অনুবাদ গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
অনুবাদ গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বৃহস্পতিবার, মে ৩০, ২০১৯

অনুবাদ গল্পঃ রাজা এবং চিত্রশিল্পী


সে অনেক...অনেকদিন আগের কথা। সেই দূর সিমান্ত পেরিয়ে সাগরের নীল ঘেষে ছিল এক রাজ্য। গল্পে গল্পে আমরা যে সুখ-সম্মৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ রাজ্যের কথা বলি, এই রাজ্যটি ছিলো ঠিক তারই এক জলজ্যান্ত উদাহরণ। সেই রাজ্যে গরীব থাকলেও কেউ অনাহরী ছিলো না। ক্ষুধা পেটে নিয়ে কেউ ঘুমাতে যেতো না। অভাবে স্বভাব নষ্ট করে কেউ সেখানে চুরি করতে যেতো না। পরিপূর্ণ সুখের নগরি বলতে আমরা যেমনটা কল্পনা করি, রাজ্যটি ছিল ঠিক সেই রকমের। 

কিন্তু এত সব পূর্নতার মাঝেও সেখানে একটি অপূর্ণতা ঠিকই উপস্থিত ছিলো। সেই রাজ্যের যে রাজা, সে সুখে থাকলেও শারিরিক ভাবে সে ছিলো অপূর্ণ। সেই ছোট্ট কালে একবার দারুণ অসুস্থ হয়ে তাকে হারাতে হয় তার একটি পা আর একটি চোখ। অথচ শারিরিক এই অপূর্ণতা কখনোই তার হৃদয়ে ভালোবাসার কমতি ফেলেনি। যেমনটি তার হৃদয় ছিলো কোমলোতায় পরিপূর্ণ তেমনি তার মগজ ছিলো সুক্ষ্মবুদ্ধিতে ভরপুর। আর তাইতো রাজ্যের সবাই তাদের এই প্রজাবৎসল রাজাকে সত্যিকার অর্থেই হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতো, তার মঙ্গল কামনা করতো। 

তো একদিনের কথা, সেদিন রাজা দরবারের কাজ শেষ করে তার প্রাসাদ ঘুরে ঘুরে দেখছিলো। প্রাসাদের হলঘর ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে গিয়ে চোখ পড়লো তার পূর্বপুরুষদের তৈলচিত্রের দিকে। চিত্রে তার সব পূর্বপুরুষ ব্যক্তিত্ব দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। এই হল দিয়ে পার হবার সময় ছবিগুলোতে চোখ পড়লেই গর্বে তার বুক ফুলে উঠে। সে জানে, তার মতই তার অনুজেরা এই হল দিয়ে হেঁটে যাবার সময় গর্বিত হবে। তারা এই তৈলচিত্র দেখেই তাদের পূর্বপুরুষদের বুঝতে শিখবে, স্মৃতিতে জড়িয়ে রাখবে। তাদের ব্যক্তিত্ব আর মহত্বকে নিজেদর মধ্যে ধারণ করবে। 

এইসব ভাবতে ভাবতেই মনে পড়লো, পূর্বপুরুষদের এই সারি সারি ছবির মধ্যে এখনো তার ছবিটি স্থান পায় নি। আর পারবেই বা কিভাবে! তার এই অপুর্ণ শারিরিক অবস্থা এতটা প্রসন্ন হয়নি যে বলিষ্ঠ একটি চরিত্র ঐরকম একটি তৈলচিত্রে ফুটে উঠবে। এই ভেবেই হঠাতই তার মন খারাপ হয়ে উঠলো। তারপরও সে হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। পরবর্তি দিনই রাজসভায় সে এই কথা উঠালো। আর তারপরই নানা রাজ্যের চিত্রকরদের তার রাজদরবারে নিমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হলো। 

দূর দূরান্ত থেকে অনেক নামীদামী চিত্রকর উপস্থিত হলো সেই দরবারে। উপস্থিত সেই মজলিসে রাজা বললেন- 

আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ আমার আমন্ত্রণে সাড়া দেবার জন্যে। আমি খুবই আনন্দিত যে আপনারা এত অল্প সময়ে নিজ নিজ ব্যস্ততা ফেলে আমরার আমন্ত্রণ রক্ষা করতে আমার দরবারে উপস্থিত হয়েছেন। অবশ্য এভাবে আপনাদের আমন্ত্রণ জানাবার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণও রয়েছে। 

আপনারা সকলেই জানেন আমাদের এই রাজপরিবারের শেকড় এই রাজ্যের গোড়াপত্তন থেকেই রাজ্যকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করে আসছে। আমার সকল পূর্বপুরুষেরা বেশ সফলতার সাথেই তাদের এই রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ আর নিরাপত্তা প্রদাণ করেছে। আর সেই ধারাবাহিকতায় আজকে এই সিংহাসনে আমার অবস্থান। 

পূর্বপুরুষদের মত না হলেও আমি চেষ্টা করেছি আমার সর্বোচ্চোটা দিয়ে তাদের এই সফলতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে। কিন্তু তবুও আমার শারিরিক অপূর্ণতা আমাকে কিছু বিষয় থেকে হয়তো পিছিয়ে রেখেছে। হয়তো আমার এই অপূর্ণতা আমার মাঝেও একটি হীনমন্যতা সৃষ্টি করেছে। আর সেই হীনমন্যতার কারণেই এখন অব্দি আমি আমার পূর্বপুরুষদের পারিবারিক তৈলচিত্রের সাথে নিজের একটি চিত্র এখনো স্থান দিতে পারি নি। 

বন্ধুগন, অনেক দেরিতে হলেও আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার পূর্বপুরুষেরা তৈলচিত্রের যে মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট আর বলিষ্ঠতার বার্তা তাদের অনুজদের নিকট পৌঁছানোর জন্যে রেখে গেছেন; সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আমিও আমার একটি চিত্র আমার পূর্বপুরুষদের সাথে রেখে যেতে চাই। যাতে আমার পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের তৈলচিত্র দেখে আমাদের বুঝতে পারে, অনুধাবন করতে পারে, তৈরি করতে পারে আপন বৈশিষ্ট আমাদের আদলে। 

সম্মানিত বন্ধুগন, আপনারা সকলেই আমার শারিরিক অপূর্ণতা লক্ষ করেছেন। আমি চাই না আমার এই শারিরিক অপূর্ণতা সেই চিত্রে স্থান পাক। বরং আমি চাই এই শারিরিক অপূর্ণতা ঢেকে এমন একটি তৈলচিত্র তৈরি হোক, যা দেখে আমার পরবর্তী প্রজন্মের অনুজেরা অনুপ্রেরণা পাবে; যেমনটি আমি আমার পূর্বপুরুষদের চিত্র দেখে পেয়েছি। 

আর এমন একটি অসাধারণ চিত্র অঙ্কনের দায়িত্ব আমি আপনাদের উপর অর্পন করছি। যদি আপনাদের মাঝে কেউ এই অসম্ভবটি সম্ভব করতে পারেন তাকে এই দরবার হতে পুরস্কৃত এবং সম্মানিত করা হবে। 



রাজার এমন আহ্বানে সকল চিত্রশিল্পী চিন্তায় পড়ে গেলো। একজন রাজা, যার একটি চোখ এবং একটি পা নেই; আদৌ কি তার এমন কোন চিত্র অঙ্কন করা সম্ভব যা হবে তার পূর্ববর্তী পুরুষদের মত বলিষ্ঠ আর আকর্ষনীয়! নামী দামী সকল চিত্রকরই অনুধাবন করলেন এমন আকর্ষণীয় কোন চিত্র আসলে তৈরি করা সম্ভব নয়। আর যদি চিত্রে ভুল করে কেউ তার এই অপূর্ণ প্রতিকৃতি ফুটিয়েই তোলে তাতে রাজার আপন ব্যক্তিত্ব পরবর্তী প্রজন্মের নিকট প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে রইবে। আর সেটি দেখে রাজার মনক্ষুন্ন হতে পারে, যার ফলাফল হিসেবে মিলতে পারে কঠিন শাস্তি। তাই একে একে সকল চিত্রশিল্পীই নানান ছুতোয় নিজেদের ব্যর্থতা প্রকাশ করতে লাগলেন।  


কিন্তু আমন্ত্রিত এই চিত্রশিল্পীদের মাঝেই এক অখ্যাত চিত্রকর হাত তুলে রাজার দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা করলেন। রাজা যখন তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে কথা বলবার অনুমতি দিলেন তখন সেই চিত্রকর বলল- আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনি যা চাচ্ছেন তা আমি তৈরি করে দিতে পারবো। কিন্তু আমি যেহেতু কোন খ্যাতমান চিত্রকর নই তাই আপনি আদৌ কি আমাকে আপনার তৈলচিত্রটি অঙ্কন করার অনুমতি প্রদাণ করবেন?

