অনুগল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
অনুগল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ০৩, ২০১৬

আত্মহত্যার প্রভাবন



কথায় মানুষ খুব দ্রুত প্রভাবিত হয়, তবে সবার কথায় না। কিছু কিছু মানুষ আজীবন শুধু বলেই যায়, তাদের কথা কেউ বিশেষ কর্ণপাত পর্যন্ত করে না। কিন্তু এই কিছু মানুষের বাইরে আরও অল্প কিছু মানুষ থাকে, যাদের দীর্ঘশ্বাসও মানুষের মনে বিশেষ অর্থ জাগিয়ে তোলে। ঠিক কী কারণে কিংবা কেন এমনটা হয় তার সঠিক কোন ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব না। এমন না যে তারা দেখতে সুদর্শন কিংবা তাদের কণ্ঠ সুমধুর বলেই এমনটা হয়। অথবা তাদের চিন্তাভাবনা অন্য সকলের তুলনায় অনেক অনেক ভিন্নতর হয়, এমনও নয়। তারাও আর দশজন সাধারণের মতই চিন্তাভাবনা করে একদম সাধারণ কথাই বলে। তবুও এই সাধারণ কথাই অন্য সকলের কাছে অসাধারণ কিছু হয়ে উঠে।

এরকম একটা হিসেব কষে যদি ভাবা হয় তবে আমাকেও সে তালিকার একজন ধরা যেতে পারে। অবশ্য এর কৃতিত্ব একক ভাবে আমার নয়। এই ব্যাপারটার সাথে বংশানুক্রমিক জিনের কোন একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। একদম নিশ্চিত না হলেও আমার জন্যে এমনটা ভাবা একদম অমূলক বলা যাবে না। কারণ জ্ঞান হবার পর থেকেই দেখেছি আমার বাবার কথায়ও মানুষ খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তার কোন একটা সিদ্ধান্ত বিনাবাক্যে সকলে মেনে নেয়। তার উত্তরসূরী হিসেবে আমার কথাতেও মানুষের গুরুত্ব কিংবা প্রভাবিত হবার ব্যাপারটা আমাকে কখনোই তেমন অবাক করত না।

হ্যাঁ, একটা সময় পর্যন্ত সত্যিই এই ব্যাপারটা আমায় মোটেই অবাক করত না। কিন্তু সব পরিবর্তন হয়ে গেল ছোট একটা দুর্ঘটনা ঘটবার পর। ঠিক কি কারণে জানা নেই, একদিন বিকেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবার সময় শিমুল যখন ওর গার্লফ্রেন্ডের প্যারা নিয়ে আক্ষেপ করছিল তখন বলেছিলাম- 'তোর উচিৎ সিলিং ফ্যানের তিন পাখায় তিনটা গামছা বেধে ঐ তিনটা একত্রে করে একটা ফাঁস বানিয়ে তারপর তা গলায় গলিয়ে ঝুলে পরা'। 

ব্যাস ঐ ওটুকুই কথা, আসলে আমরা প্রতিদিন ওর ঐ এক ঘ্যান ঘ্যান শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই কিছুটা বিরক্ত আর মজা করার জন্যেই ও কথা বলেছিলাম। বাকি সবাইও ঐ মজার কথাটাকে মজা ধরে নিয়েই ওকে ক্ষেপাচ্ছিল। কেউ কেউ ঐ অবস্থাতে সেল্ফি তুলে ওর গার্লফ্রেন্ডকে পাঠানোর আইডিয়া দিচ্ছিল, আবার কেউ বলছিল গার্লফ্রেন্ডকে উদ্দেশ্য করে সুসাইড নোট লিখে তারপর ঝুলে যাবার জন্যে।

এরপরই দ্বিতীয় ভুলটা করলাম; অবশ্য তখন ওটাকে কোনভাবেই আমার ভুল মনে হচ্ছিল না। বললাম- 'সবচেয়ে ভালো হয় তুই যদি ঝুলে যাবার পুরো ব্যাপারটা লাইভ করে দেখাস, তাতে জনগনের সাপোর্ট আর গার্লফ্রেন্ডের উপর প্যারার রিভেঞ্জ নেয়া, দুটোই হয়'। আর যায় কোথায়, সকলেই আমার আইডিয়াকে বাহ্‌বা দিতে দিতে শিমুলকে এই কাজ করার জন্যেই কথার খোঁচা মেরে যাচ্ছিল।

তারপর সন্ধ্যাটা ওভাবে শেষ করে যে যার বাসায় কিংবা মেসে ফিরে গেলাম। খুব ঘুম পাচ্ছিল বলে ফিরে এসে ফ্রেশ হয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই ঘুম ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে একদম রাত আড়াইটা! মোবাইলটা সাইলেন্ট করা ছিল, তাই কিছুই টের পাই নি। স্ক্রিনে দেখলাম মিসকলের বিশাল এক নোটিফিকেশন লিস্ট দেখা যাচ্ছে। ৮৬টা মিস কল সেখানে! এক একজন গড়ে ৬~৭ বার করে কল করেছে। সবার উপরের নাম্বারটা ছিল সুমনের। তাই ওকেই কল ব্যক করলাম। রিং পুরোটা হবার আগেই ও প্রান্ত থেকে কলটা রিসিভ হয়ে গেল!

খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে সুমন বলল- 'দেখেছিস?'। সুমনের এই উত্তেজনার জন্যে ওর সাথে কথা বলাই দুস্কর। ছোটখাটো থেকে শুরু করে গুরুতর সব কিছুতেই ওর সীমাহীন উত্তেজনা কাজ করে। তাই বোঝা দুস্কর কোনটা আসলে উত্তেজিত হবার মত ঘটনা, আর কোনটা সাধারন। তাই প্রশ্নের বিপরীতে ওকে প্রশ্নই করতে হল-'কী?'
- কী মানে? তুই এখনো দেখিসনি? কোথায় তুই? কই ছিলি এতক্ষণ?
- আরে ব্যাটা ঘুমাচ্ছিলাম। এখন বল কি দেখবো? হয়েছে টা কি?
- তার মানে তুই কিচ্ছু জানিস না?
- আরে এত্ত না পেঁচিয়ে কি দেখব, আর কি জানতে হবে সেটা বলতে পারিস না?
- তুই দ্রুত ফেসবুকে লগইন কর, আর শিমুলের ওয়ালে ঢু মেরে আমাদের গ্রুপ চ্যাটে দেখ।
বলেই কলটা কেটে দিল। ব্যাটা আহাম্মকের আহাম্মক, কি হয়েছে সেটা না বলে আমাকে বলে কিনা ফেসবুকে ঢুকতে। তবে শিমুলের কথা বলায় একটু আগ্রহ হল। বিকেলেই গার্লফ্রেন্ডের প্যারা নিয়ে কান্নাকাটি করছিল। মনে হয় এবারে ব্যাটা ব্রেকআপ-ট্রেকআপ কিছু একটা করে ফেলেছে। আর সেটা নিয়েই সুগভীর কোন পোষ্ট দিয়ে বসে আছে ফেসবুকে। অবশ্য এমনিতেও এখন আমি ফেসবুকেই ঢু মারতাম।

ফেসবুক এ্যাপটা চালু করে শিমুল নামটা সার্চ দিয়ে ওর প্রোফাইলে গলাম। সেখানে একটা লাইভ ভিডিওর পোষ্ট রয়েছে। অবশ্য এখন আর লাইভ নেই, প্রায় ঘন্টাখানিক আগে সেটা শেষ হয়েছে। এখন ওটার ভিডিওটা পোষ্ট হিসেবে রয়ে গেছে। ব্যাটা নিশ্চিত গার্লফ্রেন্ডের প্যারার বর্ণনা দিয়ে কান্নাকাটি করতে করতে বিশাল কোন ইমোশনাল লাইভ ভিডিও করেছিল। ক্লিক করলাম ভিডিওটাতে, কিন্তু ক্লিক করে যা দেখলাম সেটার জন্যে আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।

শিমুল প্রথমে ক্যামেরাটা ওর রুমের বুকসেলফের কোথাও সেট করল, মোটামুটি ঐ পজিশন থেকে ওর রুমের বিশাল একটা অংশ তাতে স্ক্রিনে চলে আসে। এরপর একটু দুরত্বে দাড়িয়ে শুরু করল ওর গার্লফ্রেন্ডের প্যারার বন্দনা। এতটুকু অবশ্য আমি আশা করেই রেখেছিলাম। কিন্তু ঐ অবস্থাটা বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হল না, কথার মোড় ঘুরে গেল আমার নাম উচ্চারণের সাথে সাথে। নাম ধরেই বলল আজ বিকেলে কি আইডিয়া দিয়েছিলাম ওকে, আর সেই আইডিয়াই সে এখন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে বলে ঘোষনা করল!!

তারপর বিছানার উপর হতে কিছু একটা তুলল, হাতে নেবার পর বুঝলাম ওগুলি আসলে গামছা। ওর স্টাডির চেয়ারটা বিছনার উপর তুলে তার উপর ও দাড়াল। এরপর ঠিক যেভাবে বলেছিলাম ওভাবেই তিনটি গামছা সিলিং ফ্যানের তিন পাখায় বাধল। আর তারপর গামছা গুলি একত্র করে ওটা দিয়ে একটা ফাঁস তৈরি করল। আমি নিশ্বাস চেপে ওর কাণ্ডকারখানা দেখছি। তবে মনে মনে ক্ষীণ একটা আশা চেপে ধরে আছি যে শেষ পর্যন্ত ও আসলে ওরকম কিছু করবে না।

তারপর আবার চেয়ার হতে বিছানা আর বিছানা হতে নেমে স্ক্রিনের সামনে এসে দাড়াল। সত্যি সত্যি এর পরে যা কিছু ঘটবে তার জন্যে সকল দায়ভার ও ওর গার্লফ্রেন্ডের উপর দিল আর আমাদের সবাইকে বিদায় জানাল।
এবার আমি সত্যি সত্যি ঘামতে শুরু করলাম। অন্য মোবাইলটা দিয়ে ততক্ষনে আবারও সুমনকে ফোন করতে শুরু করেছি। রিং হচ্ছে কিন্তু ব্যাটা এখন আর ফোন উঠাচ্ছে না। আর এদিকে মোবাইল স্ক্রিনে দেখছি শিমুল আবারও বিছানার উপর দাড় করানো চেয়ারটাতে উঠে দাড়িয়েছে। এরপর কাঁপা কাঁপা হাতে তিন গামছা দিয়ে তৈরি ফাসটা গলায় পড়ে নিচ্ছে।

গামছার ফাসটা গলায় গলিয়ে দেবার পর ঐ অবস্থাতেই চিৎকার করে বলল- "দোস্ত তোকে ধন্যবাদ চমৎকার এই আইডিয়াটা দেবার জন্যে"। এরপর বাকিটুকু আর দেখা হল না, হাত থেকে মোবাইলটা খসে পড়ল আপনা-আপনি।



তারপর কিভাবে কি হয়েছে তা আর আমি তেমন পরিস্কার ভাবে বলতে পারছি না। ঘোরের মাঝে সময়টা পার হয়েছে আমার। মাথাটা পুরো ঝিম মেরে ছিল পরের পুরোটাা সময়। তবে এখন মাথাটা আবার পরিস্কার ভাবে কাজ করতে শুরু করেছে। আর কিছুক্ষন পরেই কয়েকজন গার্ড আসবে আমাকে এই সেলটা থেকে নিয়ে যেতে।

ঠাণ্ডা মাথায় উদ্দেশ্যপ্রনেদিত ভাবে বন্ধুকে আত্মহত্যা করার নিমিত্তে প্রভাবিত করার জন্যে কোর্টে বিজ্ঞ বিচারক আমার 'মৃত্যুদণ্ডাদেশ' কার্যকর করার রায় দিয়েছেন.....




