এখন পুরোপুরি উবে গেছে ফক্সের উপর থেকে।

অবিচারের প্রতিফলন বুঝি এভাবেই দৃশ্যমান হয়। ওয়ালেস রাসেলের প্রতি অবিচার আজ বিশ্ববাসীর কাছে বিশ্বাস হারা করেছে এন্ড্রু ফক্সকে!