চিত্রকরের এমন কথা শুনে রাজা বললো- আমি খুব আনন্দের সাথেই আপনাকে আমার এমন একটি চিত্র অঙ্কনের অনুমতি প্রদাণ করলাম। 

বাকি সব নামী-দামী চিত্রকর এমন প্রস্তাবে হতবাক হয়ে গেলো। তারা ভেবেই পেলো না কিভাবে এমন একটি চিত্র তৈরি হবে যেখানে রাজার অপূর্ণতা ঢেকে তাকে বেশ আকর্ষণীয় ভাবে উপস্থাপন করা যাবে! তাও আবার সেটি আঁকবে এক অখ্যাত চিত্রকর, যার নাম আজকের এই মজলিসে উপস্থিত হয়েও অনেকের অজানা!


রাজার অনুমতি নিয়েই সেই অখ্যাত চিত্রকর তার কাজ শুরু করলেন। রাজদরবারের এক কোনে তাকে তার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি প্রদাণ করা হলো। আর সকল সরঞ্জমাদি হাতে পেয়েই শুরু করলো চিত্রকর তার কাজ। 

ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে যাচ্ছে। সব চিত্রকরের মধ্যে ফিস্‌ফিস শব্দে নানা কথা ঘুরছে দরবার জুড়ে। সবাই আশঙ্কা করছে আজই গর্দান যাবে এই গর্দভ চিত্রকরের। 

দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা, সকলেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে চিত্রকরের তৈরি সেই কাঙ্খিত চিত্রটি দেখবার জন্যে। দিন গরিয়ে সন্ধ্যায় সকলেই ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। কিন্তু তাদের আগ্রহের সামনে তাদের ক্লান্তি আর ক্ষুধার যেন মৃত্যু ঘটেছে আজ। 


সন্ধ্যার বেশ খানিকটা পর চিত্রকর তার হাতের ব্রাশটি রাখলেন। জানালেন তার কাজ সমাপ্ত হয়েছে। সাথে সাথেই দুইজন প্রহরী এসে চিত্রকরের ক্যানভাসটি রাজদরবারের  দিকে ঘুরিয়ে দিলো। মজলিসে উপস্থিত সকল মন্ত্রী, সকল সভাসদস্য, খ্যাতিমান চিত্রকরেরা এমনকি খোদ রাজা নিজেই সেই চিত্র দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে রইলেন! 

এ কি করে সম্ভব! এমনটাও যে হতে পারে তা কি ভেবে দেখেছিল কেউ! 

রাজা ঠিক যেভাবে তার তৈলচিত্রে তার ব্যক্তিত্ব আর বৈশিষ্টকে ফুটিয়ে তুলতে অনুরোধ করেছিলেন, ঠিক ঐভাবেই তাকে এই তৈলচিত্রে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বিস্ময়ে কারও মুখে কোন রা'ও ফুটলো না। 

চিত্রকর তার ঐ তৈলচিত্রে রাজাকে একেছেন এমন একটি ভঙ্গিমায় যেখানে রাজা একটি ঘোড়ার উপর বসে আছেন, আর সে তার একটি চোখ বন্ধ করে আরেকটি চোখ দিয়ে তীরের নিশানা ঠিক করছেন। তার ঐ ভঙ্গীমায় তার সেই অপূর্ণ একটি চোখ আর একটি পা সম্পূর্ণরূপে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। আর একই সাথে প্রকাশ পাচ্ছে রাজার বিচক্ষণতা, বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব আর রাজা হিসেবে তার রাজ্যের রক্ষণক্ষমতা! 


তৈলচিত্রটি দেখে রাজা দারুণ খুশি হয়ে উঠলেন। আর একই সাথে ঐ অখ্যাত চিত্রশিল্পীকে এই রাজ্যের প্রধাণ চিত্রশিল্পী হিসেবে ঘোষনা দিলেন। সাথে আরও দিলেন মূল্যবান অনেক পুরস্কার। 





⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎  নীতিনিষ্ঠ মূল্যায়ন  ⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎
আমাদের সকলেরই উচিৎ অন্যের ঘাটতিকে উপেক্ষা করে তাদের ইতিবাচক দিককে গ্রহণ করা, তাকে প্রকাশ করা। আমাদের শেখা উচিৎ কিভাবে নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা প্রতিভাটি সকলের সামনে ইতিবাচক ভাবে উপস্থাপন করা যায়। যদি আমরা নেতিবাচক অবস্থাতেও ইতিবাচক চিন্তা করতে পারি, ইতিবাচক মনোভাব দেখাতে পারি তাহলে আমরা আরও বেশি দক্ষতার সাথে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমাদের সকল সমস্যাকে সমাধান করতে সক্ষম হবো। আমাদের ভেতর যেসকল দূর্বলতা ঘাপটি মেরে রয়েছে, সে সকল দূর্বলতা ঢাকতেই আমরা সদা সচেষ্ট থাকি। অথচ যদি ইতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ আমরা ঘটাতে পারি তখন আমাদের ঐসব দূর্বলতা কাটিয়ে আমরা সকলেই একই কাতারে এসে দাড়াতে পারবো। হতে পারবো নিজ নিজ ক্ষেত্রের শ্রেষ্ঠতম একজন! 








…………………………………………
মূল লেখকঃ অজ্ঞাত
সোর্সঃ "Moral Stories" via pinterest.com

বৃহস্পতিবার, জুলাই ২৭, ২০১৭

অনুবাদ গল্পঃ হারানো ওয়ালেট


দিনটি আর দশটি দিনের মতই সাধারণ একটি দিন ছিল। বেশ ঠাণ্ডা পড়ছিল ঐ দিনগুলোতে। সেদিন যখন বাসায় ফিরবার পথ ধরে হেটে যাচ্ছিলাম তখন বেখেয়ালেই কিছু একটা পা দিয়ে মারিয়ে গেলাম। নিচু হয়ে দেখলাম একটা ওয়ালেট পড়ে আছে সেখানে। কেউ সম্ভবত তার ওয়ালেটটি এ পথে হাটতে গিয়েই হারিয়েছে। উবু হয়ে ওয়ালেটটি তুললাম রাস্তা থেকে। কার ওয়ালেট তা জানার জন্যে ভেতরে ঠিকানা খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু মাত্র তিনটি ডলার আর এক কোণে থাকা এক দুমড়ানো একটা ভাজ করা কাগজ ছাড়া তাতে আর কিছুই দেখতে পেলাম না। মনে মনে আশা করলাম কাগজটিতে হয়তো তার পরিচয় পাওয়া যাবে। 

ওয়ালেটের কোণ থেকে ঐ দুমড়ানো কাগজটি সাবধানে বের করে নিয়ে আসলাম। দেখলাম প্রায় বিবর্ণ একটি চিঠির খাম সেটা। আর এমন ভাবে ওয়ালেটের কোণে রাখা ছিল খামটি, যেন বহুবছর ধরেই তার ঠিকানা ঐ কোণটি। খামটির অবস্থা প্রায় যাচ্ছেতাই রকমের ছিল, শুধুমাত্র ফিরতি ঠিকানাটি বাদে আর কিছুই খামটি গা থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হল না। তবে আশার কথা হচ্ছে, খামটির ভেতর একটি চিঠির অস্তিত্বও অনুভব করতে পারছিলাম। শুধুমাত্র ওয়ালেটটির মালিকের খোঁজের আশায় আমি চিঠিটি খাম থেকে বের করে নিলাম। কিন্তু চিঠিটির উপরে থাকা তারিখটি দেখে আমার চোখ প্রায় কপালে উঠার যোগাড়। সেখানে তারিখ দেয়া আছে ১৯২৪ সালের একটি দিনের। আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে লেখা চিঠি এটি!

দেখে বুঝলাম কোন এক মেয়েলি হাতের গুটি-গুটি অক্ষরে লিখা রয়েছে চিঠিটি। কাগজটি ছিল অমসৃণ নীল বর্ণের, যার বাম দিকের এক কোনায় চমৎকার একটি ফুল আকা। চিঠিটি পড়ার পর বুঝলাম এটি প্রিয় মানুষের কাছে লেখা এক পত্র, যেখানে লেখিকা হান্যা তার প্রিয় মানুষ মাইকেলের কাছে নিজের অপারগতা প্রকাশ করেছে। একই সাথে হান্যা যে তাকে মন থেকে প্রচণ্ড পরিমাণে ভালোবাসে তাও লিখা আছে চিঠিটিতে। শুধুমাত্র তাদের বয়সের পার্থক্য আর হান্যার মায়ের শক্ত বাঁধার কারণে সে তার প্রিয়পাত্রের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারছে না বলেই এই অপারগতার প্রকাশ। হান্যা আরও লিখেছে, সে আজীবনই মাইকেলকে ভালোবেসে যাবে।

সন্দেহ নেই এটি হৃদয়বিদারক কিন্তু চমৎকার একটি চিঠি। কিন্তু শুধুমাত্র মাইকেলের নামটি ছাড়া চিঠি থেকে ওয়ালেটটির মালিক সম্পর্কে কোন ধারণাই পাওয়া গেল না। যেহেতু হান্যার একটি ফিরতি ঠিকানা ছিল, তাই আশা করলাম অপারেটরের সহায়তা নিয়ে এই ঠিকানার একটা কূল কিনারা করা সম্ভব হবে। ঠিকানাটির বিপরীতে যদি কোন ফোন নম্বর রেজিস্টার করা থাকে তাহলে কাজটি আমার জন্যে বেশ সহজ হয়ে যাবে।