শুক্রবার, জুলাই ০১, ২০১৬

অদ্ভুতুড়ে 'ঢাকা-একা'



ঢাকা-একা। কথাটা একটু অন্যরকম মনে হলেও বাস্তবতায় একদম হাতে-নাতে মিলে যায় ঢাকা নামের এই শহরটাতে। এখানে দিনের শুরুতে যেমন হাজার মানুষ একসাথে চড়ে বেড়ায় তেমনি দিন শেষেও এক সাথেই ঝগড়া আর বাগড়া বাগাতে বাগাতে নীড়ে ছুটে চলে। এই যে একসাথে ছোটাছুটি আর বাগড়া দেয়ার উৎসব, তবুও এদের মাঝে থেকে যায় যোজন যোজন দূরত্ব। একসাথে বসে যতই হাসি ঠাট্টা আর চিল্লা-পাল্লা করুক না কেন, অর্থহীন ব্যাপার গুলি যে মনে খচখচ করতে থাকে, সে খবর কেউ কাউকে জানাতে পারে না। ঐ যে একটা দূরত্ব তাদের মাঝে, সেটাই তাদেরকে অনুমতি দেয় না এইসব বলে বেড়াবার। 

ঢাকা এবং একা। হ্যাঁ, এই একই সূত্রে সকলের মত আমিও ঐ মালায় গাঁথা। দিন নেই, রাত নেই কারণে-অকারণে আমি ছুটে বেড়াই আত্মীয়ের মত আচরণ করা এই অনাত্মীয়ের শহরে। মেস বাড়ির হাজার হৈ-হুল্লোড়, চিৎকার-চেঁচামেচি কিংবা বিশাল রকমের ঝগড়া অথবা দল বেধে মাঝে মাঝে বাজার করা এই সব কিছুর মাঝে বাদবাকি বাকি সবার মত আমিও একা।

এই যে মন খারাপের সন্ধ্যায় একা এতটা সময় ধরে এই ফুট ওভার ব্রিজটার উপর দাড়িয়ে আছি, কেউ কি আমাকে দেখছে? কেউ কি জানতে এসেছে সেই বিকেল থেকে এই এখানেই কেন দাড়িয়ে আছি? কেউ কি আসবে কেন ফিরে যাচ্ছি না তা জানতে? না, কেউই এসব নিয়ে ভাববে না, কারোই এই নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। সত্যি করে বলতে আমারও নেই। কে, কেন, কোথায়, কত সময় নিয়ে দাড়িয়ে আছে তা নিয়ে কেন আমি মাথা ঘামাব? আমি তো কেবলই ছুটবো, দায়হীন ভাবে চলবে সেই ছুটোছুটি।

দেখতে দেখতে শহুরে জীবনের ব্যস্ততা অনেকটাই কমে এসেছে, পাল্লা দিয়ে কমছে ছুটোছুটির পরিমাণও। যদিও এই শহর কখনোই ঘুমায় না। কেউ না কেউ, কোথাও না কোথাও, কোন না কোন কারণে ঠিকই ছুটে চলে। আর তার ছুটে চলায় জেগে থাকে শহরটা। মাঝে মাঝে ভাবি, শহরটা যদি একদিন জন্যে বিশ্রাম নিতে পালিয়ে যেত তবে কি হতো এই মানুষ গুলির!

রাস্তার জ্যাম কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। মাঝে মাঝে সাই সাই করে কিছু যান ছুটে যাচ্ছে। এই কয়েক ঘণ্টাই এই রাস্তাটার বিশ্রামের সময়। এরপর দিনের আলো ফুটলেই আবার শুরু হবে ছোটাছুটি, তাকে বয়ে বেড়াতে হবে ক্ষুদ্র থেকে দীর্ঘাকার সকল বাহন। আর সাথে করে পোহাতে হবে জ্যামের দাপট। সকলের সাথে রোদে পুড়বে, বৃষ্টি হলে তাতেও ভিজবে কিন্তু তবুও দিন শেষে দোষ সব তার ঘাড়েই চাপবে। অবাক হবার কিছু নেই; আমি, আপনি আর আমরাই বিভিন্ন অজুহাতে রাস্তাগুলির দোষ দিয়ে বেড়াই। বলে বেড়াই- 'ঐ রোডটাতে গেলেই জ্যামে বসে থাকতে হয়, রোডটাই কুফা'; 'আজিব এক রোড, সারাদিনই জ্যাম লেগে থাকে'; কিংবা 'কি এক রোড, এই টুকুন বৃষ্টিতেই হাঁটু পানি!'

চারিদিকেই মোটামুটি একধরণের নীরবতা বিরাজমান। পথচারীও কাউকে নজরে আসছে না। এসব ছাইপাঁশ যখন ভাবছি তখন নজরে পড়ল একজন লোক সিঁড়ি ভেঙ্গে ফুট-ওভার ব্রিজটাতে উঠে আসছে। সাধারণত এত রাতে কাউকে ফুট-ওভার ব্রিজ দিয়ে রাস্তা পার হতে দেখা যায় না। এর অবশ্য দুটো কারণ আছে। প্রথমত, রাতে রাস্তা প্রায় ফাকাই থাকে। যেখানে দিনের বেলা হাজারও ট্রাফিক আর গাড়ির ছুটোছুটির মধ্যে মানুষ রাস্তা পার হতে ফুট-ওভার ব্রিজ ব্যবহার করে না সেখানে রাতে ফাঁকা রাস্তা পেয়েও তা করতে যাবে, অন্তত এ দেশে তেমনটা ভাবাটাও বোকামি। তবে প্রথম কারণটার চেয়েও দ্বিতীয় কারণটা বেশি যুক্তিপূর্ণ। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের গভীরতা যত বাড়তে থাকে ফুট-ওভার ব্রিজ গুলি সাধারণ মানুষের জন্যে ততটাই অনিরাপদ হতে থাকে। ছিনতাই, মাদকাসক্তদের খপ্পরে পড়ার মত ঘটনা এখন এখানে নিত্যদিনের রুটিনের মত। মাথা ঘামাবার কেউ নেই, এড়িয়ে চলাই একমাত্র শান্তিপূর্ণ উপায়।

লোকটা প্রায় নিঃশব্দেই উঠে আসল। আড়চোখে দেখতে পাচ্ছি লোকটাকে। খুব ধীরে-সুস্থেই হেটে আসছে সে। এমনটাও সাধারণত হয় না। ফুট-ওভার ব্রিজে দিনে কিংবা রাতে কোন বেলাতেই কোন মানুষ এত শান্ত ভাবে চলাচল করে না। তবে চলাচল করে না তার মানে এই নয় যে করতেও পারবে না। এই যেমন লোকটি করছে। ধীরে ধীরে লোকটির সাথে আমার দূরত্ব কমতে লাগল। এখন তার পদশব্দ আমার কাছে স্পষ্ট। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে আসতে ঠিক আমার পেছনেই থামল। একটু অপেক্ষা করে জিজ্ঞাস করল- "কি ব্যাপার? এভাবে এখানে দাড়িয়ে কি করছেন?"

আমি অবশ্য এমন প্রশ্নে খুব একটা অবাক হলাম না। এই নগরে বাদ বাকি সবার মত নিরাপত্তা প্রদানে নিয়োজিত এমন মানুষও বসবাস করে। তারাও প্রায়ই নিজেদের পোশাকের বাইরে ঘোরাফেরা করে। ছোটবেলাতে সাদা পোশাকের পুলিশ বলে একটা কথা খুব শুনতাম। শুনতে শুনতে তখন একটা ধারণা হয়েছিল যে, হয়তো ঐ পুলিশের চাকরি করা লোকগুলি পুলিশের পোশাকের বাইরে সবসময় সাদা পোশাক পড়েই ঘোরাফেরা করে। আর তাই হয়তো তাদের 'সাদা পোশাকের পুলিশ' বলে লোকে। ধারণাটা দীর্ঘসময় পর্যন্ত বয়ে বেড়িয়েছি। পরে অবশ্য জানতে পেরেছি কত ভুল ধারণাই না বয়ে বেড়াচ্ছি আমি আমারই এই মস্তিষ্কে। সে যাই হোক, যেভাবে এত সময় এখানে দাড়িয়ে আছি তাতে তাদের চোখে পড়াটা খুব অস্বাভাবিক নয়। তাই ততটা আগ্রহ না দেখিয়ে কিংবা কিছুটা অবহেলা নিয়ে পিছু না ঘুরেই বললাম- এমনিতেই, ভালো লাগছে না। তাই এখানে দাড়িয়ে আছি।

ভাবলাম এবারে বুঝি নাম ঠিকানা জিজ্ঞাস করে সন্দেহভাজন হিসেবে গাড়িতে তুলবে। তারপর হয় সারাটা রাত ঘুরে বেড়িয়ে সকাল সকাল ডিউটি শেষে কিছু কড়া কথা বলে ছেড়ে দিবে কিংবা মায়া করে লক-আপে রেখে দিবে। তারপর পরিচিতদের ডেকে এনে ছুটতে হবে সেই মায়া ভরা খাতিরদারি থেকে। অবশ্য তাদের এই খাতিরদারির হাত থেকে সহজে রেহাই পাবার মত আমার পরিচিত কেউ নেই। না আছে এই শহরে, না আছে অন্য কোথাও। তবুও পিছু ঘুরে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকালাম না। ঠায় নিজের অবস্থানেই দাড়িয়ে রইলাম।

কিছুক্ষন অপেক্ষা করে প্রশ্নকর্তাও আমার মত ফুট ওভার ব্রিজটার রেলিং এর উপর হাত ভর করে দাঁড়াল। জিজ্ঞাস করল- সঙ্গে সিগারেট আছে?

ঢাকা শহরের অর্ধশত সিগারেট খোর রুমমেট আর বন্ধুদের সাথে থেকেও আমি ঐ একটা বস্তু এখনো খেতে শিখলাম না। এটা নিয়েও মাঝে মাঝে লজ্জায় কিংবা বিব্রতকর মুহূর্তে পড়তে হয়। এই যেমন এই মুহূর্তটা। এ শহরে সাধারণত পরিচিত কিংবা অপরিচিত কেউ আপনার কাছে তেমন কিছু না চাইলেও সিগারেট জিনিষটা অবশ্যই চাইবে। তারপর যখন ঐ বস্তু আমি "খাই না" বলে জানাই তখন কিছুটা অবজ্ঞা আর কৃত্রিম বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকবে। সব শেষে কেউ কেউ বাহ্‌বা দিবে আর কেউ কেউ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে দুটা কথা শুনিয়ে দিবে। 

মনে মনে এমন একটা পরিস্থিতি হবে চিন্তা করেই উত্তর দিলাম- না, সিগারেট খাই না আমি।

লোকটা যেন আমার উত্তরে খুব মজা পেয়েছে এমন ভাব নিয়ে বলল- খেতে বললাম কখন? জিজ্ঞাস করলাম আছে কি না আপনার সাথে।

বিরক্ত নিয়ে এইবার লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম- যে জিনিষ আমি খাই না সে জিনিষ কেন পকেটে নিয়ে কোন লজিকে ঘুরবো আমি? ফাজলামো করেন?

শেষ কথাটা বলেই মনে হল একটু বেশি হয়ে গেছে। এসব নিয়ে অনেকেই মজা করে আমার সাথে। সিগারেট খাই না জেনে মজা নেবার চেষ্টা করে। বেচারাও হয়তো ভেবেছিল তেমন কিছুই করবে। কিন্তু তার বিপরীতে এমনি ভাবে ফাজিল উপাধি পেয়ে যাবে, তা নিশ্চই আশা করেনি। 

কটু কিছু কথার প্রস্তুতি মনে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। কিন্তু না, লোকটা তেমন কিছুই করল না। পাশেই দাড়িয়ে রইল। সম্ভবত 'ফাজিল' উপাধিটা হজম করতে বেচারার বেগ পেতে হচ্ছে। এমনিতেই মন খারাপ, তার উপর এমন পরিস্থিতি মনটা আরও খারাপ করে দিল। কড়া কথা বলার জন্যে ক্ষমা চাইতে যাবো এমন মুহূর্তেই লোকটা বলল- সরি বলার মত এমন কোন কাজ আপনি করেন নি কায়েস সাহেব। মন খারাপের সময় কেউ যেচে এসে দুষ্টুমি করতে চাইলে এমন কিছু বলাটাই বরং স্বাভাবিক। 

কিছুটা অবাক হলেও তা প্রকাশ করলাম না। অবাক হবার দুটো ব্যাপার ঘটেছে। প্রথমত যতদূর মনে হচ্ছে লোকটাকে আমি সরাসরি চিনি না, সেই হিসেবে আমার নাম তার জানবার কথা নয়। তারপরও ধরে নিলাম কোন না কোন মাধ্যমে সে আমার নাম জানতেই পেরেছে। আর দ্বিতীয় ব্যাপার হল, আমি যে এই মুহূর্তে তাকে সরি বলতে যাচ্ছিলাম সেটা সে কিভাবে আঁচ করল? অবশ্য সেটাও আচ করা খুব কঠিন কিছু নয়, যেহেতু নাম জানে সেই হিসেবে আমার স্বভাব সম্বন্ধে কিছু জেনে নেয়া একেবারে অসম্ভব কোন কর্ম নয়।

এইসব সাত-পাঁচ ভাবার মাঝেই লোকটা আবার বলল- অবশ্য এমন ঘটনা ঘটবার পর মন খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। 

এবারে কিন্তু বিস্মিত হতেই হল। বিকেলে কি ঘটেছে সেটা একমাত্র আমি ছাড়া এখনো কেউ জানে না। মেসের দিকে যাইনি, কাউকে ফোন করিনি কিংবা এর মাঝে পরিচিত কারো সাথে দেখাও হয়নি যে কাউকে ঘটনাটা বলব। তাহলে এই লোক কিভাবে জানল কি ঘটেছে? নাকি এটাও আন্দাজে বলা কথার মত? গণকেরা যেভাবে হাত দেখে ১০টা আন্দাজে কথা বলবে, আর সেই কথা গুলি এতটাই কমন ব্যাপার হয় যে পৃথিবীর যে কারো সাথেই ঐ ১০ কথার ৪/৫টি মিলেই যাবে। তেমনি মন খারাপ হলে কোন না কোন ঘটনা তো এর পেছনে থাকবেই। লোকটা কি তবে এমন ভেবেই কথাটা বলল?