চিঠিটি পকেটে ভরে ওয়ালেটটি হাতে নিয়েই দ্রুত বাড়ির দিকে রওনা হলাম। একটু দ্রুত করলে হয়তো সন্ধ্যার আগে আগেই ওয়ালেটটি তার মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারবো। বাসায় পৌঁছেই দ্রুত জামা পাল্টে অপারেটরকে ফোন দিলাম। বললাম- "অপারেটর, একটি অযাচিত অনুরোধ করতে যাচ্ছি আমি।" অপারেটর আমার কথাটি শুনে একটু সময় নিয়ে বলল, "বলুন"। সম্মতি পেয়ে আমি বললাম, "আসলে আমি একটি ওয়ালেট খুঁজে পেয়েছি রাস্তায়, আর ওয়ালেটটির মালিকের খোঁজ করতে চাচ্ছিলাম। আপনি কি আমাকে একটি ঠিকানার বিপরীতে কোন ফোন নম্বর রেজিস্টার করা আছে নাকি তা বলতে পারবেন? ঠিকানাটি আমি ঐ ওয়ালেটের ভেতর একটি চিঠি থেকে পেয়েছি।"

ওপাশ থেকে অপারেটর বলল- "আসলে এমন ব্যাপারে সরাসরি আমার সুপিরিয়রের সাথে কথা বললেই আপনার জন্যে ভালো হবে।" এরপর একটু থেমে যোগ করল- "আমি আপনার সমস্যাটির কথা বুঝতে পেরেছি। আর ঠিকানাটি চেক করেও দেখলাম এখানে একটি ফোন নম্বর রেজিস্টার্ড আছে। কিন্তু গ্রাহক নিরাপত্তার খাতিরে আমি আপনাকে ঐ নম্বরটি দিতে পারছি না। কিন্তু আপনার উদ্দেশ্যের প্রতি সম্মান করে আমি আপনার হয়ে সেখানে কথা বলতে পারি। আপনার ঘটনাটিও আমি সবিস্তরে তাদের জানাবো। এরপর যদি তারা যোগাযোগ করতে আগ্রহী হয় তাহলে আপনার সাথে তাদের যোগাযোগ করিয়ে দেবো।" 

সন্দেহ নেই, এটি একটি চমৎকার প্রস্তাব। আমি অপারেটরের কথায় রাজি হয়ে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রাখলাম। তবে আমাকে খুব বেশি সময় ফিরতি ফোনের জন্যে অপেক্ষা করতে হয় নি। অল্প কিছুক্ষণ পরেই আবার অপারেটর আমাকে ফোন করল। বলল- "আপনার ঐ ঠিকানায় থাকা নম্বরটিতে আমি ফোনে কথা বলেছি। আপনার ঘটনা শুনে একজন ভদ্রমহিলা আপনার সাথে যোগাযোগ করতে সম্মত হয়েছেন।" এরপর অপারেটর আমাকে একটি নাম্বার দিয়ে ফোন রাখলেন।

অপারেটর থেকে পাওয়া নম্বরটিতে রিং করতেই ওপাশ থেকে একজন মহিলা ফোনটি রিসিভ করল। আমি খুব বিনীত ভাবে তাকে জিজ্ঞাস করলাম তিনি হান্যাকে চিনেন কি না। হান্যার নামটি শুনে মহিলা খুব অবাক স্বরে বললেন- "ওহ! আমার স্বামী এই বাড়িটি যে পরিবারের কাছ থেকে কিনেছিলেন তাদের একটি মেয়ে ছিল হান্যা নামে। কিন্তু সে তো প্রায় ৩০ বছর আগেকার কথা!" 

আমি আবার মহিলাটিকে জিজ্ঞাস করলাম- "আপনি কি জানেন ঐ পরিবারটি এখন কোথায় আছে?"

"ওভাবে তো জানা নেই, তবে শুনেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে এখানকার এক নার্সিং হোমে হান্যার মা'কে ভর্তি করাতে হয়েছিল", জবাবে বললেন মহিলা। "আশা করি ঐ নার্সিং হোমে খোঁজ নিলে তুমি হান্যার খোঁজ বের করতে পারবে।"

তিনি আমাকে ঐ নার্সিং হোমের নাম বললেন। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রাখলাম আমি। এরপর ফোন ডিরেক্টরি ঘেঁটে ঐ নার্সিং হোমের ফোন নম্বরটি বের করে ফোন লাগালাম সেখানে। রিসিপশন থেকে আমার ফোনটি রিসিভ করল। রিসিপসনিষ্টকে হান্যার মা'য়ের বর্ণনা দিয়ে জানতে চাইলাম তার সম্বন্ধে। রিসিপশন একটু সময় নিয়ে পুরানো আর্কাইভ ঘেঁটে জানাল- বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা সেটি, আর একই সাথে সে দুঃখও প্রকাশ করলেন। জানালেন এখানে আনার কিছুদিন পরই মহিলাটি মারা যায়। তবে তাদের কাছে একটি ফোন নম্বর আছে ঐ মহিলার এক স্বজনের। আরও জানালেন তাদের কাছে থাকা ঐ ফোন নম্বরটি সম্ভবত তার মেয়ের।

রিসিপশনিস্টের কাছ থেকে নম্বরটি নিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রাখলাম। আবার ফোন লাগালাম নতুন নম্বরটিতে। সেখানেও এক মহিলা আমার ফোনটি রিসিভ করলেন। তার কাছে হান্যার খোঁজ করলে তিনি জানালেন, হান্যা নিজেও এখন একটি নার্সিং হোমে রয়েছে। 

এতদূর এসে পুরো ব্যাপারটিকেই এখন আমার বোকামি মনে হচ্ছিল। মনে মনে ভাবছিলাম, কেন এই ছোট একটা ব্যাপার নিয়ে আমি এভাবে মেতে আছি?! এমন নয় যে ওয়ালেটটিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে কিংবা অনেক টাকা আছে ওয়ালেটটিতে। মাত্র তিনটা ডলার, আর আছে ৬০ বছর পুরনো একটি চিঠি। হয়তো ওয়ালেটের মালিকের কাছেও চিঠিটি এখন মূল্যহীন। আর আমি যেভাবে ব্যাপারটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করছি তা কি এখন যথেষ্ট হাস্যকর হয়ে উঠে নি?

কিন্তু এত ভাবনার পরেও আমি আবার নার্সিং হোমে ফোন করলাম, যেখানে এখন হান্যা অবস্থান করছে। এবারেও যথারীতি রিসিপশন থেকে ফোন রিসিভ হল। তাকে হান্যার সম্বন্ধে জিজ্ঞাস করলে তিনি জানালেন- "হ্যাঁ, আমাদের এখানে হান্যা অবস্থান করছে।"

ফোন ধরে রেখেই ঘড়ির দিকে তাকালাম। সময় যেন এর মাঝে উড়ে চলে গেছে। রাতের ১০টা বাজতে আর কিছু সময় বাকি। কারও সাথে দেখা করবার জন্যে এটা মোটেই ভালো সময় নয়। তারপরও আমি রিসিপশনে থাকা ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞাস করলাম আমি আজ হান্যার সাথে দেখা করতে পারবো কি না। লোকটি একটু ভেবে বললেন- "যদিও ব্যাপারটির অনুমতি নেই, তারপরও আপনি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। তবে হান্যা যদি এর মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে আর আপনাকে আমি কোন সহায়তা করতে পারবো না।"

অনিশ্চিত সুযোগ পেয়েও আমার বেশ আনন্দ লাগছিল এই ভেবে যে, অবশেষে আমি হান্যাকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছি। আমি খুব দ্রুত নার্সিং হোমটিতে পৌঁছলাম। তখন সময় ১০টা পার হয়ে একটু বেশি। রিসিপশনে পৌছলে রিসিপশনিস্টের সাথে দেখা হল। পরিচয় দিতেই লোকটি আমাকে চিনতে পারলেন, একটু আগে তার সাথেই কথা হয়েছিল আমার। জানালেন হান্যা 'ডে রুমটিতে' এখনো টিভি দেখায় ব্যস্ত। তিনি নিজেই আমাকে হান্যার সাথে দেখা করাতে ডে রুমটিতে নিয়ে গেলেন এবং হান্যার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

রুপালি চুলের মায়াভর্তি চেহারার এক বৃদ্ধা বসে ছিলেন সেখানে। উষ্ণ হাসি উপহার দিয়ে তিনি আমাকে জিজ্ঞাস করলেন এভাবে হন্ত-দন্ত হয়ে এত রাতে কি প্রয়োজনে এসেছি আমি। হান্যাকে আমি একদম শুরু থেকে সব বিস্তারিত বললাম। কিভাবে ওয়ালেটটি পেয়েছি, তারপর ওটা থেকে চিঠিটি পেয়ে কিভাবে হান্যার খোঁজ বের করেছি তার সবই তাকে জানালাম। এরপর পকেট থেকে চিঠিটি বের করে তার হাতে দিলাম। অবিশ্বাসী চোখে কাঁপা-কাঁপা হাতে তিনি চিঠির ভাজ খুললেন। চিঠির কোনায় থাকা ঐ ফুলটি দেখেই তিনি এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর ধীর-কণ্ঠে বললেন- "তুমি কি জানো? এই চিঠিটিই ছিল মাইকেলের সাথে আমার শেষ যোগাযোগ!"

এর বেশ কিছু সময়ের জন্যে আরেকদিকে ফিরে চুপচাপ বসে রইলেন। হঠাত এসে তার ক্ষত-স্মৃতি মনে করিয়ে দেবার জন্যে নিজেকে খুব বড় দোষী মনে হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর হান্যা আমার দিকে ফিরে বললেন- "আমি তাকে প্রচণ্ড ভালবাসতাম। কিন্তু তখন সবে মাত্র আবার বয়স ১৪, আর এসব জানতে পেরে মা খুব চটেছিলেন আমার উপর। বলেছিলেন আমি নাকি এসবের জন্যে তখনও বেশ ছোট। কিন্তু মাইকেল! তার মত হ্যান্ডসাম ছেলে এ জীবনে খুব কমই দেখেছি আমি। অবিকল যেন সেন কনারি ছিল সে!"

তার কথার প্রতিধ্বনি তুলেই যেন বললাম- "সেন কনারি! অভিনেতা?"

'হ্যাঁ', বললেন হান্যা."মাইকেল ছিল চমৎকার ব্যক্তিত্বের একজন। তুমি যদি তার খোঁজ বের করতে পারো তবে তাকে জানাবে, আমি এখনো প্রায়ই তাকে নিয়ে ভাবি। আর..."। বলে থামলেন তিনি; দেখে বোঝাই যাচ্ছিল কথাটা বলতে বলতে তার দারুণ সংকোচ হচ্ছে। ঠোট কামড়ে যেন নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। বললেন- "...আর বলো, তাকে এখনো আমি ভালোবাসি, ঠিক যেমনটি আগে বাসতাম"। বলতে বলতেই চোখ থেকে তার অশ্রুফোটা গাল গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। কিন্তু ঠোটের কোনে হাসির রেখা টেনে বললেন- "আমি কখনো বিয়ের কথা ভাবতে পারি নি, জানো? সম্ভবত মনের গহীনে যে মাইকেল লুকিয়ে ছিল, তার সমকক্ষ আর কাউকে ভাবতে পারিনি বলেই..."

বুঝলাম, হান্যাকে তো বের করতে পারলাম ঠিকই, কিন্তু তার মনের উঠানে উঠিয়ে দিয়ে গেলাম একরাশ বেদনা মিশ্রিত ঝড়ো বাতাস। মাইকেলের খোঁজ আর পাওয়া হল না। এতকিছু করেই বা কি করতে পারলাম তবে? 

হান্যাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম তার কাছ থেকে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলাম নিচে। নার্সিং হোম থেকে বের হবার সময় দারোয়ান আমাকে জিজ্ঞাস করল- "যার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন তার দেখা মিলল তবে?"

হেসে বললাম- "হ্যাঁ, মিলেছে।" এও জানালাম কেন দেখা করতে এসেছিলাম আমি। লাভের মাঝে একটা লাভ বলতে আমি এখন মাইকেলের শেষ নামটুকুও জানি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এর বেশি এগিয়ে যাওয়াটা আমার জন্যে আর সমীচীন হবে না। কথা বলতে বলতে কুড়িয়ে পাওয়া ওয়ালেটটাও পকেট থেকে বের করে এনেছিলাম। 

দারোয়ান যখন আমার হাতের দিকে নজর দিল তখন আমার হাতে ধরা ওয়ালেটটি দেখে বলল- "এই দাড়াও! এটাই কি সেই কুড়িয়ে পাওয়া ওয়ালেট, যার মালিককে তুমি খুঁজছ?" একটু অবাক হলেও বললাম- "হ্যাঁ, এটিই সেই ওয়ালেট।" জবাবে দারোয়ান বলল- "আমি নিশ্চিত করেই জানি এটা মি. গোল্ডস্টাইনের ওয়ালেট! আমি এটাকে যে কোন অবস্থাতেই দেখে চিনতে পারবো। দেখো ঐ যে, এর ভেতর দিকে লাল সুতোর কাজটা, ওটা কেবল মি. গোল্ডস্টাইনের ওয়ালেটেই আমি দেখেছিলাম। আর সেও ক'দিন পরপর এই ওয়ালেটটা এখানে সেখানে হারিয়ে ফেলে। এই তো, এ সপ্তাতেই তো তিনবার করে হারাল ওটা! কিন্তু তার ভাগ্য ভালো বলতে হবে, প্রতিবারই তার হাতেই ফিরে এসেছে ওয়ালেটটি।"

এবারে অবাক হবার পালা আমার। বিস্ময় নিয়েই জিজ্ঞাস করলাম- "কে এই মি. গোল্ডস্টাইন?" 

দারোয়ান বলল- এই নার্সিং হোমেরই আট তলায় থাকেন তিনি। বেশ অনেক বছর ধরেই এখানে তিনি, মোটামুটি এখানে সবাই তাকে চেনে। আজ বিকেলেই তিনি একটু বাইরে বের হয়েছিলেন। এখন বুঝেছি আপনি কিভাবে পেলেন এই ওয়ালেটটি।

আনন্দের অতিসায্যে কোনরকম গার্ডকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি আবার ছুটলাম সিড়িমুখে। লিফটের জন্যে অপেক্ষা করার তর সইছিল না। সিঁড়ি ভেঙ্গে যেন উড়ে উঠলাম আট তলায়। মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলাম যেন আজ একটু দেরিতে ঘুমুতে যায় মি. গোল্ডস্টাইন। আট তলায় এক নার্সের দেখা পাওয়া মাত্রই তাকে জিজ্ঞাস করলাম- "মি. গোল্ডস্টাইনকে কোথায় পাওয়া যাবে?" অবাক হলেও নার্স বলল- "গোল্ডস্টাইন স্যার তো প্রায়ই রাত জেগে লাইব্রেরিতে পড়ালেখা করে সময় কাটান। সম্ভবত এখনো সেখানেই আছেন তিনি।"

এরপর নার্স আমাকে তার সাথে করে লাইব্রেরির দিকে নিয়ে চললেন। এর মাঝেই তাকে আমি সংক্ষিপ্ত করে বললাম কেন আমি মি. গোল্ডস্টাইনের খোঁজ করছি। লাইব্রেরিতে পৌঁছে দেখলাম প্রায় সবগুলো লাইটই বন্ধ, শুধু এক কোনায় একজন ঠোটে হাসি নিয়ে কোলে রাখা একটি বইয়ের ভিতর ডুবে আছেন। সন্দেহ রইলো না, ইনিই মি. গোল্ডস্টাইন। নার্স একটু এগিয়ে গিয়ে মি. গোল্ডস্টাইনের কাছে কোমল স্বরে জানতে চাইলেন- "স্যার, আপনি কি আজও আপনার ওয়ালেটটি হারিয়েছেন?" 

নার্সের প্রশ্ন শুনে মি. গোল্ডস্টাইন তার পেছনের পকেটে হাতড়াতে শুরু করলেন, তারপর লাজুক হেসে বললেন- "ওহ! আবারও হারিয়েছি ওটা!"

"এই ভদ্রলোক একটি ওয়ালেট খুঁজে পেয়েছেন, আর আমাদের মনে হচ্ছে এটিই আপনার ওয়ালেট" -বললেন নার্স।

আমি এগিয়ে গিয়ে মি. গোল্ডস্টাইনের হাতে ওয়ালেটটি দিলাম। ওয়ালেটটি হাতে পেয়েই তৃপ্তির হাসি চলে আসল তার ঠোটে। বললেন- "হ্যাঁ, এটিই সেই ওয়ালেট! সম্ভবত আজ বিকেলে যখন বাইরে বের হয়েছিলাম তখন এটি কোনভাবে আমার পকেট গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল।" তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- "ইয়ং ম্যান, এর জন্যে তুমি পুরস্কার পাবে!"

"না স্যার, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ" দ্রুত বললাম তাকে। "কিন্তু, আপনাকে খুঁজে বের করতে গিয়ে আপনার ওয়ালেটটির ভিতরে আমাকে দেখতে হয়েছে। আর সেখানে থাকা আপনার চিঠিটিও পড়তে হয়েছিল আমাকে।"

একথা শুনে তার মুখের হাসি হুট করেই গায়েব হয়ে গেলো, সেখানে ভর করল বিষাদ। বিড়বিড় করে জিজ্ঞাস করলেন- "তুমি পড়েছ ঐ চিঠিটা!"