আমি কেবল কিছু সময় লোকটার দিকেই তাকিয়ে রইলাম। বয়স কত হবে লোকটার? ৩৫? ৪০? নাকি ৫০? কি জানি, নিয়নের আলো লোকটার বয়স অনুমান করতে দিচ্ছে না। আলোটাই যেন কেমন আধার করে রেখেছে জায়গাটাকে। আরও বিভ্রান্ত করছে লোকটার চাহনি। একবার মনে হচ্ছে লোকটা আমার অবস্থা বুঝে হাসছে, আরেকবার মনে হচ্ছে মুখ গম্ভীর করেই চেয়ে আছে। 

লোকটা আবারও বলতে শুরু করল- দেখুন কায়েস সাহেব, জীবনের সময়টা এত ক্ষুদ্র যে মন খারাপ করে কাটানো সময় গুলি এখানে বিলাসিতা করে সময় নষ্ট করা। এই যে আমরা, সময়ের যে স্রোতে ভেসে চলেছি সেটাকে কোনভাবেই পরিবর্তন করতে পারব না। পেছনে ঠেলেও ফিরে যাবার কোন সুযোগ নেই। যদি সম্ভব হতো তবে অনেক পরিবর্তনই করে নেয়া যেতো, শুধরে নেয়া যেতো নিজের অনাকাঙ্ক্ষিত সকল ভুল গুলিকে। অথচ এমনটা করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। আপনি হয়তো বিজ্ঞানের দোহাই দিবেন। বলবেন, লজিক্যালি সময়ের পেছনে ছুটে যাওয়া যায়। কিন্তু সেই আপনিই আবার বলবেন লজিক্যাললি সম্ভব হলেও বাস্তবে তা তা এখনো সম্ভব নয়। তাই বলছিলাম এভাবে অযথাই সময়গুলিকে অপচয় না করে উপভোগ করুন। 

একটানা কথা গুলি বলে গেল লোকটি। আমার বিস্ময়-ভাব তখনও কাটিয়ে উঠতে পারি নি। এরই মাঝে লোকটি আবারও বলতে শুরু করল-

ভালো করে সময় গুলিকে খেয়াল করে দেখবেন। আমরা সবসময়ই চেষ্টা করি নিজের সাধ্যের সর্বোচ্চ ভালো সময়টাকে পেতে, আনন্দময় সময়টাতে ডুবে থাকতে আর প্রাপ্তির আনন্দে মেতে থাকতে। কিন্তু যতই চেষ্টা করি এইসবের মাঝে আমরা ডুবতে পারি না। তবে হ্যাঁ, কাছাকাছি যাবার একটা সুযোগ তৈরি হয়ে যায় বটে। আর যদি কখনো ভাগ্যটা সহায় না হয় তখন ছিটকে পড়ি। তবে সমস্যাটা ছিটকে পড়ে যাওয়াতে নয়। সমস্যাটা হল ছিটকে পড়ে যাবার পর সেখানেই পড়ে থাকাতে। আমরা প্রায় সকলেই খারাপ সময়ে প্রবেশ করার পর ঐ খারাপ সময়টাকে নিয়েই টেনে হিঁচড়ে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু এই খারাপ সময়টাকে বয়ে বেড়াবার কিছু নেই। চেষ্টা করলেই নতুন উদ্যম নিয়ে ভিন্ন কোন ভালো সময়ের দিকে ছুটে যাওয়া সম্ভব। পথের দূরত্ব একটু বেশি হতে পারে কিন্তু তাই বলে সেখানে পৌঁছানো অসম্ভব নয়। বরং আমি বলব খারাপ সময়টা আপনাকে ভিন্ন আরেকটা ভালো সময়ে পৌঁছে দেবার একটা পোর্টালের মত কাজ করে। আপনাকে শুধু বুঝতে হবে কোন পোর্টালে আপনি প্রবেশ করতে চান।

আমি একরকম হা করেই লোকটার কথা গিলছিলাম। কোন কথাই মস্তিষ্কে প্রবেশ করছিল না, কিন্তু কথা গুলির গুরুত্ব ঠিকই বুঝে নিতে পারছিলাম। এমন মুহূর্তে হুস করে একটা ট্রাক ছুটে চলে গেল। ট্রাক চালকদের সম্ভবত সবসময় ট্রাফিকে বসে থাকার দরুন কিছুক্ষণ পরপর হর্ন বাজাবার একটা অভ্যাস তৈরি হয়ে যায়। নয়তো এমন ফাঁকা রাস্তায় কোন প্রয়োজন লোকটা ট্রাক ছুটাতে ছুটাতে হর্ন বাজাবে তা আমার বুঝে আসে না। 

এই টুকু সময়ের জন্যেই লোকটার উপর থেকে মনোযোগ ছুটে গিয়েছিল। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম লোকটা নিঃশব্দে ফুট-ওভার ব্রিজটার অপর প্রান্তের সিঁড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। লোকটাকে ডাকতে যেয়েও কেন জানি ডাকতে পারলাম না। মনের ভেতর কে যেন বলছিল- "তোমার যা জানার তা জেনেছ। নতুন করে আর কিছুই জানার নেই"।

দেখতে দেখতে লোকটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। তারপর অল্প সামনে এগিয়ে একটা বিল্ডিং এর মোড়ে একটু থামল। পেছনে ঘুরে একবার একটু তাকাল আমার দিকে। মনে হল আমার দিকে তাকিয়ে মাথাটা একটু ঝাঁকাল, তারপর ধীরে সুস্থেই বিল্ডিং এর মোড়ের পথ ধরে হারিয়ে গেল, হারাল আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে।

দূরে কোন মসজিদে মুয়াজ্জিন নামাজের আহ্বানে ডেকে চলেছে। এত দূর থেকে স্পষ্ট না হলেও তার আহ্বানের মাধুর্য বুঝতে কোন কষ্ট হচ্ছিল না। এবারে আমার ফেরা উচিৎ। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে এই শহরের পথ গুলি আবারও জীবিত হবে। দিক-বিদিক ভুলে দীর্ঘশ্বাস চেপে ছুটবে মানুষ। দেখতে দেখতে মানুষের ব্যস্ততা আর জ্যামের জঞ্জালে শহরটা আবারও তার পরিচিত রূপে ফিরে আসবে।








মঙ্গলবার, জুন ১৪, ২০১৬

অদ্ভুতুড়ে ভালোবাসা



এক পাখির দম্পতিদের একজন ছিল অন্ধ। অন্য পাখিটা নিজের পাশাপাশি অন্ধ পাখিটার দেখাশোনা করত। তার খাবার জোগাড় করা, বাসা তৈরি করা, নষ্ট বাসা পুনরায় ঠিকঠাক করা। এই সবই করত চোখে দেখা পাখিটা। অন্ধ পাখিটা শুধু তার অনুগ্রহেই বেঁচে থাকত। আর অবসরে দুজন মিলে খোলা আকাশে উড়ে বেড়াত। সেখানেও অন্ধ পাখিটাকে তার সাথী পাখিটা সহায়তা করত। গাইড করে তাকে উড়ে যাবার নির্দেশনা দিত। আর সেই নির্দেশনা মতই অন্ধ পাখিটা উড়ে চলত।

অন্ধ পাখিটার এই নিয়ে অনেক আফসোস ছিল। আফসোস ছিল কারণ দম্পতি হয়েও তারা একত্রে কোন কাজই স্বাধীন ভাবে করতে পারে না। একজন তার জন্যে খেটে মরে, আর অন্যজন সেই খাটুনির উপর জীবন নির্বাহ করে। প্রায়ই এই নিয়ে বিলাপ করত অন্ধ পাখিটা। কিন্তু সাথী পাখিটা তার প্রতিটা বিলাপের বিপরীতে তাকে সান্ত্বনা দিতো, সাহস যোগাত। নিজের এত খাটা-খাটনির পরেও অন্ধ পাখিটাকে সে কখনোই ছেড়ে যাবার কথা চিন্তা করত না। বলতে গেলে প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসা দিয়ে তাকে আগলে রাখার চেষ্টায় সর্বদা সচেষ্ট থাকত।

একদিন কোন এক বিকেলে অন্ধ পাখিটা তার সাথী পাখিটাকে জিজ্ঞাস করল-
- মনে কর কোন একদিন কোন কারণে আমি হারিয়ে গেলাম, কিংবা হারালাম ভুবন থেকে। তখন তুমি কি করবে?

জবাবে সাথী পাখিটি বলল-
- যেদিন ঐরকম কোন সময় আসবে সেদিন চিন্তা করব।

অন্ধ পাখিটা আবার জিজ্ঞাস করল-
- যদি দেখো কাল বিকেলে নীড়ে ফিরে দেখো তোমার আশ্রিত এই অন্ধ বিহাগ আর নেই এই নীড়ে। কিংবা জমে আছে শক্ত হয়ে। পিপীলিকারা আনন্দে আত্মহারা! খুঁটে খুঁটে তুলে নিচ্ছে তার অন্ধ চোখের অংশ গুলি। তখন কি করবে?

সাথী পাখিটা এবারে বলল-
- সে সময়ের কথাও সময়ে তোলা থাক। সময় ঠিকই জানে আমি কি করব তখন।

অন্ধ পাখিটা মনে মনে হাসল। কি অদ্ভুতুড়ে ভালোবাসাতেই না ডুবে আছে সে। অথচ বিনিময়ে তাকে কিছুই ফিরিয়ে দিতে পারছে কই! দীর্ঘশ্বাস আপনা-আপনি বের হয়ে আসল অন্তর হতে।

কিছুদিন বাদে এক বিকেলে দুজনে দুয়ে দুয়ে চার পাখা মেলে উড়ছিল মুক্ত আকাশে মনের আনন্দে। অন্ধ পাখিটা তার সাথীর বলে দেয়া পথ অনুসরণ করে উড়ে যাচ্ছিল, আর সাথী পাখিটা উড়ছিল অন্ধ পাখিটার চারপাশে, বৃত্তাকার, উপবৃত্তাকারের নানা ভঙ্গিতে। এভাবে ছুটে চলাতেই তাদের যত আনন্দ।

কিন্তু আনন্দটা আর কিছুক্ষন বাদে আনন্দ থাকল না। বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ করেই ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করল। ফিরে যাবার দিক নির্দেশনা দিতে দিতে সাথী পাখিটা প্রাণপণে ছুটোছুটি করতে আরম্ভ করল। আর ওদিকে ঝড়ো হাওয়ার সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল ধুলো। চারিপাশ অন্ধকার করে ঘিরে ধরল ধুলোর এক আস্তরণ। বাতাসের ঝাপটা আর ধুলোর ধাক্কায় বার বার পথ হারাচ্ছিল তারা।

ব্যতিব্যস্ত হয়ে পথের দিশা খুঁজে বের করে জোরে জোরে চিৎকার করে যাচ্ছিল সাথী পাখিটা। ধুলোর সাথে যুদ্ধ করার সময় তার খেয়ালে কিছুটা ভাটা পড়েছিল অন্ধ পাখিটার উপর থেকে। আর সেই সুযোগেই দমকা হাওয়া অন্ধ পাখিটাকে টেনে নিলো আপন দিশায়। এভাবে একটু একটু করে দূরত্ব বাড়ছিল তাদের। আর এভাবেই একটু একটু করে ভিন দিশায় ছুটে বেড়াচ্ছিল পাখি দুটো।

সাথী পাখিটা যখন মোটামুটি বালির চাদর ভেদ করে পথ খুঁজে বের করল তখন পিছনে ফিরে দেখে অন্ধ পাখিটা তার পেছনে নেই। ভয় পেয়ে গেল সে, তেড়ে গেল আবারও ধুলো-ঝড়ের দিকে।
কিন্তু কই! ধুলো ঝড় তো বিদায় হয়েছে। দমকা হাওয়াও তার এমনতর দুষ্টুমিতে লজ্জা পেয়ে কোথায় লুকিয়েছে। এখন কেউ এখানে নেই। তাহলে কোথায় গেল সে!