"শুধু তাই না", দুষ্ট একটা হাসি এনে বললাম "আমি এও জানি এখন হান্যা কোথায় আছে।"

হঠাৎই যেন তিনি ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন। "হান্যা! তুমি জানো সে কোথায় আছে? কেমন আছে সে? সে কি এখনো আগের মত সেই অনিন্দ্য সুন্দরী রয়েছে? প্লিজ, প্লিজ বল আমাকে...", মরিয়া হয়ে জানতে চাইলেন তিনি। 

"সে ভালো আছে.... ঠিক যেমনটি আপনি কল্পনা করছেন, ঠিক তেমনি সুন্দর আছে সে", মৃদু স্বরে বললাম তাকে।

প্রত্যাশা পূর্ণের হাসি মুখে মি. গোল্ডস্টাইন জানতে চাইলেন- "তুমি কি আমায় বলতে পারবে সে কোথায় আছে? আমি তার সাথে একটাবারের জন্যে একটু কথা বলতে চাই"। বলতে বলতেই তিনি হুট করে আমার হাতটি চেপে ধরলেন, বললেন- "তুমি কি জানো? তাকে আমি প্রচণ্ড পরিমাণে ভালবাসতাম, কিন্তু তার এই চিঠিটা যখন হাতে এসে পৌছায় তখন মনে হল আমার জীবনটাই শেষ হয়ে গেছে। আমি আর কাউকে তার মত করে গ্রহণ করতে পারি নি, হয়তো তার প্রতি আমার ভালোবাসাটাই কখনো কাউকে আর আপন করে ভাবতে দেয়নি আমায়।"

"মি. গোল্ডস্টাইন," বললাম আমি, "আপনি কি আমার সাথে একটু আসতে পারবেন?"

আমরা লিফটে চড়ে উঠলাম, লিফট আট তলা থেকে তিন তলাতে নেমে আসল। হলওয়ের প্রায় পুরোটাই তখন অন্ধকার, হালকা আলোর কয়েকটি লাইট তখন জ্বলছে সেখানে। হান্যাকে আমরা পেলাম সেই ডে রুমটিতেই। অসাড় ভঙ্গিতে তিনি তখনও টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। 

আমাদের সাথে থাকা নার্স তখন হান্যার দিকে এগিয়ে গেলো, মৃদু স্বরে বলল- "হান্যা", তারপর দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকা মাইকেলের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বলল, "তুমি কি ঐ লোকটিকে চিনতে পারছ?"

হান্যা তার গলায় ঝুলে থাকা গ্লাসটি একটু পরিষ্কার করে চোখে পড়ল, তারপর একমুহুর্ত সময় নিয়ে তাকাল মাইকেলের দিকে, কিন্তু একটি কথাও বলল না। একটু সময় পর একদম শোনা যায় না এমন ক্ষীণস্বরে মাইকেল বলল, "হান্যা, আমি মাইকেল, আমার কথা কি তোমার মনে আছে?"

হান্যা ফুঁপিয়ে উঠল, "মাইকেল! আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না! মাইকেল! এটা কি সত্যিই তুমি? সত্যিই কি তুমি আমার মাইকেল?"। এভাবেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে উঠে এগিয়ে যেতে থাকল সামনের দিকে। এত যুগ পরেও যেন একজন আরেকজনকে চোখের সামনে পেয়েও বিশ্বাস করতে পারছিলো না। নার্স আর আমি তাদের ওভাবে রেখেই ডে রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। বলতে লজ্জা নেই, আমাদের উভয়ের চোখই তখন ভিজে ছিল এক অপার্থিব আনন্দে। হলওয়েতে এসে নার্স আস্তে করে বলল, "দেখলে! কিভাবে সৃষ্টিকর্তার আশ্চর্য বলয় আমাদের জড়িয়ে রাখে? যদি কিছু একটা তোমার হবার থাকে, তবে তা হবেই; হাজার প্রতীক্ষার পর হলেও তোমার পাওনা তোমায় সে মিটিয়েই দেবে!"


এরপর প্রায় তিন হপ্তা বাদে এক ব্যস্ত দুপুরে অফিসে আমার জন্যে একটি কল আসল ঐ নার্সিং হোম থেকে। সেদিনের সেই রিসিপসনিষ্ট আমাকে বলল- "তুমি কি সামনের রবিবার একটু সময় করে আমাদের এখানে আসতে পারবে? ঐ দিন মাইকেল আর হান্যা তাদের ঐ দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটাতে যাচ্ছে!" এমন প্রস্তাবের বিপরীতে না বলার কোন ইচ্ছেই আমার ছিল না, সময় নষ্ট না করে সাথে সাথে নিমন্ত্রণটি গ্রহণ করে নিলাম।


আমার জীবনে যে অল্প ক'টা চমৎকার দিনের কথা আমি বলতে পারব, তার মধ্যে ঐ রবিবারটি ছিল অন্যতম। নার্সিং হোমটিতে পৌঁছে আমার মনেই হয়নি আমি কোন নার্সিং হোমে এসেছি। তখন সেখানে সবদিকেই একটা উৎসব উৎসব আমেজ। হলঘর জুড়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কিন্তু যে কেউ তাদের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবে কতটা আনন্দ নিয়ে তারা এই সময়টাকে উপভোগ করছেন।

হান্যা হালকা কিন্তু উজ্জ্বল রঙ এর একটি বিয়ের ড্রেস পড়েছিল সেদিন, আর আমি বাজি ধরে বলতে পারি এরচেয়ে সুন্দর তাকে কখনোই লাগেনি। মাইকেল পড়েছিল একটি গাড় নীল সুট আর লম্বা একটি হ্যাট, তাকে দেখতে সত্যিই সেদিন দারুন হ্যান্ডসাম লাগছিল। তারা তাদের বিয়েতে আমাকে তাদের 'বেস্ট ম্যান' বানিয়েছিলেন।

নার্সিং হোম থেকে শুধুমাত্র তাদের জন্যে একটি আলাদা রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেদিন আমি দেখেছিলাম ৭৬ বছরের এক কণে আর ৭৯ বছরের এক বরকে টিনেজারদের মত উচ্ছ্বাসে মেতে উঠতে। 

বয়সটা আসলেই তাদের জন্যে কোন বিষয় ছিল না সব শেষে!






………………………………………………………
গল্পঃ হারানো ওয়ালেট
লেখকঃ অজ্ঞাত
সোর্সঃ "Stories of life" via pinterest.com


মঙ্গলবার, জুলাই ২৫, ২০১৭

অনুবাদ গল্পঃ বিস্ময়কর সাত



ছোট্ট এক গ্রামের ৯ বছর বয়সী এক মেয়ে 'অ্যানা'। গ্রামের এক স্কুল থেকেই সে ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেছে। এরপর আরও উন্নত শিক্ষার জন্যে শহুরে ভালো স্কুল গুলির ৫ম শ্রেণীতে ভর্তি হবার আবেদন করল, আর তার ভালো ফলাফল এবং মেধার ভিত্তিতে শহরের এক নামকরা স্কুলে সে ভর্তি হবার সুযোগও পেয়ে গেলো। নতুন স্কুলে আজ তার প্রথম ক্লাস, সে রাস্তার ধারে স্কুল বাসের জন্যে অপেক্ষা করছিল। স্কুল বাস পৌঁছোবার সাথে সাথেই সে খুব দ্রুত তাতে উঠে পড়ল। আজকের দিনের তার উচ্ছ্বাসটি ছিল দেখবার মত!

বাসটি স্কুল চত্বরে পৌঁছোবার সাথে সাথেই ছাত্র-ছাত্রীরা যার যার ক্লাসের উদ্দেশ্যে ছুট লাগাল। বাকি সকলের মত অ্যানাও কয়েকজনকে জিজ্ঞাস করে তার ক্লাস রুমের অবস্থান জেনে ক্লাসের দিকে চলে গেলো। ক্লাসে পৌঁছোবার পর তার সাদাসিধা গ্রাম্য পোশাক আর ভেষভুষা দেখে ক্লাসের শহুরে ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে নিয়ে উপহাস করা শুরু করল, তাদের সেই উপহাসের মাত্রা আরও বেড়ে গেল যখন তারা জানতে পারল অ্যানা সত্যি সত্যি গ্রাম থেকেই এখানে ক্লাস করতে এসেছে। ক্লাসের সময় হবার সাথে সাথেই ক্লাসে শিক্ষিকা চলে আসলেন এবং সবাইকে শান্ত হয়ে নিজ নিজ ডেস্কে বসতে বললেন। এরপর তিনি অ্যানাকে ডেকে এনে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, বললেন আজ থেকে অ্যানাও আমাদের সাথে নিয়মিত ক্লাস করবে। 

পরিচয়পর্ব শেষে শিক্ষিকা তার ছাত্র-ছাত্রীদের বললেন, এখন তোমরা দ্রুত তোমাদের ক্লাস টেস্টের জন্যে প্রস্তুত হয়ে নাও! তিনি সবাইকে পৃথিবীর সেটা ৭টি আশ্চর্যের কথা লিখতে বললেন। প্রশ্ন শুনে সকলেই খুব দ্রুত নিজ নিজ খাতায় ৭টি আশ্চর্যের নাম লিখতে শুরু করল। অ্যানা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে শেষে সেও নিজের খাতাটি বের করে ধীরে ধীরে প্রশ্নের উত্তর লিখতে শুরু করল।

যখন অ্যানা বাদে প্রায় সবাই নিজ নিজ উত্তর শিক্ষিকাকে দেখানোর জন্যে জমা দিল তখনও অ্যানা নিজের খাতায় মুখ গুজে লিখতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই দেখে শিক্ষিকা এগিয়ে গিয়ে অ্যানাকে জিজ্ঞাস করলেন- "কি ব্যাপার অ্যানা, তুমি কি প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে গেছো? ঘাবড়াবার কিছু নেই, এই অল্প ক'দিন আগেই আমরা পৃথিবীর আশ্চর্য গুলি শিখেছি। তোমার কি এই প্রশ্নটির উত্তর জানা নেই?"

উত্তরে অ্যানা বলল- " আসলে ম্যাম, আমি ভাবছিলাম পৃথিবীতে তো অসংখ্য আশ্চর্য ছড়িয়ে আছে, লিখার জন্যে আমি আসলে কোন ৭টি আশ্চর্যকে বেছে নেব তা নিয়েই ভাবছিলাম" এবং তারপর অ্যানা তার খাতাটি শিক্ষিকার দিকে বাড়িয়ে দিল।  

শিক্ষিকা অ্যানার খাতাটি নিয়ে তার ডেস্কে চলে গেলেন, এরপর একে একে সবার খাতা দেখতে শুরু করলেন। ক্লাসের প্রায় সবাই পৃথিবীর ৭টি আশ্চর্য হিসেবে চীনের মহাপ্রাচীর, চিচেন ইতজা, স্ট্যাচু অব ক্রাইট দ্য রিডিমার, মাচুপিছু, পেত্রা নগরী, রোমের কল'সীয়াম, তাজমহল সহ আরও নানা স্থানের নাম লিখেছিল। শিক্ষিকা খুবই খুশি হলেন, কারণ তার শিক্ষার্থীরা প্রায় সকলেই সঠিক উত্তরটি লিখতে পেরেছে। সবশেষে শিক্ষিকা অ্যানার উত্তরটি পড়তে শুরু করলেন।

অ্যানা তার খাতায় ৭টি আশ্চর্য হিসেবে লিখেছে- "দেখতে পারা, শুনতে পারা, অনুভব করতে পারা, হাসতে পারা, ভাবতে পারা, দয়া দেখাতে পরা, ভালবাসতে পারা!"

অ্যানার উত্তরটি পড়ে শিক্ষিকা একদম স্থিরভাবে খাতা হাতে দাড়িয়ে রইলেন, আর ক্লাস একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলো। এরপর শিক্ষিকা শান্তকণ্ঠে বললেন- আজকে, গ্রামের একটি ছোট্ট মেয়ে আমাদের মনে করিয়ে দিল ঐ সব মহামূল্যবান উপহারের কথা যা না চাইতেও আমরা ঈশ্বর থেকে পেয়েছি; যার প্রতিটিই এক একটি সত্যিকারের আশ্চর্য! আশা করি তোমরাও তোমাদের এই মূল্যবান উপহার গুলির যথাযথ মূল্যায়ন করতে শিখবে আমাদের ছোট্ট বন্ধু অ্যানার মত করে।

এরপর গ্রামের ঐ পিছিয়ে পড়া মেয়েটিই হয়ে উঠল তাদের আরেক আদর্শ। 






⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎  নীতিনিষ্ঠ মূল্যায়ন  ⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎

আমাদের সকলেরই উচিৎ ঐ সব জিনিষ গুলোর মূল্যায়ন করা, যা আমাদের আছে, যা আমরা ব্যবহার করতে পারি, যার উপর আমরা আস্থা রাখতে পারি। অনুপ্রেরণার জন্যে সবসময় নতুন কিছুর খোঁজ করার প্রয়োজন নেই। বরং ঈশ্বর আমাদের ঐ সবই দিয়ে পাঠিয়েছেন, যা আমাদের একান্ত প্রয়োজন।










……………………………………………

মূল লেখকঃ অজ্ঞাত
সোর্সঃ "Moral Stories" via pinterest.com


বুধবার, ডিসেম্বর ০৭, ২০১৬

অনুবাদ গল্পঃ আনন্দ আর দুঃখবোধ



          চমৎকার এক বাগান বাড়ির মালিক ছিলেন এক লোক। রুচি আর সাধ্যের সংমিশ্রণে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন তার সাধের বাড়িটিকে। শুধুমাত্র চমৎকার উপমা দিলে হয়তো বাড়িটির প্রশংসায় ভাটা পড়বে, তাই বাড়িটির সৌন্দর্যের সম্মানার্থে একে অপূর্ব আলয় বলা যেতে পারে।

গ্রামের অনেকেই ঐ বাগান বাড়িটি মালিকানায় পাবার জন্যে বেশ আগ্রহী ছিল। শুধু যে ঐ গ্রামের লোকেরাই আগ্রহী ছিল তাও নয়, বরং আগ্রহীদের তালিকায় ছিল দূর দূরান্তের অনেক নামী-দামী আর প্রভাবশালী লোকেরাও। কিন্তু বাড়ির মালিক বাড়িটিকে এত ভালোবাসতেন যে সকল আগ্রহীদের সব ধরণের প্রস্তাব সে বারংবারই নাকচ করে আসছিলেন অনেক লম্বা সময় ধরে।

একবার এক বিশেষ কাজে তাকে দিন কয়েকের জন্যে যেতে হল শহরে। শহরের কাজ শেষে দিন কয়েক বাদে ফিরছিলেন নিজ নিবাসে। পথিমধ্যে শুনতে পেলেন তার শখের বাগান বাড়িটিতে কিভাবে যেন আগুন লেগে গেছে। আর সে খবর শুনে সকলকেই ছুটতে দেখলেন সেদিকে। সখের বাড়িটিতে আগুন লাগবার খবর শোনামাত্র লোকটি যেন উড়ে চলল বাড়ির দিকে।

বাগান বাড়ির কাছাকাছি পৌছে দেখলেন শ'য়ে শ'য়ে লোক ভীর করেছে বাড়িটিকে ঘেরাও করে। কিন্তু কারোই এখন আর কিছু করার নেই, আগুন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বাড়িময়। সত্যি বলতে সবই মিলে যদি এখন হাতও লাগায় তবুও বাড়িটিকে আর উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। সকলের চেষ্টার বিপরীতেও মিলবে পোড়া বাড়ি আর জ্বলে-পুড়ে ভস্ম হয়ে যাওয়া আসবাব পত্র। টুকরো কোন বস্তুই ঐ বাড়ি থেকে আর অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। আর সেটা বুঝতে পেরেই সকলে তাদের অহেতুক চেষ্টা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে।

জ্বলতে থাকা বাড়িটির দিকে নিঃস্বের মত তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই যেন করার থাকল না। বাকি সবার মত সেও দাড়িয়ে দাড়িয়ে তিলে তিলে গড়ে তোলা নিজের স্বপ্ন কুটিরটির পুড়ে যাওয়া দেখতে লাগলেন।

এরই মাঝে লোকটির বড় ছেলেকে দৌড়ে তার দিকে আসতে দেখলেন। দৌড়ে আসার কারণে ঠিক মত কথাও বলতে পারছিল না ছেলেটি। কোনরকমে বাবার কাছে পৌঁছে বলতে লাগল- "আব্বা, আপনি বাড়িটার জন্যে মোটেই মনে কোন কষ্ট নেবেন না। আপনি চলে যাবার পর এক ভদ্রলোক এসেছিলেন বাড়িটি কেনার জন্যে। অন্য সকলের তুলনায় প্রায় চার গুন দাম বলেছিলেন তিনি। এ বাজারে এত দাম দিয়ে অন্য কেউ বাড়িটিকে কেনার কথা চিন্তাও করবে না। তাই আর আপনার ফিরে আসার অপেক্ষা না করে ঝটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে বাড়িটি আমি তার কাছে বিক্রি করে দেই। আমি মনে করছিলাম ফিরে এসে আপনি এ কথা শুনে রাগ করলেও আমাকে আমার এমন সিদ্ধান্তের জন্যে ক্ষমা করবেন।"

বড় ছেলের এমন কথায় বাবা যেন আপন স্বস্তির নাগাল খুঁজে পেলেন। একটু চুপ থেকে বললেন, "খোদাকে ধন্যবাদ, তোমাকে এমন উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করার জন্যে!" স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আবারও তিনি বাড়িটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার সাধের বাড়িটি এখনো পুড়েই চলেছে।

অল্প কিছু সময় পরই দেখলেন তার মেঝ ছেলে আরেক দিক থেকে দৌড়ে আসছে তার দিকে। কাছে এসেই আক্ষেপ আর কর্তৃত্ব মিশ্রিত কণ্ঠে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল, "আব্বা, আপনি কি করছেন? বাড়িটি পুড়ে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে আর আপনি এখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছেন? আপনি না প্রায়ই বলেন যে এ বাড়িটিকে আপনি আমাদের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন; তাহলে এমন নির্বাক হয়ে কিভাবে আপনি বসে থাকছেন বলেন তো শুনি?"