নিজের সর্বোচ্চ শক্তিকে ব্যয় করে ছুটল সাথী পাখিটা। চিৎকার করে ডাকতে লাগল অন্ধ পাখিটার নাম ধরে।
নেই! সে কোথাও নেই। বালি আর হাওয়া যেন একদম মিশিয়ে নিয়েছে অন্ধপাখিটাকে তাদের মাঝে।

সাথী পাখিটার চিৎকার ততক্ষণে আর্তনাদে রূপ নিয়েছে। ছুটল, কেবলই ছুটে বেড়াল সেই সন্ধ্যা থেকে ভোর অবধি। শেষ পর্যন্ত সূর্যের আলোও যখন তাকে তার অন্ধ সাথীকে খুঁজে দিতে পারল না তখন বাতাস আর বালিদের প্রতি প্রচণ্ড অভিমান করে ফিরতে শুরু করল নীড়ে। অন্ধ পাখিটির পরিণতি ভেবেও বার বার নিজেকেই দোষারোপ করছিল। কেন যে আজ উড়তে বের হয়েছিল, সে নিয়ে আফসোস করতে করতে নোনা জল ঝরাচ্ছিল চোখ থেকে।

ওদিকে অন্ধ পাখিটা ধীরে ধীরে বাতাসের ঝাপটায় ভিন দিশাতে কখন যে ছুটে চলেছিল তা সে নিজেও বুঝতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত যখন বুঝল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কান পেতেও সাথী পাখিটার কোন কথাই সে শুনতে পারছিল না। তখন সেও পাগলের মত সাথী পাখিটার নাম ধরে চিৎকার জুড়ে দিল। ছুটতে ছুটতে ঝড় পিছু ছাড়ল, বালির আস্তরণ অনেক অনেক পিছনে পড়ে রইল, কিন্তু সাথী পাখিটার কোন খোঁজ সে করতে পারল না। তবুও চিৎকার করতে করতে শক্তি শেষ হবার আগ পর্যন্ত উড়ে বেড়াতে লাগল।

কিন্তু এভাবেই বা কতক্ষণ! দিশা হারিয়ে কত সময়ই বা আর উড়ে চলা যায়। শক্তি ফুরিয়ে আসলে ক্লান্ত হয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসল ভূমির দিকে। নিয়তি আজ তার নিশ্চিন্ত গাছের ডালে যে বিশ্বাসের আশ্রয় ছিল, তাও কেড়ে নিলো। নিজের দুঃখ নিয়ে বিলাপ করবারও আগে দুশ্চিন্তায় ঘিরে ধরল তাকে। সে তো ভুল দিশায় হলেও অবশেষে নিস্তার পেয়েছে ঐ নিষ্ঠুর বালি-ঝড় হতে। কিন্তু তার সাথী পাখি? সে কি বের হতে পেরেছিল ঐ ঝড় থেকে?

মনে এমন দুশ্চিন্তা নিয়েই কাটাতে লাগল সময়। হঠাৎ হঠাৎ যখন দূর থেকে কোন শব্দ ভেসে আসে তখনই চিৎকার করে সাথী পাখিটার নাম ধরে ডেকে উঠে। তারপর আবারও অপেক্ষাতে থাকে, এই বুঝি সাথী পাখিটা উড়ে এসে বলবে- "এভাবে পথ হারালে কেন! জানো না কতটা দুশ্চিন্তায় দৌড়ে বেড়িয়েছি আমি।"

সেই আশা আর পূরণ হয় না। ধীরে ধীরে ভোর হতে শুরু করে। চারিদিকের ব্যস্ততার শব্দ ঠিকই ভেসে আসে তার কানে। মাঝে মাঝে দূর আকাশে পাখিদের আলাপ করতে করতে উড়ে যাওয়া বুঝতে পারলে চিৎকার দেয় সাথী পাখিটার নাম ধরে। নিজে উড়ে যায় না। যদি উড়তে গিয়ে ভিন দিশাতে আরও দূরে কোথাও হারিয়ে যায়, সেই ভয়ে।

হঠাৎ একদল পাখি তার পাশে এসে নামল। অন্ধ পাখিটা মনে করল হয়তো তার সাথী পাখিটাই এসেছে। আনন্দে চিৎকার করে উঠে সে সাথী পাখিটার নাম ধরে। কিন্তু তার সাথী তো সেখানে নেই। পাখির দলটা অন্ধ পাখিটার কাছ থেকে তার ঘটনাটা শোনে। তারপর মোটামুটি একটা ধারণা নিয়ে তাকে তাদের সাথে উড়িয়ে নিয়ে চলে অন্ধ পাখিটার নীড়ের খোঁজে।

অনেক ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত নিজের নীড়ের ঠিকানা খুঁজে পায় অন্ধ পাখিটি। আনন্দে আত্মহারা হয়ে চিৎকার জুড়ে দেয় সাথী পাখিটার নাম জুড়ে। কিন্তু সেই চিৎকারের বিপরীতে কোন সাড়া নেই। পাখির দল ভাবে হয়তো অন্ধ পাখিটার খোঁজে সাথী পাখিটা বের হয়েছে। সেজন্যেই কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তারা অন্ধ পাখিটাকে নীড়ে পৌঁছে দিয়ে উড়ে যেতে থাকে আপন ঠিকানায়।

অন্ধ পাখিটা আপন নীড়ে প্রবেশ করে। সেও ভেবে নিয়েছে, সাথী পাখিটা হয়তো তার খোঁজেই ঘুরে ফিরছে। এখনই হয়তো যে কোন সময়ে হুট করে ফিরে আসবে সে। তারপর তাকে এখানে আবিষ্কার করে আনন্দে চিৎকার জুড়ে দিবে। হয়তো কেঁদে কেটে একটা হুলস্থুল কাণ্ডও ঘটিয়ে বসতে পারে।

এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আপন মনে নীড় জুড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎই থমকে যেতে হল। থমকাল সাথী পাখিটার গায়ের গন্ধ পেয়ে। তার সাথী তো এখানেই আছে, এই নীড়েই রয়েছে সে। তবুও কেন তাকে দেখছে না? নাকি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সাথীটি তার? মনে এমন প্রশ্ন নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে থাকল সাথী পাখিটার ঘ্রাণ বরাবর। হাটতে হাটতেই আবার হোঁচট খেল। সাথী পাখিটার গায়ের সাথেই হোঁচট খেয়েছে সে। মুখটা নামিয়ে সাথী পাখিটার গায়ে আদুরে ভঙ্গিতে ঘসতে লাগল অন্ধ পাখিটা। মাঝে মাঝে এমন করে সে। সাথী পাখিটা এমন করলে মনে মনে বেশ আনন্দিত হয়। যদিও মুখে বলে ভিন্ন কথা। এমন করলে বার বার বলতে থাকে- "কেন যে এমন ছেলেমানুষি কর"। অথচ তার কণ্ঠই বলে সেও মনে মনে এমন আদর বেশ উপভোগ করছে।

কিন্তু আজ তেমন কিছুই হল না। নিশ্চুপই পড়ে রইল সাথী পাখিটা। অন্ধ পাখিটা মনে করল কাল ঐভাবে তার কথা খেয়াল না করে পথ হারানোতে মান করেছে তার সাথী। তাই সে বলতে শুরু করল-
আমি কি ইচ্ছে করে এমনটা করেছি নাকি?
বাতাসের ধাক্কায় দিক হারিয়ে ফেলেছিলাম যে! নয়তো কি আর এমন হয় নাকি?

কিন্তু তাতেও কোন পরিবর্তন নেই সাথী পাখির। ওভাবেই গো ধরে পড়ে আছে সে।
এবারে অন্ধ পাখিটি ঘুরে সাথী পাখিটার সামনে চলে এলো। কিন্তু মেঝেতে এমন কি ফেলেছে তার সাথী। কেমন চিটচিটে হয়ে আছে মেঝে। পায়ে ঐসব চিটচিটে জিনিষ লেগে একাকার অবস্থা। তারপরও এগিয়ে এসে বার কয়েক ধাক্কা দিল সাথী পাখিটার গায়ে। কিন্তু না, কোন নড়াচড়াই নেই তার।

হঠাৎই অন্ধ পাখিটা বুঝতে পারল কেন সাথী পাখিটা আর নড়ছে না, কেন অভিযোগ করছে না তার পথ হারানো নিয়ে। চিটচিটে বস্তুটাই বা কি তাও বুঝতে আর কোন সমস্যা হল না তার।

ভোরে সাথী পাখিটা তার ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফিরে এসেছিল নীড়ে। নীড়টা তৈরির সময় ঘরের এক কোণে সে লুকিয়ে রেখেছিল ভাঙ্গা একটি সুঁই। সন্তর্পণে সেই সুঁই বের করে নিয়ে আসে সে। এরপর সেই সুঁইটাকেই নিজের চোখ বরাবর গেঁথে দেয়। রক্তের ধারার সাথে সকল গ্লানি আর অপরাধ-বোধ বের হয়ে আসে তাতে ভেতর থেকে। ধীরে ধীরে নিথর হয়ে আসে তার শরীর।

অন্ধ পাখিটা এবারে আর কোন চিৎকার করে না, বিলাপ করে না আর। সে তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে। সময়ের কাছে তার যে প্রশ্নের উত্তর সাথী পাখিটি লুকিয়ে রেখেছিল, আজ ঐ উত্তর সে জেনে গেছে। জেনে গেছে নিয়তি তাকে পথ হারা করে কী ছিনিয়ে নিয়েছে তার আপন খেয়ালে...











বুধবার, আগস্ট ১৩, ২০১৪

অনুগল্পঃ দিনের শুরুর ব্যস্ততার গল্পের খোঁজে.....



রাত্রিটা স্বস্তি আর অস্থিরতা পার করে দ্রুত পায়ে ভোরের দিকে ছুটে চলে, সাথে আমার হেটে চলা পথটাও অন্ধকার থেকে আলোর দিকে ধাবিত হয়। একটা দিনের শুরুর আলোকিত হবার প্রক্রিয়াটাও বেশ জটিল। হুট করেই আলো চলে আসে না কিংবা খুব ধীরেও আসতে পারে না। মনে হয় কিছু সময় পরপর আকাশের কালো পর্দাটা আস্তে আস্তে কেউ শুভ্র একটা পর্দা দিয়ে পরিবর্তন করে দিচ্ছে। আর প্রতিবারই এই অন্ধকারটা একটু একটু করে কমে যাচ্ছে তাতে।

মঙ্গলবার, মে ১৩, ২০১৪

অনুগল্প - না বলা বিদায় বেলা




সুমন আর ফাহিমা, কলেজের কে চেনে না তাদের? ভিন্ন ভিন্ন শিফট, আর সেই ভিন্ন ভিন্ন শিফটেই নিজেদের দুষ্টামির জন্যে তারা সেরা। স্যারদের কটু কথা, হুমকি, নালিশ, গার্ডিয়ান ডেকে বিচার কোনটাই কাবু করতে পারেনি তাদের। মাস ৬ চলার পর স্যরেরাই তাদের দুষ্টামি নিয়ন্ত্রণে আনার হাল ছেড়ে দেয়। না ছেড়েই বা কি করবে? পড়ালেখায় তো আর দুষ্টামির জন্যে ফাঁকি দিচ্ছে না। ক্লাস টেস্ট, কোয়াটার টেস্ট সব কিছুতেই নিজেদের অবস্থান উপরের দিকেই ধরে রেখেছে তারা। সমস্যাটা যখন শুধুই দুষ্টামির তাহলে একটু ছাড় দেয়াই যায়, এই ভেবে ক্ষান্ত দিল তারা।

নিজেদের মধ্যে পরিচয় শুভ'র মাধ্যমে। দু'জনেরই কমন ফ্রেন্ড শুভ। ফাহিমা'র স্কুল ফ্রেন্ড আর সুমনের সাথে কলেজে পরিচয় হয় শুভ'র। কেমিস্ট্রি স্যর মিজানের কাছে তারা কোচিং করে একসাথে। শুভ'ই ডেকে নিয়ে ফাহিমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় সুমনের। ফাহিমার সাথে গল্প করার সময় সুমনকে ডেকে বলে- "দোস্ত! এইটা আমার দোস্ত। এইবার পরিচিত হয়ে নে।" এই শুভ'টাও কম ফাজিল না, ফামিহা এমনিতেই দুষ্টামির সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। মুখের উপরই বলে ফেললো- "তোর দোস্ত মানে তো আমারও দোস্ত। তাই না সুমন দোস্ত?” সুমন এই কথার পর আর যায় কোথায়। দুষ্টামিতে তো আর সেও কম যায় না। সাথে সাথেই উত্তর- "আব্বে দোস্ত! এইটা আবার কইতে হয় নাকি? আমরা সবাই তো গোল্লাছুট খেলার দোস্ত। কোন কথা নাই.." দুষ্টামিতে সবাই এক্সপার্ট সেইটা এক মুহূর্তেই বোঝা হয়ে যায় সবার।