বাবা যেন মেঝ ছেলের এমন কথায় কিছুটা কৌতুক খুঁজে পেয়েছেন এমন করে একটু হাসলেন। তারপর বললেন, "আরে বোকা, তুমি কি জানো না যে গতকালই তোমার বড় ভাই এই বাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছে?" বাবার উত্তর শুনে মেঝ ছেলে বলল, "সে ব্যাপারে জানি, কিন্তু বাড়িটি কিন্তু এখনো পুরোপুরি বিক্রি হয়ে যায় নি। বড় ভাই আপনার সিদ্ধান্ত নেবার জন্যে বাড়িটি ঐ ভদ্রলোকের কাছে বিক্রি করার আশ্বাস দিয়েছে মাত্র। আর বড় ভাইয়ের আশ্বাসের প্রতিরূপে লোকটি কেবল কিছু অগ্রিম টাকা দিয়ে বাড়িটির বিক্রয় চুক্তি নিশ্চিত করে রেখেছেন। বিক্রির পুরো টাকা এখনো আমাদের হাতে আসে নি! কিন্তু এখন তো এখানে ছাই ছাড়া আর কিছুই মিলবে না, ভদ্রলোক নিশ্চই কেবলমাত্র এই মূল্যহীন ছাই কেনবার জন্যে এতগুলি টাকা পরিশোধ করবেন না!"

যে কান্না শুরু হবার আগেই থেমে গিয়েছিল, এসব শোনার পর তা যেন জলোচ্ছ্বাসের রূপ নিলো। স্বস্তির সাথে হৃদয়টাও যেন টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল চারিদিকে। ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি; যতটা না বাড়িটিতে আগুন লাগবার শোকে, তারচেয়ে বেশি বাড়ি মূল্য আর আপন স্বস্তি খুইয়ে ফেলবার দুঃখে আর্তনাদ করে কাঁদতে লাগলেন। আশে পাশে লোকজনও যেন এবারে লোকটির এমন কান্না দেখে স্বস্তি খুঁজে পেল। কেউ কেউ দূর থেকেই সান্ত্বনা বাক্য ছুড়ে দেবার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কিন্তু এবারে যে আগুনের কারণে কান্নার সৃষ্টি তা আর সান্ত্বনা বাক্যে বন্ধ হবার নয়।

এরই মাঝে লোকজনের ভিড় ছেলে উদয় হল লোকটির ছোট ছেলে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "আব্বা, এভাবে কাঁদবেন না। আর বাড়িটির জন্যেও দুঃখ করবেন না। বাড়িটি সত্যিই আর আর আমাদের নয়"। ছোট ছেলে ছেলে সান্ত্বনা দিচ্ছে ভেবে লোকটি বললেন, "নারে বোকা! আমাদের বাড়িটিই পুড়ছে তোমার চোখের সামনে। আর পোড়া বাড়ি কখনোই বিক্রি হয় না। বাড়ির এমন দশা দেখে অগ্রিম টাকাও নিশ্চিত ফিরিয়ে নিতে আসবেন ঐ ভদ্রলোক।"

ফের ছোট ছেলে বলল, "আব্বা, আপনি ভুল বুঝছেন। আপনি এখনো আমার পুরো কথাটি শোনেন নি। বাড়িতে আগুন লাগবার ঘটনা শুনে ভদ্রলোক কিছুক্ষন পূর্বে আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন। তিনি তার দেয়া কথা রাখবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন আমায়। বলেছেন- 'আগুন লাগুক কিংবা না লাগুক ঐ বাড়ির মালিকানা কেবলই আমার, এবং আমি অবশ্যই চুক্তি অনুযায়ী বাড়ির ক্রয়মূল্য তোমাদের পরিশোধ করব। ভাগ্যের ব্যপারে কারও কোন হাত থাকে না, বরং তা ওপর-ওয়ালাই নির্ধারন করে দেন। আমি কিংবা তোমরা কেউই আগে থেকে জানতাম না ঐ বাড়ির ভাগ্যে কি রয়েছিল। যেহেতু চুক্তির পর বাড়িটি আগুনের স্পর্শ পেয়েছে, অতএব সে আগুনে পুড়ে যাওয়া বাড়ির মালিকানাও আমার ভাগেই পড়ে। তাই তোমরা ঐ দুর্ঘটনা নিয়ে মোটেও কোন চিন্তা করো না। আমি যথা-দ্রুত সম্ভব বাড়িটির মূল্য পরিশোধ করব'।"

কথা শুনে লোকটির জলোচ্ছ্বাস থামলেও অশ্রু যেন আর বাধে আটকে রাখা যাচ্ছিল না। অশ্রুসিক্ত নয়নেই বোকার মত দাড়িয়ে কেবল বাড়িটির পুড়ে যাওয়া দেখতে লাগল সকলে মিলে।





⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎  নীতিনিষ্ঠ মূল্যায়ন  ⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎

মনব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য নিরূপণ দারুণ এক জটিল কাজ। গল্পের বাগান বাড়ির মালিক যদিও তার সন্তানদের তুলনায় তার বাড়িটিকে অধিকতর ভালোবাসতেন, তবুও তিনি স্বস্তি খুঁজে পেয়েছিলেন এই জেনে যে বাড়িটির মালিকানার ভার এখন আর তার নেই। যদিও পূর্বে কোনভাবেই তিনি বাড়িটিকে বিক্রি করতে সম্মত ছিলেন না। কিন্তু যখন চোখের সামনে বাড়িটির সৌন্দর্য ধীরে ধীরে হারাতে লাগল, তখন তিনি ভালোবাসা আগলে রেখে কেবল বাড়ি বিক্রির অর্থের দিকে চেয়ে সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু পরমুহুর্তে যখন জানতে পারলেন বাড়ির সৌন্দর্য আর মূল্য দুটোই তিনি হারাচ্ছেন তখন আর নিজের দুঃখের লাগাম টেনে ধরতে পারেন নি, ভেঙ্গে পড়েছিলেন নিমিষেই। এরপর যখন আবারও ছোট ছেলের কাছ থেকে পরবর্তি ঘটনা জানলেন তখন দুঃখ, সান্ত্বনা এবং কৃতজ্ঞতা বোধ সবই তার উপর ভর করে ছিল।

গল্পের মতই মানুষের আনন্দ আর দুঃখবোধ সময় আর ঘটনা প্রবাহের সাথে পরিবর্তিত হয়। ভালোবাসার অধিকার অর্জন আর হারানোর অনুপাতের দাঁড়িপাল্লায় হিসেব করে প্রকাশ পায় এক এক জনের অনুভূতি। গুরুত্বের পানসি জোয়ার-ভাটার টানে ঘুরে বেড়ায়, এগিয়ে যায়, পিছিয়ে যায় কিংবা থেমে থাকে নিজের জায়গায় নোঙ্গর ফেলে। একই ঘটনা ঘটে আত্মীয়তা আর বন্ধুত্বের সম্পর্কে।

তাই কারও আচরণ দেখে বিচার করবার আগেই ভাবতে হবে তার আচরণের পেছনে ঘটে যাওয়া বা ঘটতে থাকা কারণ গুলো নিয়ে। বুঝতে হবে তার উচ্ছাস কিংবা নিস্তব্দতার কারণ। আর এরপরই কেবল একজন মানুষের আচরণের বিপরীতে তার প্রকৃত মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে।





মঙ্গলবার, নভেম্বর ২৯, ২০১৬

সোমবার, নভেম্বর ২৮, ২০১৬

কমিকঃ আপন আলয়ের ভিন্নরূপ








────────────────────────────
♦ কমিক : আপন আলয়ের ভিন্নরূপ | A Place Like Home
♦ সংগ্রহ : Stumbleupon.com Stream
♦ জঘন্য অনুবাদে : আমি 😛

রবিবার, জুলাই ২৪, ২০১৬

কমিকঃ নক্ষত্রজ্ঞানী




কমিকটি পিডিএফ হিসেবে ডাওনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন







────────────────────────────
♦ কমিক : নক্ষত্রজ্ঞানী | Stargazer
♦ সংগ্রহ : Stumbleupon.com Stream
♦ জঘন্য অনুবাদে : আমি :p

বুধবার, জুলাই ২০, ২০১৬

অনুবাদ গল্পঃ আত্মমূল্যায়ন



একবার এক যুবক এক জ্ঞানী সন্ন্যাসীর সাথে দেখা করতে গেল। সন্ন্যাসীর সাক্ষাত পেয়ে তাকে বলল-
'আমি আপনার পরামর্শের জন্যে এসেছি। এখন পর্যন্ত আমার অযোগ্যতার জন্যে আমি কোন কিছুই করতে পারি নি। পরিচিত, স্বল্প-পরিচিত আর স্বজনেরা আমার ব্যর্থতার জন্যে আমাকে ভৎর্সনা করে আর আমার বোকামির জন্যে আমাকে ঠাট্টার পাত্র বানিয়ে রেখেছে। আমার এই ব্যর্থ জীবনের নিয়ে আমি বড় কষ্টে রয়েছি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এ জীবনের মায়া ত্যাগ করতে। আপনি দয়া করে আমাকে একটু সাহায্য করুন। আমার ব্যর্থতাকে উৎরে যাবার উপায় বলে দিন।"