কোচিং এ ও দুষ্টামি চলতো সমান তালে। তবে এখানে দুষ্টামির সাথে পড়ালেখার সিরিয়াসনেস একটু কলেজের তুলনায় বেশি ছিল সবার। নোট শেয়ারিং, কোচিং ক্লাস ডিসকাস আর মাঝে মাঝে ভিন্ন ভিন্ন স্যারদের প্রশ্ন জোগাড় করে নিজেদের মত করে প্রশ্নের গুরুত্ব খুঁজে নিতো তারা। ভালোই চলছিলো, কোচিং এর পর একটু ঘোরাঘুরি, ফাস্টফুড আর কফি শপেও আড্ডা চলতো তাদের। বন্ধুত্বটা একটু বেশি বেশি মনে হয়েছিল সকলের। আসলে সকলের না নিজেদেরও মনে হচ্ছিল। কিন্তু কেউ কখনো কাউকে কিছুই বলেনি। হয়তো বন্ধুত্বটা নষ্ট করতে চায় নি।

দেখতে দেখতে ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল চলে এল পড়ার চাপ বেড়ে গেলো সকলেরই। আড্ডা ইদানীং একেবারেই কম হয়। তবে প্রয়োজনে মাঝে মাঝে মোবাইল ফোনে আলাপ চলে। তারপর পরীক্ষা, অনেক টেনশন দুষ্টামি আর বিরক্তি নিয়ে পরীক্ষাটা ভালোয় ভালোয় শেষ করলো সকলেই। মাঝে ১২ দিন ছুটি ঘোষণা করলো কলেজ। ১২ দিন নিজেদের মত করে ছুটি কাঁটালো সবাই। যোগাযোগ ঐরকম করে আর করা হয়নি কারো সাথেই। ১২ দিন পরে আবার কলেজ আর কোচিং এর রুটিন মাফিক দৌড়াদৌড়ি শুরু। কিন্তু ৩ দিন হয় ফাহিমার কোন দেখা নেই। শুভ আর সুমন বার ২-৩ ফোনও দিয়েছিল, রিসিভ করেনি কিংবা কল ব্যাক ও করেনি সে।

আজ খোঁজ নিবো, কাল খোঁজ নিবো করতে করতে ৬ দিনের মাথায় ফাহিমাই ফোন দিয়ে সুমন আর শুভ'কে পরিচিত ফাস্টফুডে আসতে বলল বিকেলে। কি হয়েছে জানতে চাইলে তার উত্তর না দিয়ে কৌশলে এড়িয়ে গেল ফাহিমা। কোচিং শেষ করে বিকেল ৫ টার কিছু পর সুমন আর শুভ দুজনেই ফাস্টফুডে গিয়ে পৌঁছল। সারপ্রাইজটা তখনও অপেক্ষা করছিল তাদের জন্যে। তারা রেগুলার যে টেবিলটায় বসে আড্ডা দেয় সেখানে ফাহিমা আগে থেকেই অপেক্ষা করছে তাদের।

শুভ সোজা গিয়ে ফাহিমার ঘড়ে চেপে ধরেই বলতে শুরু করল-

» শয়তান! এতদিন কই ছিলি? খেয়ে দেয়ে তো মোটা হয়ে গেছিস। ফোন দিলাম এতগুলি করে খাওয়ার তালে ঐটাও শুনতে পাস নাই?

» আরে ছাড়! আজব তো! আগে কথা তো শুনবি। কোথায় জিজ্ঞাস করবি কেমন আছি না আছি। তা না, আগেই ঘাড়ে হাত।

» তোর কথা আর কি শুনবো? তুই তো খেয়ে দেয়ে মোটা হয়েই এসেছিস। ফর্সাও হয়েছিস কিছুটা।

» এই শয়তান, তোরে জিজ্ঞাস করছি আমি সুন্দর হইছি না মোটা হইছি?


বলেই উল্টা হাতে দিল শুভর পেটে এক কুনি। শুভ ফাহিমার ঘাড় ছেড়ে সুমনের পাশের চেয়ারটায় বসলো। এবার সুমন জিজ্ঞাস করলো-

» কি হয়েছে তোমার? আসলে না ফোনও রিসিভ করলে না, মেজর কোন সমস্যা ছিল নাকি?

» আস্তে ধীরে বৎস,আগে ঠাণ্ডা হও, ঠাণ্ডা খাও তারপর বলছি।

ইশারায় ওয়েটার ডাকল ফাহিমা, ওয়েটার আসলে তাকে বলল ৪ টা বার্গার আর ৪টা ঠাণ্ডা কিছু দেবার জন্যে। ওয়েটার চলে যাবার পর শুভ টিটকারি দিয়ে বলল-

» দেখ। এই কয়দিনেই খাওয়ার রুচি কত বেড়েছে মুটি টার। এখন ওর একারই ২টা বার্গার লাগে।

» শুভ!! একদম বাজে কথা বলবি না বললাম!! আর একজন আসছে, অর্ডারটা তার জন্যেই করেছি।

» আরও একজন? ঐটা আবার কে? কোন সুন্দরী কাজিন নাকি তোর??

» তোদের এই এক সমস্যা। কেউ আসবে শুনলেই সুন্দরী কাজিন আর বান্ধবী খুঁজিস তোরা।

» তো! আর কি ভাববো? আমরা তো স্ট্রেইট মাইন্ডের.... বুঝস না।

» হুম, বুঝিই তো তোরা কত বড় স্ট্রেইট শয়তান।

» এখন বল কে সেটা?

» আসুক, আসলেই বুঝতে পারবি।

অর্ডার দেয়া খাবার আসার আগেই একজন যুবক ফাস্টফুড শপে প্রবেশ করে আর ঠিক ফাহিমাদের টেবিলের সামনে এসে দাড়ায়। ফাহিমা তাকে দেখেই হেসে দেয়, আর বলে-

» সুমন, শুভ এ হচ্ছে ইমরান, পরিচিত হও। আর এরা দুইজন আমার খুব ভালো বন্ধু।

» হ্যালো সুমন এন্ড শুভ। নাইস টু মিট ইউয়্যু।

» নাইস টু মিট ইউয়্যু ঠ্যু, প্লিজ হ্যাভ এ সিট।

ইমরান নামের যুবকটি কোন ইতস্তত ছাড়াই ফাহিমার পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। এর পর ফামিহা বলতে শুরু করলো-

ফাহিমাঃ আমি এই কয়দিন আসি নি বা তোদের সাথে যোগাযোগ করি নি একটা বিশেষ কারণে।

শুভঃ কি কারণ?

ফাহিমাঃ এই যে ইমরান নামের ভদ্র চেহারার মানুষটা দেখছিস, এ আসলে যতটা দেখতে ভদ্র মনে হয় ততটা ভদ্র না। এই কয়দিন এই অল্প ভদ্র লোকটাকে একটু ভদ্রতা শিখিয়েছি।

শুভঃ মানে!!

ফাহিমাঃ মানে হচ্ছে.... পরীক্ষা শেষেই হুট করে এই অল্প ভদ্র লোকটার নামে আমাকে তিন কবুল পড়তে হয়েছে।

সুমনঃ কনগ্রাচুলেশন দোস্ত। কিন্তু এইভাবেই চেপে গেলি? আমাদের অন্তত একটা ফোন দিতে পারতি।

ফাহিমাঃ আরে কিভাবে দিবো। পরীক্ষা শেষ করে বাসায় পৌঁছেই আম্মুর মুখে শুনি এমন একটা ঘটনা। আমি নিজেই তো কিছু বুঝে উঠার আগে আমাকে কবুল বলিয়ে নিলো এই হতচ্ছাড়া লোকটা। আর তারপর গতকালই কেবল সিলেট ট্যুর থেকে ফিরলাম। আর এসেই প্রথমে তোদের সাথে যোগাযোগ করেছি।

সুমনঃ যাই হোক পার্টি কিন্তু পাওনা। মাফ হবে না কোন.....

ইমরানঃ মাফ চাইছে কে? সামনের সপ্তায় রিসিপশন অনুষ্ঠান হচ্ছে ঘটা করে। আপনারা দুইজন তার দুইদিন আগে থেকে ওখানে থাকবেন। কি থাকবেন তো??

সুমনঃ সে আবার জিজ্ঞাস করতে?

ফাহিমাঃ ঐক! তাহলে আমার দিক থেকে কে যাবে?

সুমনঃ আরে ধুর! তুই তো এখন পর। আপন তো ইমরান ভাই, হা! হা! হা! হা!

ফাহিমাঃ শয়তান! শুরুতেই পল্টি নিলি। মনে রাখিস কিন্তু...

তারপর আরও অনেকটা সময় আড্ডা দিয়ে বেরুলো তারা। ফাহিমা আর ইমরান ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একটা প্রাইভেট কারে করে ছুটলো। শুভ্র এতক্ষণ পর সুমনের দিকে তাকাল। সুমন হাসি মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করলো কতবড় অভিনেতা তার এই বন্ধুটি। পাক্কা অভিনেতাই বলতে হবে।

» কি করবি এখন?

» আর কি করবো? বাসায় যাবো। সন্ধ্যা তো হয়েই গেছে। কেন কোথাও যাবি?

» নাহ! কিন্তু....

» আরে এই তিনদিন একটু ভালো করে দেখে নিলে ঐ দুই দিন ম্যানেজ হয়ে যাবে। কোন কিন্তু নেই।

» সুমন শোন!

» আরে বলার আর কি আছে। তুই বাসায় বলে দেখ। আন্টি নিশ্চিত রাজী হবে এই দুইদিনের জন্য। আর আফটার অল ফাহিমার রিসিপশন বলে কথা।

» সুমন আমি কিন্তু এটা বলতে চাইছি না।

» কিছু বলতে হবে না, বাসায় যা ব্যাটা। বেশি রাত করলে কালকের ম্যাথ গুলি করে জমা দিতে পারবি না। আমি গেলাম।

বলেই আর কোন অপেক্ষা করলো না সুমন, সাইকেলটার দিকে হাটা দিল। শুভ দাড়িয়ে দেখছে, কিছুই বলতে পারলো না বন্ধুটাকে। হাসি খুশি এই দুষ্ট ছেলেটা এত চাপা স্বভাবের এটা কি এতদিন সে বুঝতে পেরেছিল? সত্যিই মানুষ কত আজব, আনন্দ গুলি দেখাতে পারলেও কেউ কেউ দুঃখ দেখাতে পারে না। পাশের কফি শপটাতে গান পরিবর্তন হয়ে পুরাতন একটা গান বেজে উঠলো....


চলে যাও.. বন্ধু তুমি চলে যাও.. 
হৃদয়ের বাধন ভেঙ্গে দিয়ে.... 
দেবনো না.. বাধা কোন দিবো না... 
থেকে যাও.. নিজেকে নিয়ে.... 

দূরে... রবো আমি... 
শুধু তোমার সুখ কামনায়.... 
স্মৃতি.... নিয়ে এই মন.... 
আজীবন ভালবাসবে তোমায়.... 

চলে যাও.. বন্ধু তুমি চলে যাও.. 
হৃদয়ের বাধন ভেঙ্গে দিয়ে....







সোমবার, এপ্রিল ০৭, ২০১৪

অদ্ভুতুড়ে স্বপ্ন.....


ঘুমের মধ্যেই এই অস্বস্তি কাজ করছিল। কেমন যেন একটা দম বন্ধ ভাব। মনে হচ্ছিল বুকের উপর ভারী কিছু একটা বসে গলা চেপে ধরেছে। ছটফট করছিলাম খুব কিন্তু খুব অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম আমি কোন শব্দ করার শক্তি পাচ্ছি না, এমনকি নিজের হাতের আঙ্গুলটা পর্যন্ত নাড়াবার শক্তি নেই আমার। অসহায়ের মত শুধু দম নেবার জন্যে ছটফট করতে থাকলাম আমি। কিছুক্ষণ বাদেই বুঝতে পারলাম চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে আমার। মারা যাচ্ছি আমি এটা বুঝতে এতটুকু সমস্যা হচ্ছিল না।


হঠাৎ করে ছটফটানিটা কমে গেল। বুকের উপর চাপটা আগের মতই আছে কিন্তু সেটা এখন আর পিড়া দিচ্ছে না। দম বন্ধ ভাবটা নেই, সাথে দমটাও নিতে হচ্ছিল না আর। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব!! দম নেবার প্রয়োজনটাই যদি ফুরবে তবে বোধ শক্তিটা পাচ্ছি কোথা থেকে? নাকি মরে যাবার পরও বোধ শক্তিটা রয়ে যায়? নাকি......

ধরমর করে বিছানায় উঠে বসলাম। বিছানাটা আমার ধস্তাধস্তির চোটে একেবারেই জগাখিচুড়ি টাইপের হয়ে গেছে। এলোমেলো বিছানা ছেড়ে উঠলাম। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা একটা স্রোত নেমে গেলো। ঘড়ি দেখলাম, রাত ৪টা ১০। ভোর হতে এখনো অনেকটা সময় বাকি। স্বপ্নের অস্বস্তিটা এখনো রয়ে গেছে। উঠে বেসিনের সামনে গেলাম হাতমুখ ধোঁয়ার জন্যে।

ঠাণ্ডা পানির স্পর্শ চোখে মুখে লাগার সাথে সাথেই অস্বস্তিটা অনেকটা কমে গেছে। সোজা হয়ে আয়নায় দেখলাম নিজেকে। মনে মনেই হাসি পেয়ে গেলো। কিছুক্ষণ আগেই নিজের মৃত অবস্থা স্বপ্নে দেখলাম আমি আর এখন দিব্যি আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকেই দেখছি। কি অদ্ভুত স্বপ্ন! হঠাৎ গলার দিকে চোখ গেল। আয়নার দিকে একটু এগিয়ে ভাল করে গলার দিকে দেখলাম। ৩ টে করে গলার দুপাশে ৬টা দাগ লাল হয়ে আছে। কিন্তু তা কি করে সম্ভব......

বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারী ২৭, ২০১৪

রক্ত দেবেন? নাকি বিদায় বলবেন?

রবিন, চেহারায় শঙ্কা আর একটা পরাজিত ভাব নিয়ে BRTC বাসের জানালার পাশের সিটে বসে আছে। লাল চোখে পানি টলটল, কিন্তু সেটা গড়িয়ে ফেলতে পারছে না। এয়ারপোর্ট পেরিয়ে দ্রুতই সামনে এগিয়ে চলছে বাস, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছে কি করবে সেটা মাথায় কাজ করছে না তার। মাত্র এক ব্যাগ রক্তের জন্যে কি তাহলে বাবার অপারেশনটা করাতে পারবে না? উত্তরা পর্যন্ত আসলো রক্তের জন্যে, কিন্তু এখানেও তাদের কাছে রক্ত নেই। আজ বিকেলের মধ্যে যে করেই হোক রক্ত যোগাড় করতে বলেছিল ডাক্তার। দুপুর তো শেষ প্রায় এখন কি করবে? প্রয়োজনে টাকা দিয়েই কিনবে সে রক্ত, কিন্তু আগে পেতে তো হবে আগে।

পাশে বসা তরুণ হঠাৎ করেই জিজ্ঞাস করলো-
- ভাই কোন সমস্যা
- না ভাই, বাবাকে বিদায় জানাতে যাচ্ছি হসপিটালে। এক ব্যাগ রক্তের জন্যে বিদায় জানাবো। কোন সমস্যা নেই ভাই, কোন সমস্যাই নেই..
- কি বলছেন? এক মাত্র ব্যাগ রক্ত, ব্লাড ব্যাংকে যোগাযোগ করেছেন?
- করেছি ভাই, উত্তরার একটা হসপিটালে থাকতে পারে জানালো। এখন সেখান থেকেই আসছি, নেই তাদের স্টকে।
- কি গ্রুপের রক্ত?
- AB নেগেটিভ।
- কখন লাগবে ভাই?
- আজ বিকেলের মধ্যে যোগাড় করতে বলেছিল।
- চলেন তাহলে :)
- কোথায়? আপনার জানাশোনায় কোথাও পাওয়া যাবে?
- হ্যাঁ, আমিই দিবো। চলেন :)


হ্যাঁ, উপরের লিখাটা নিছকই গল্প। তবে এমন যে হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। হাসপাতালের জরুরী বিভাগে কিছু সময় কাটালে রোগীদের রক্তের জন্যে হাহাকার কিছুটা নজরে পড়বে আপনার। এমন কি বিভিন্ন ব্লাড-ব্যাংক আর ছোটখাটো ক্লিনিক সেন্টার গুলতেও একই চিত্র দেখতে পারবেন একটু খেয়াল করলে। ভাবতেই কষ্ট লাগে রক্তের অভাবে রোগী মারা যায়। টাকা নিয়ে দাড়িয়ে থেকেও কোন কিছু করতে পারে না আত্মীয়-স্বজনেরা। অথচ এই জীবন বাঁচানো রক্ত গায়ে নিয়ে ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমরা। এই পরাজিত মুখগুলির পাশে বসেই হয়তো আড্ডা দিচ্ছি কোথাও কোথাও।

একটু সচেতন হলেই আমরা মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়ানো এমন হাজারো মানুষকে জীবনের আলোর পথ দেখাতে পারি। তাহলেই উপরের গল্পটার মত করে জীবনের গল্পেও পাব "Happy ending"







শুক্রবার, ফেব্রুয়ারী ২১, ২০১৪

হঠাৎ স্বপ্নে ছোট্ট ধাক্কা.....

শুভ আজ রাতে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে যাবে বন্ধুদের সাথে। বিকেলেই একটা তোড়া ফুল নিয়ে এসেছে সে, উপরে লেখা তাতে "আমরা তোমাদের ভুলবো না"। লাল রং দিয়ে লেখা রয়েছে কথাটা। সন্ধ্যার একটু পর রাহাত ফোন আসলো-
- ড্যুড! মিটআপ, হয়্যেন? হয়্যার??
- টাইমিং প্লানিং তো সব ফাহিম করছে ড্যুড, আস্ক হিম..
- ওকে, ওকে দেন বেরুচ্ছি কখন
- মে বি ৯টার পর, ফার্স্ট ফাহিমের বাসায় মিটআপ দেন ওর গাড়িতে করেই..
- থ্যাংস ড্যুড, সি ইউ সুন

কথা শেষ করে শুভ নীচে নামলো। ডাইনিং রুমে মা'য়ের সাথে দেখা-
- মম ফাহিম আর রাহাতের সাথে আজ শহীদ মিনারে যাবো।
- রাতে বাড়ি ফিরবে না?
- নো মম, ফুল দিতে দিতে তো অনেক সময় লেগে যাবে। তারপর একটু ঘুরবো। ফিরতে ফিরতে মর্নিং। ড্যাডকে কিছু বলো না প্লিজ।
- আচ্ছা, দ্রুত করে ফিরে আসিস তাহলে তোর বাবা উঠার আগেই।
- ওকে মম, থ্যাংকস।
- বেরুবি কখন? রাতে ডিনার করে না তার আগেই।
- ফাহিম তো শার্প এইট'ও ক্লক তার বাড়িতে থাকতে বলল। ডিনার নাকি ওর ওখানেই হবে। আমি এখুনি বেরুবো।
- আচ্ছা, সাবধানে থাকিস।

রুমে এসে গত পরশু কেনা ফতুয়া টা বের করলো শুভ। ফতুয়ার উপরে রক্ত ঝরা লাল রঙ। মাঝে কালো দেখতে গুলির চিহ্নের মত আর পাশে অ আ ক খ বর্ণমালা খচিত আছে। চমৎকার ডিজাইন, শুধু আজকের কথা চিন্তা করেই সে এটা কিনেছিল। আটটা বাজতে এখনো অনেক দেরি, ল্যাপটপটা কোলের উপর নিয়ে টুইটার চেক করলো। নতুন কোন নিউজ নেই তার জন্যে। তাই ফেসবুকে চলে আসলো টুইটার বাদ দিয়ে। সবাই যার যার প্রোফাইলে নিজেদের নামের প্রথম অক্ষর লাগিয়েছে। সেও লাগিয়েছে সবার মত করে। নাহ, ঐরকম এক্সাইটমেন্ট নিয়ে দেখার মত কিছু নেই এখানেও। বালিশের উপর মাথা এলিয়ে দিয়ে কিছু একটা চিন্তা করছিল।

তারপর ঘড়ির দিকে তাকাতেই চোখ কপালে তার। এত দ্রুত আটটা দশ কিভাবে হল, মাত্রই তো সে দেখল সন্ধ্যা ছয়টা চল্লিশের কাছাকাছি। দৌড়ে প্যান্ট পাল্টে, ফতুয়াটা গলিয়ে মোবাইল, মানিব্যাগ চাদর আর তোড়াটা নিয়ে নিচে নামলো সে। আশ্চর্য! এই সময় তো বাড়ি এত নিঝুম থাকে না আজকের মত। মা'কি তবে এখুনি শুয়ে পড়লো? যাক তাও ভালো কিছু বলে আর সময় নষ্ট করতে হল না, দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল সে। ফাহিমের বাড়ি বেশি দূর না, হেটেই যাওয়া যায়। তবে আজ দেরি করে ফেলেছে, তাই রিক্সা নিতে হবে। সামনেই রিক্সা পাওয়ার কথা তবে আজ কেমন যেন রাস্তাটা ফাকা এই সময়েই, মোড়ের চা'য়ের দোকানটাও বন্ধ। ছুটি পেয়ে মনে হয় আজ সবাই আগেই গন্তব্যে পৌঁছে গেছে, রিক্সাটা পেলেই হয় এখন। নাহ! একটা রিক্সা আছে দেখা যায়, ভাড়া বেশি চাইবে বুঝতে পারছে শুভ কিন্তু কি করার, যত দ্রুত সম্ভব তাকে ফাহিমের বাসায় যেতেই হবে। রিক্সা ওয়ালা হুড তুলে তার ভেতর বসেছে, বেশ আয়েশি ভঙ্গীতে পা দু'টো চালকের সিটে তুলে আরাম করছে।

শুভ রিক্সার সামনে দাড়িয়ে, কিন্তু কিছু একটা সমস্যা হয়েছে তার। ঠাণ্ডায় গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না তার। আজ ঠাণ্ডাও লাগছে বেজায় রকম। গায়ে চাদর জড়ানো, কিন্তু সেটা ঠাণ্ডা থামাতেই পারছেনা যেন। গলা চিড়ে যে একটা আওয়াজ করবে তার জো নেই। কিন্তু এ কি! একেবারেই যে আওয়াজ বের করতে পারছে না সে। কাশি দিয়ে নিজের গলায় হাত রেখে নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছে না সে। চিৎকার করে চলেছে মনের ভেতর কিন্তু আওয়াজ করে এতটুকু শক্তি যেন তার নেই।

হুডের ভেতর থেকে রিকশাওয়ালা বলে উঠলো-
কি মামা, কথা আটাকায় গেছে? হাতের ফুল আর আর ফতুয়া পইড়া আর কত দিন এইভাবে ভাষার লাঞ্ছনা করবেন মামা? তারচেয়ে এই ভালা, কথা কওনের শক্তি আপনেগোর বন্ধ হইয়্যা যাক এক্কেরে। ঐরকম আধা বাঙ্গালি হওনের চেয়ে অবাঙ্গালি হইয়্যা যান আর নাইলে এইরকম কইরা বোবা হইয়্যা যান। তাতে অন্তত আমাগোর "বাংলা" শান্তি পাইব।
তারপর হুট করে পা নামিয়ে রিক্সার হুডের ভেতর থেকে লোকটা তার দু'হাত বের করে শুভ'র গলায় চেপে ধরল। শুভ চিৎকার করে দু'হাত ধরে রিক্সা ওয়ালার হাত তার গলা থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু, কোন লাভ হচ্ছে বলে মনে হল না। উল্টো লোকটার হাতের চাপ বাড়তে থাকলো। দম যেন ফুরিয়ে আসছে শুভ'র.......




একবারে ঘেমে নেয়ে ঘুম ভাঙ্গল শুভর। পরনের টি'শার্টটা একেবারেই ভিজে জবজব অবস্থা। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই দেখল সময় মাত্র সাড়ে সাতটা। গলায় হাত বুলিয়ে কাশি দিলো শুভ। কি ভয়ানক স্বপ্ন দেখল সে এটা। ধুর এমন কিছু হয় নাকি? আজকের দৌড়াদৌড়িটা মনে হয় একটু বেশি হয়ে গেছে। তার উপর বাংলা ভাষা নিয়ে স্যরের ল্যাকচারটাই এমন করেছে। ফাহিমকে বললে নির্ঘাত সে এটা সবাইকে বলে বলে জ্বালিয়ে মারবে। ধুর! এত ভাবার সময় নেই। এবার উঠতে হবে, দ্রুত রেডি হয়ে ফাহিমের বাসা তারপর শহীদ মিনার আর শেষে বন্ধুদের সাথে ঘুরাঘুরি....