জ্ঞানী সন্ন্যাসী যুবকটিকে একটু ভালো করে দেখলেন, তারপর দ্রুত বললেন-
"আমাকে ক্ষমা কর, এই মুহূর্তে আমি এত ব্যস্ত সময় পার করছি যে তোমাকে কোনরূপ সহায়তা করার সুযোগ আমার নেই। আমাকে খুব জরুরী ভিত্তিতে কিছু কাজ করতে হবে..." এতটুকু বলে তিনি একটু থামলেন। তারপর এক মুহূর্ত চিন্তা করে আবার বললেন, "কিন্তু তুমি যদি আমাকে আমার কাজে একটু সহায়তা করতে রাজী থাকো তবে আমি খুব দ্রুতই তোমার সমস্যায় তোমাকে সাহায্য করতে পারব।"

"অবশ্যই...অবশ্যই আমি আপনার কাজে সহায়তা করতে পারব" দ্রুতই উত্তর দিল যুবকটি।

যুবকের কথা শুনে জ্ঞানী সন্ন্যাসী বললেন, 'ভালো'। তারপর তার আঙ্গুলে থাকা একটি পাথর খচিত আংটি খুলে নিয়ে যুবকের হাতে দিলেন। তারপর বললেন, "আমার কিছু ঋণ রয়েছে কারও কাছে, তাই আংটিটি বিক্রি করা খুবই জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুমি আমার ঘোড়াটি নিয়ে দ্রুত বাজারে যাও, আর আমার হয়ে আংটিটি বিক্রি করে আসো। তবে অবশ্যই তোমাকে আংটিটি একটু ভালো মূল্যে বিক্রি করার চেষ্টা করতে হবে। কোন অবস্থাতেই একটি স্বর্ণমুদ্রার কমে আংটিটি বিক্রি করো না, আর বিক্রি করে খুব দ্রুতই আমার কাছে ফিরে এসো।"

যুবকটি আংটিটি নিয়ে দৌড়ে ঘোড়ায় চড়ল এবং খুব দ্রুত স্থানীয় বাজারে গিয়ে পৌঁছল। সেখানে তখন অনেক বনিক ক্রেতাই দ্রব্যাদি ক্রয় বিক্রয়ে ব্যস্ত ছিল। যুবক আংটিটি নিয়ে ঐ বনিকদের নিকট গেল এবং তাদের সেটা দেখিয়ে বিক্রি করার চেষ্টা চালাতে লাগল। সকল বনিকই প্রথমে খুব আগ্রহ  নিয়ে আংটিটি দেখছিল, কেউ কেউ ক্রয় করার ইচ্ছেও প্রকাশ করছিল। কিন্তু যখনই যুবক তাদের বলল অন্তত একটি স্বর্ণমুদ্রা না হলে সে আংটিটি বিক্রি করবে না, তখনই তাদের সব আগ্রহ উবে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত এক বুড়ো বনিক যুবকটিকে ডেকে বুঝিয়ে বলল যে, এটি অত্যন্ত নিম্নমানের ধাতুর তৈরি আংটি আর আংটিতে থাকা পাথরটিও অনেক পুরানো। কোন বনিকই আংটিটি স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে ক্রয় করতে রাজী হবে না। আর এই আংটির জন্যে একটি স্বর্ণমুদ্রা অনেক অনেক বেশি। তবে বৃদ্ধ বনিক বলল, যুবক যদি রাজী থাকে তবে তিনি কিছু তাম্র-মুদ্রা কিংবা অল্প কিছু রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে আংটিটি ক্রয় করতে ইচ্ছুক।

বৃদ্ধ বনিকের এমন কথা শুনে যুবক আবারও হতাশ হয়ে পড়ল। যেহেতু জ্ঞানী সন্ন্যাসী তাকে এক স্বর্ণমুদ্রার কমে আংটিটি বিক্রয় করতে মানা করেছে তাই সে ভদ্রভাবে বৃদ্ধ বনিককে ব্যাপারটি জানিয়ে বিক্রি করতে পারবে না বলে জানাল। ইতোমধ্যে বাজারের প্রায় সকল বনিকের কাছে আংটিটি দেখানো সম্পন্ন হয়ে গেছে। বৃদ্ধ বনিক ব্যতীত আর কেউই আংটিটি ক্রয় করতে চায় নি। স্বর্ণমুদ্রা ব্যতীত আংটি বিক্রি করতে ব্যর্থ হয়ে যুবক আবারও নিজের ভাগ্যকে মনে মনে গালমন্দ করতে লাগল। ঘোড়া চড়ে ফিরে চলল জ্ঞানী সন্ন্যাসীর কাছে।

"জনাব, আমি আপনার কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছি", জ্ঞানী সন্ন্যাসীর কাছে ফিরে এসে যুবকটি বলল। আরও বলল, 'বাজারে যারাই আংটিটি ক্রয় করতে চেয়েছিল তাদের সকলেই কিছু তাম্র কিংবা রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে তা ক্রয় করতে চেয়েছে, কিন্তু আপনি আমাকে অন্তত এক স্বর্ণমুদ্রার কমে তা বিক্রি করতে মানা করায় আমি আংটিটি বিক্রি করতে পারিনি। শেষে এক বনিক আমাকে বললেন স্বর্ণমুদ্রার তুলনায় আংটিটি প্রায় মূল্যহীন, তাই কেউ কিনতে রাজী হবে না। এ কারণেই আমি ব্যর্থ হয়ে আপনার কাছে ফিরে এসেছি।'

সব কথা শুনে জ্ঞানী সন্ন্যাসী বলল,
'তুমি যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে এসেছ, তা কি তুমি জানো?
আংটিটি বিক্রি করার আগে তার প্রকৃত মূল্য সম্বন্ধে জানা খুব জরুরী, আর তা যদি তোমার জানা না থাকে তবে তুমি কখনোই সঠিক মূল্যে আংটিটি বিক্রি করতে পারবে না। আর এমন একটি আংটির মূল্য নিশ্চই তুমি শুধুমাত্র বাজারের বনিকের কথায় নির্ধারণ করবে না!
এক কাজ কর, তুমি বরং আংটিটি একজন জহুরির কাছে নিয়ে যাও। তার কাছ থেকে এর প্রকৃত দাম জেনে আসো। তবে এইবারে তুমি তার কাছে আংটিটি এবারে বিক্রি করো না, শুধু আংটিটির প্রকৃত দাম জেনেই আমার কাছে ফিরে আসবে।"

জ্ঞানী সন্ন্যাসীর কথা শুনে যুবক আবারও দ্রুততার সাথে ঘোড়া ছুটাল জহুরির সন্ধানে। পরে এক জহুরির কাছে গিয়ে আংটিটি পরীক্ষা করতে দিল। জহুরি অনেক লম্বা সময় ধরে আতশি কাঁচের নিচে রেখে আংটিটি নিরীক্ষণ করলেন। তারপর খুব সাবধানে আংটিটি একটি তুলাদণ্ডে রেখে ওজন পরিমাপ করলেন। সবশেষে যুবকের নিকট আংটিটি ফেরত দিয়ে বললেনঃ

"তুমি আংটির মালিককে গিয়ে বল তিনি যদি এখনই জরুরী ভিত্তিতে আংটিটি বিক্রি করতে চান তবে আমি তাকে এখন সর্বাধিক ৫৮টি স্বর্ণমুদ্রা দিতে পারব। কিন্তু তিনি যদি আমাকে কিছু সময় দিতে রাজী হন, তবে আমার বিশ্বাস এই আংটিটি আমি অন্তত ৯০ টি স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে বিক্রি করে দিতে পারব।"

"৯০ স্বর্ণমুদ্রা!" , বিস্ময় নিয়ে যুবকটি চিৎকার দিল!
তারপর আনন্দে হেসে জহুরিকে ধন্যবাদ দিয়ে সেখান থেকে বের হল এবং দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে জ্ঞানী সন্ন্যাসীর কাছে ছুটল।

যুবক যখন ফিরে এসে জ্ঞানী সন্ন্যাসীকে জহুরির বলা কথাগুলো জানাল তখন সন্ন্যাসী তাকে বলল,
"ছেলে, মনে রেখো, তুমিও এই আংটিটির মত বহু-মূল্যবান এবং অনন্য একজন! বাজারের বোকা বনিকদের মত তুমিও যদি তোমার পরিচিত, অপরিচিত আর আত্মীয়দের কথায় নিজেকে মূল্যায়ন কর আর এভাবে ভেঙ্গে যাও তবে কখনোই নিজের প্রকৃত মূল্য আবিষ্কার করতে পারবে না। তারচেয়ে বড় তোমার মেধা, তোমার বুদ্ধি আর তোমার যোগ্যতাকে আরও নিবিষ্ট ভাবে কাজে লাগাও। আর তা যদি করতে পারো তবে জহুরির মত বিজ্ঞ লোকই তোমার মূল্য বুঝতে পারবে। তাদের কাছেই তোমার নিজের প্রকৃত মূল্যায়ন তুমি বুঝে পাবে।"