বুধবার, ফেব্রুয়ারী ১২, ২০১৪

••••••••••••• একটি লাইনের গল্প •••••••••••••

প্রীতম, কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ভার্সিটিতে অবস্থান। পাবলিকে কোথাও হয়নি তাই সময় নষ্ট না করে প্রাইভেটেই নাম লিখিয়েছে। বাবা-মার আদরের সন্তান তাই সবসময় প্রাপ্তি গুলি চাহিদা তৈরির আগেই পূর্ণতা পেয়ে গেছে। তবে বাবা মায়ের কড়া নজর, ছেলে যাতে বাইরে আড্ডা না জমায়। কারণ, আজকাল তো আড্ডা দিতে গিয়েই সিগারেট, হেরোইনের আর ফেন্সিডিলের মত নেশার কবলে পড়ে ছেলেপেলে। তাই প্রয়োজনের বাইরে যাতে বাইরে সময় না দেয় সেদিকে খুব কড়াকড়ি অবস্থান।

কি আর করার? ভার্সিটি ক্লাস শেষে সোজা বাসায় অবস্থান নেয় প্রীতম। গান শুনে, বই পড়ে আর টুকটাক এক্সপেরিমেন্টের নামে কাগুজে তৈরি বিদঘুটে জিনিষ পত্র তৈরি করে দিন ভালোই কাটছিল তার। একদিন তার ক্লাসমেট পরিচয় করিয়ে দিল আরো একটা সময় কাটানো মাধ্যমের সাথে, পরিচয় করিয়ে দিলো “ফেসবুক” এর সাথে। যেখানে সে ঘরে বসেও দুনিয়ার অপর প্রান্তে অবস্থান নেয়া বন্ধুটার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে। পারবে আড্ডা দিতে একা ঘরে বসে হাজার বন্ধুদের সাথে।

প্রথম কদিন এটা সেটা বুঝে সময় কাটালেও খুব দ্রুতই সে ফেসবুক কে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসলো। এখন আর গান শুনে বা বই পড়ে সময় কাটাতে হয় না তার। চেয়ারে বসে বা খাটে শুয়ে ল্যাপটপটা কোলে নিয়েই সে সময় কাটাতে পারে ফেসবুকে। এখানে কদিনেই তার অনেক পরিচিতি হয়ে গেছে। মাস তিনের মধ্যেই কয়েকটা বড় গ্রুপে তার ভালো একটা অবস্থান তৈরি করেছে আর ফ্রেন্ড-লিস্টে পরিচিত অপরিচিত সহ প্রায় দু’হাজার বন্ধু জোগাড় করে ফেলেছ। এখন প্রায় প্রতি রাতেই ক’জন মিলে সেই আড্ডা জমে এখানে।

ইলার সাথে এখানেই কোথাও পরিচয় হয় প্রীতমের সাথে। আড্ডায় আড্ডায় খুব ভালো বন্ধুত্বও তৈরি হয়। আর তারপর আড্ডার পাশাপাশি চলে ইন-বক্সে কথোপকথন। আড্ডা গড়ায়, সাথে বেড়ে চলে ইন-বক্সের মেসেজের সংখ্যা। অবস্থা এমন যে আড্ডায় কেউ থাকুক বা না থাকুক ইন-বক্সে অন্তত একজনের ‘হাই’ বলতেই হবে। কদিন বাদে ইন-বক্সের আলাপ দূরালাপনিতে গিয়ে বসে। কি হয় না সেখানে? কোথায় আছে, কি করছে, পড়ছে নাকি টিভি দেখছে সব আলাপই চলে এখন। সমস্যা কি? বন্ধু তো, বলতেই পারে। খারাপ তো কিছু করছে না….

সমস্যা হল প্রীতমের। এতদিন সে আসলে ঐ অর্থে মেয়েদের সাথে সরাসরি এভাবে যোগাযোগের সুযোগ পায়নি কখনো। বয়েজ স্কুল, তারপর বয়েজ কলেজ আর শেষে তার ভার্সিটির ডিপার্টমেন্টে হাতে গোনা ক’জন মেয়ে থাকায় সে আসলে ঐ অর্থে তাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগের কোন মাধ্যম পায়নি এর আগে। এর আগে মানে এই ইলার সাথে পরিচয় হবার আগে। মেয়েদের নিয়ে আগে যেটা ফ্যান্টাসি ছিল এখন তার অনেক কিছুই বুঝতে পারে এই ইলার মাধ্যমেই। কিন্তু প্রীতমের মন ইলাকে বন্ধু থেকেও বেশী কিছু মনে করতে শুরু করেছে এখন। কিন্তু ভয় হয়, ইলা যদি এটা জেনে তার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা নষ্ট করে দেয়। এই ভেবে সে আর ইলাকে কিছু বলার সাহস করে না।

গতরাতে হঠাৎ করে ফেসবুকের কল্যাণে জনতে পারলো যে “প্রপোজ ডে” নামেও একটা আলাদা দিন আছে। দিনভর খুব চিন্তা করলো প্রীতম। বলবে, বলবে-না, করবে, করবে-না করতে করতে যখন দিন গড়িয়ে বিকেল তখন ঝোঁকের চোটেই ইলাকে ইন-বক্সে বলল “ইলা, ভালবাসি, তোমাকেই ভালবাসি”। লিখেই ফেসবুক বন্ধ করে দিল। প্রচণ্ড টেনশন হচ্ছে তার ইলা এই মেসেজ দেখে কি বলবে, তার রি-একশন কি হবে, আর প্রতি-উত্তরটা কি প্রত্যাখ্যানের হবে; নাকি সম্মতির। ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। আচ্ছা ভালো কথা, এত সময় পার হয়ে গেল নিশ্চয় এর মাঝে ইলা মেসেজটা পড়েছে। তাহলে ফোন দিচ্ছে না কেন? তাহলে কি……

অবশেষে অনেক আকাঙ্ক্ষা আর টেনশন নিয়ে ফের ফেসবুকে লগইন করলো প্রীতম। সবার আগেই ঢুকল মেসেজ বক্সে। ইলার মেসেজটাই সবার উপরে। তবে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। ক্লিক করলো তাকে প্রীতম। ইলা একটা লম্বা মেসেজ দিয়ে গেছে তাকে। আর মেসেজটা দেবার পর ইলা তার আইডি বন্ধ করে দিয়েছে। হ্যাঁ, প্রীতম ইলার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ইলার অত বড় মেসেজটা বার ৩ পড়ার পর যেটা প্রীতম বুঝল, ইলা আসলে সত্যিকার অর্থেই তাকে বন্ধু ভেবে তার কথা গুলি শেয়ার করেছিল এতদিন। ইলাও তার মত বদ্ধ ঘরে মানুষ। তবুও সে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায়নি। আর প্রীতমও যে তার নিয়ন্ত্রণ হারাবে তা কল্পনা করতে পারেনি। এটা নয় যে ইলা এটাই প্রথম কারো কাছ থকে প্রপোজাল পেয়েছে। কিন্তু প্রীতম এটা করবে সে তা কল্পনাও করতে পারে নি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই প্রপোজালের রাস্তাটাই বন্ধ করে দিবে। আর তাই সে তার পুরাতন মোবাইল নাম্বার পাল্টে নিবে আর তার এই ভার্চুয়াল পরিচয়টাকে মুছে দিবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

হ্যাঁ, ইলার মেসেজের যে স্থানে এতদিন ইলার ছবিটা দেখা যেত সেটা এখন মেয়ে আকৃতির একটা এভাটারে রূপ নিয়েছে। আর তার নামটা নীল অক্ষর থেকে কালো অক্ষরে পরিণত হয়েছে। প্রীতমের মাত্র একটা লাইন তার বিশ্বাসকে নষ্ট করেছে এই ভার্চুয়াল জগত থেকে.....







শনিবার, নভেম্বর ৩০, ২০১৩

নীরা, তোমার অপেক্ষায়.....



নীরা, তোমাকে তো বলা হয়নি। তোমার জন্যে ঐ দিন স্টেশনে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম। মিন্টু বলেছিল তুমি নাকি বাড়ি আসছো। আমি সেই শীতের রাতে প্লাটফর্মে বসেছিলাম তোমার জন্যে। জানো রাতে বেকার সময়টাতে প্লাটফর্মে তেমন কেউ থাকে না। তবে একেবারেই যে থাকে না তা কিন্তু নয়। আমাদের স্টেশনটা ছোট। গ্রামের স্টেশন অতবড় হয় না। কিন্তু তারপরও দেখলাম কয়েকটা বৃদ্ধ আর বেশ কিছু টোকাই গোছের বাচ্চা ছেলে এক কোনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছে। একটা পরিবারও মনে হয় আছে সেখানে। এই শীতেও তারা কি করে ঘুমুচ্ছে তা আসলেই চিন্তা করার মত বিষয়।

ভুল হয়ে গেছে নীরা। আসলে বাংলাদেশের ট্রেন গুলি যে সময় মত আসে না তা আমার জানা আছে। তবুও অনেক আগেই চলে এসেছি। আসলে তুমি আসছো এইটা শুনে আর অন্য কোথাও অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করছিলো না। এখন মনে হচ্ছে একটা বই নিয়ে আসার প্রয়োজন ছিলো। গল্পে ডুবে থেকে তোমার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকায় হয়তো সময়টা মন্দ কাটতো না। কিন্তু দ্রুত চলে আসলাম, মনেই ছিল না একটা বই সাথে করে নিয়ে আসার কথা। আচ্ছা কোন বইটা নিয়ে আসতে চাইছি বুঝতে পেরেছ তো? সেই যে তুমি "অপেক্ষা" নামের একটা বই খুঁজতে গিয়েছিলে লাইব্রেরিতে, সেই বইটা। আসলে অপেক্ষা করতে হচ্ছে তো তোমার জন্যে, তাই আজ ওটার কথাই মনে হচ্ছিল বার বার।

নাহ, আজ মনে হয় অনেক বেশীই দেরি হচ্ছে কোথাও। না হয় ট্রেন তো চলে আসার কথা এই সময়ের মাঝে। কি জানি? হয় তো ট্রেনই লেট ছিল আজ। তাই সব কিছুতেই লেট হচ্ছে। আর ঠাণ্ডাটাও মনে হয় বেড়েছে। লেট যেহেতু হচ্ছে তাই চিন্তা করলাম স্টেশনের বাইরে থেকে চা খেয়ে আসি। দিনের বেলায় হলে বাইরে যাবার ঝামেলা ছিলো না। ছোট ছোট কতগুলি বাচ্চা ছেলেই তো চা'য়ের ফ্লাস্ক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এক ইশারাতেই চা হাজির হয়ে যেতো। কিন্তু রাতের বেলাতে তো আর তা সম্ভব না। তাই স্টেশনের বাইরে যেতেই হবে।

বাইরে বেরিয়ে দেখি এই রাত দুপুরেও একটা হোটেল খোলা রয়েছে। আর হোটেল দেখেই খিদেটা টের পেলাম। গিয়ে দেখি দোকানি আর দুইটা ছেলে আছে হোটেলটাতে। অলস সময় পার করছে। তারাও আমার মত অপেক্ষা করছে ট্রেনটার। অল্প কিছু সময়ের জন্যে ট্রেনটা থামলেও এর মাঝেই অনেকে চলে আসে এখানে পেট-পূজা করতে। অন্য সময় হলে ছেলে দুইটার যে কোন একজন দৌড়ে আসতো কি খাবো তা অর্ডার নিতে। কিন্তু এখন তাদের কোন ব্যস্ততা দেখছি না। একবার আমার দিকে তাকিয়ে দেখেই আগের মতই নিজেদের মাঝে আলাপ করছে তারা। আলাপ করার ভঙ্গি দেখে মনেই হবে না শীতের রাত জেগে থাকার কোন দুঃখ আছে এদের কারো।

ক্যাশে বসে থাকা লোকটাই জানতে চাইলো কি লাগবে। তাকে জিজ্ঞাস করলাম কি পাওয়া যাবে এখন। জানালো রুটি-পারোটা, মোঘলাই, ডিম ভাজি, আর সবজি হবে এই মুহূর্তে। খিদেটা আরো একটু বাড়লো কিন্তু হুট করে ট্রেন চলে আসলে তোমাকে এক পলক দেখার চান্সটা মিস হবে তাই বললাম একটা মোঘলাই আর চা দিতে। শুনে সে নিজেই মোঘলাই তৈরি করতে গেলো ক্যাশ ফেলে, ছেলেদের ডেকে আর বিরক্ত করলো না। আমি সামনের দিকের একটা টেবিলে বসে স্টেশনের দিকে চেয়ে আছি। দ্রুতই সে মোঘলাই দিয়ে গেলো। তার কাছে জানতে চাইলাম রাতের ট্রেনটা কখন আসে। জানালো এই সময়ের মাঝে চলে আসার কথা। হয়তো কোথাও দেরি হয়ে গেছে, তাই আজ লেট। তবে খুব দ্রুতই চলে আসবে বললো।

ট্রেন হুট করে চলে আসতে পারে ভেবে যত দ্রুত পারি খেয়ে নিলাম। তারপর প্লাস্টিকের কাপে চা নিয়ে বিল মিটিয়ে আবার এসে বসলাম প্লাটফর্মের টুলটাতে। চারদিক অন্ধকার আর প্লাটফর্মের অল্প আলোয় চারদিক আরো বেশী অন্ধকার মনে হচ্ছিলো। চা'টা শেষ করেও ট্রেনের দেখা পেলাম না। বসে অপেক্ষায় আছি আর মনে পড়ছে এভাবেই বসে থাকার কথা, তোমার পথ চেয়ে। সেই শীতের সকাল বেলায় অপেক্ষার কথা, তোমার কলেজে যাওয়ার পথে। সময়গুলি কত দ্রুত চলে গেলো। তুমি কলেজে পড়া শেষ করে ভার্সিটি ভর্তি হলে। ঢাকা চলে গেলে হোস্টেলে। আর আমি এখনো তোমার অপেক্ষায় বসে আছি এই নির্জনে......







বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২৮, ২০১৩

এখনো তোমার অপেক্ষাতেই আছি....



ঐ সেদিন থেকে অপেক্ষা করছি। যেদিন বলেছিলে, তোমার পক্ষে এইসব পাগলামি আর সহ্য করা সম্ভব নয়। তোমাকে কিছুই বোঝাতে পারি নি সেই দিন। শুধু জানতে চেয়েছিলেম, কখনো পাগলামিটা একটু কমিয়ে দিলে ফিরে আসবে কি না? তুমি তার প্রতি উত্তরে কিছুই বলনি আমায়...

ঐ সেদিন থেকে অপেক্ষা করছি। যেদিন তুমি কালো ঐ ট্যাক্সিতে চড়ে উঠলে, আর তা চলতে শুরু করলো। আর একবারও পিছু ফিরে তাকালে না তুমি। আমি এই একা ঘরটাতে একলা কিভাবে সময় কাটাবো তাও একবার ভাবলে না। আমি শুধু দাড়িয়ে দেখছিলাম, দেখছিলাম তোমার চলে যাওয়া টা। ঠিক সেই দিন থেকে অপেক্ষা করছি.....

এখনো অপেক্ষাতে আছি। জানি, তুমি ফিরে আসবে না। কারণ কেউ কোন দিন ঐ অবস্থা থেকে ফিরে আসে নি। আর ফিরে আসবে বলে এখনো কেউ আমাকে মিছে সান্ত্বনা দেয় নি। বলেছিল ভুলে যেতে। বলেছিল নতুন করে সব শুরু করতে। একেবারে শুরু থেকে শুরু করার কথা অনেকেই উপদেশ আকারে দিয়েছিল। কিন্তু কি করে শুরু করি বল? ঐ শুরু করাটা যে একমাত্র তোমার সাথেই করতে পেরেছিলাম। আর কারো সাথে তো শুরু থেকে শুরু হবে না। হলে সেটা হবে এক অধ্যায়ের শেষের থেকে কিছু একটা। কিন্তু আমি তো অধ্যায়টা শেষ করতে চাই না। তারচেয়ে বরং তোমার অপেক্ষাটাই ভালো.......

আমি এখনো অপেক্ষাতে আছি। অপেক্ষাতে আছি তোমার সাথে আরো কিছু সময় কাটাবার। পাগলামি করে তোমাকে রাগিয়ে দিয়ে তার আনন্দ নেবার। মাঝে মাঝে কিছু অবাধ্য আকাঙ্ক্ষা তোমাকে বলার। লোক চক্ষুর তোয়াক্কা না করে তোমার হাত জড়িয়ে রাজপথে হেঁটে হেঁটে বৃষ্টিতে ভেজার।

জানি তুমি আসবে না। ফিরে আসতে পারলে তুমি এদিনে চলে আসতে। ছোট্ট একটা দুর্ঘটনা তোমাকে আমার কাছে থেকে অনেক দূরে নিয়ে গেছে। দূরত্ব টা তোমার অভিমান থেকেও বাড়িয়ে দিয়ে গেছে হাজার গুন করে......

কিন্তু কি জানো?
আমি এখনো তোমার অপেক্ষাতেই আছি.......





বুধবার, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৩

অচেনা সেই মেয়েটি...

বাস স্টপেজে বসে ছিলাম। আসলে জ্যামের কারণে এখন প্রায় ঘণ্টা খানেক হতে চলল বাসের দেখা নেই। রাস্তায় নাকি পানি উঠে কোথায় ভেঙ্গে গেছে তাই বিশাল জ্যাম লেগেছে। আর এমন জায়গায় এসেছি যে রিক্সা বা টেম্পো যোগে একটু এগিয়ে গিয়ে বাসে উঠবো তা ও না। যেখানেই যাই না কেন আমাকে অপেক্ষা করতে হবে এই স্টপেজ থেকে ছাড়ে যাওয়া বাসের জন্যে। তাই বসে আছি, পাশে আরো প্রায় ১২জন আছে বসে। আর সামনে আছে আরো ২০-২৫জনের মত দাড়িয়ে। আর সবাই অপেক্ষা করছি একটা নির্দিষ্ট বাসের জন্যে।

অপেক্ষা করছি আর নিজের উপর বিরক্ত হচ্ছি। কি দরকার ছিল আজ বেরুনোর! খালামনি তো বার বার করে বলল আরো একটা দিন থেকে যা। থেকে গেলেই পারতাম। কিন্তু তখন শুধু বাড়ির কথা আর আসাদ, সুমনের সাথে আড্ডা দেবার চিন্তাই বার বার মাথায় আসছিলো। তাই খালামনির অমতেই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আর এখন এতদূর এসে বাসের জন্যে বসে থাকতে হচ্ছে। কোন মানে হয়?

সময় কাটাতে না পেরে শেষে একটা পত্রিকা নিলাম হকারের কাছ থেকে। আমাদের মত এই হকারও আজ অপেক্ষা করছে বাসটির। চুপ করে বসে আছে হাতে পেপারের বোঝা নিয়ে। আমি তার কাছ থেকে পেপার চাইলাম, তাতে তার একটু আনন্দিত হবার কথা, বসে থেকেও সে পেপারটা বিক্রি করতে পারছে বলে। কিন্তু সে পেপার চাওয়ায় কিছুটা বিরক্তই হল মনে হয়। তবুও বের করে দিল একটা পেপার তার হাতে রাখা পেপারের বোঝা থেকে। আমি দাম মিটিয়ে দিয়ে পেপার পড়তে মনোনিবেশ করলাম।

প্রথমে পেইজের রাজনীতির আলাপ আলোচনা দেখতে ইচ্ছে করলো না, তাই চলে গেলাম খেলার খবরের অংশে। সেখান থেকে একটু দেখে আবার গেলাম বিনোদন পেইজে। সেখানেই ছিলাম, হঠাৎ একটা কণ্ঠ শুনে পেপার থেকে বাইরে নজর দিতে হল। একটা মেয়ে, রিকসাওয়ালার সাথে কথা কাটাকাটি করছে। পরনে স্কুল ড্রেস আর হাতে ব্যাগ। রিকশাওয়ালার সাথে ভাড়া বেশি চাওয়ার জন্যে কথা কাটাকাটি করছে সে। সবাই দেখছে, তবে কেউ কিছু বলছে না। আর আমিও এখানকার ভাড়া নিয়ে এত জানি না তাই আবার পেপার পড়ার চেষ্টা করলাম।

কিন্তু কোথায় যেন আটকে গেছি। পেপারের দিকেই চেয়ে আছি তবুও কি পড়ছি তা বুঝতে পারছি না। আবার প্রথম থেকে নিউজটা পড়তে চেষ্টা করলাম। নাহ, হচ্ছে না। একটা কথাও মাথায় ঢুকছে না। মন অন্যকোথাও আটকে গেছে। আর কোথায় আটকে গেছে তা বুঝতে পেরে একটু নিজের ভেতরেই লজ্জা হল। একটা মেয়েকে একবার দেখাতেই মাথায় ঢুকে গেল এই ভেবেই লজ্জাটা পাচ্ছি। একটু রাগও লাগছে নিজের উপর। তবে মেয়েটার চেহারায় একটা কিছু আছে। যা আমাকে আবার মেয়েটার দিকে তাকাতে বাধ্য করলো।

তবে এইবার কেন জানি সরাসরি তাকাতে সাহস পেলাম না। পেপারটাকে সামনে ধরেই একটু নিচু করলাম, আর আড়চোখে দেখলাম তাকে। সাদা স্কুল-ড্রেসে তাকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। তবে বেশিক্ষণ তাকাতে পারলাম না চোখাচোখি হয়ে যাবার ভয়ে। পেপারটা আবার চোখের সামনে ধরে নিলাম। কিন্তু আর পড়া হল না।

মেয়েটা এবার আমার দিকে পেছন ফিরে রাস্তার দিকে মুখ করে দাড়িয়ে আছে। তাই তার চেহারা আর আড়চোখেও দেখতে পরছি না। একটা লোভ লেগে গেছে মনে তার চেহারাটা আরেকবার দেখার জন্যে। তাই পেপারটাকে ভাজ করে ঘড়ি দেখলাম আর মাথা নাড়লাম। একটু অভিনয় করলাম অনেক সময় বসে থেকে বোর হয়ে গেছি কিন্তু বাস আসছে না, তাই দেখিয়ে। দাড়িয়ে আমার পায়ের কাছে রাখা ব্যাগটা কাঁধে ঝোলালাম। তারপর গিয়ে মেয়েটার থেকে একটু দূরত্ব রেখে দাড়িয়ে রাস্তার এদিক ওদিক দেখলাম যেন বাসটার দেখা পাওয়া যায় কিনা তাই দেখছি। আসলে তো মেয়েটার ঐ মায়া ভর্তি চেহারাটাই দেখতে এসেছি। আড়চোখে তাই দেখে নিলাম আরো একবার। তবে সুবিধা হল, মেয়েটা আমার বামে দাঁড়িয়ে আছে। আর সেদিক থেকেই বাসটা আসবে। আর আমি রাস্তার দিকে তাকালে তাকে দেখতে পারি অনায়াসেই।

একবার দুইবার দেখলাম ঠিকই। কিন্তু শেষে তার চোখে ধরাই পড়ে গেলাম। স্পষ্টই বুঝতে পারলো আমি তার দিকেই তাকিয়ে আছি। তবে সাথে সাথে দৃষ্টি অন্যদিকে নিয়ে গেলাম। কিন্তু ততক্ষণে মেয়েটা যা বোঝার বুঝে গেছে। আমি আর লজ্জায় ঐদিকে তাকাতে পারছি না। তাই অপরদিকে তাকিয়ে আছি। খুব ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তার দিকে বা রাস্তার দিকে তাকাতে পারছি না। এরই মধ্যে হুট করে বাসটা চলে আসলো।

সবাই গাড়িতে উঠার জন্যে হুড়মুড় করে বাসের গেইটে ভিড় জমালো। ছোট্ট একটা জটলা পাকিয়ে গেছে সেখানে। আমি এখনো দাড়িয়ে আছি, দাড়িয়ে আছে মেয়েটাও। বুঝতে পারছি না সে আসলে এতক্ষন এই বাসটার জন্যেই অপেক্ষা করছিলো কি না। যখন ভিড় প্রায় কমে এসেছে বাসের দরজার সামনে তখন ব্যাগ কাঁধে ঐদিকে এগুলাম।

নাহ মেয়েটা এগুচ্ছে না। তারমানে সে এই বাসটার জন্যে অপেক্ষা করছে না, সেটা নিশ্চিত। আমার আরো কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সেটা সম্ভব না। বেহায়াপনারও একটা সীমা আছে, আর দাঁড়ালে সেটা অতিক্রম হয়ে যাবে। তাই বাসে চড়ে উঠলাম। মন চাইছিল মেয়েটার নাম-ঠিকানা জেনে আসতে। কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব? আর কেনই বা বলবে সে, আমার মত অপরিচিত একটা ছেলেকে তার নাম-ঠিকানা?