অনু গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
অনু গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ০৩, ২০১৬

আত্মহত্যার প্রভাবন



কথায় মানুষ খুব দ্রুত প্রভাবিত হয়, তবে সবার কথায় না। কিছু কিছু মানুষ আজীবন শুধু বলেই যায়, তাদের কথা কেউ বিশেষ কর্ণপাত পর্যন্ত করে না। কিন্তু এই কিছু মানুষের বাইরে আরও অল্প কিছু মানুষ থাকে, যাদের দীর্ঘশ্বাসও মানুষের মনে বিশেষ অর্থ জাগিয়ে তোলে। ঠিক কী কারণে কিংবা কেন এমনটা হয় তার সঠিক কোন ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব না। এমন না যে তারা দেখতে সুদর্শন কিংবা তাদের কণ্ঠ সুমধুর বলেই এমনটা হয়। অথবা তাদের চিন্তাভাবনা অন্য সকলের তুলনায় অনেক অনেক ভিন্নতর হয়, এমনও নয়। তারাও আর দশজন সাধারণের মতই চিন্তাভাবনা করে একদম সাধারণ কথাই বলে। তবুও এই সাধারণ কথাই অন্য সকলের কাছে অসাধারণ কিছু হয়ে উঠে।

এরকম একটা হিসেব কষে যদি ভাবা হয় তবে আমাকেও সে তালিকার একজন ধরা যেতে পারে। অবশ্য এর কৃতিত্ব একক ভাবে আমার নয়। এই ব্যাপারটার সাথে বংশানুক্রমিক জিনের কোন একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। একদম নিশ্চিত না হলেও আমার জন্যে এমনটা ভাবা একদম অমূলক বলা যাবে না। কারণ জ্ঞান হবার পর থেকেই দেখেছি আমার বাবার কথায়ও মানুষ খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তার কোন একটা সিদ্ধান্ত বিনাবাক্যে সকলে মেনে নেয়। তার উত্তরসূরী হিসেবে আমার কথাতেও মানুষের গুরুত্ব কিংবা প্রভাবিত হবার ব্যাপারটা আমাকে কখনোই তেমন অবাক করত না।

হ্যাঁ, একটা সময় পর্যন্ত সত্যিই এই ব্যাপারটা আমায় মোটেই অবাক করত না। কিন্তু সব পরিবর্তন হয়ে গেল ছোট একটা দুর্ঘটনা ঘটবার পর। ঠিক কি কারণে জানা নেই, একদিন বিকেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবার সময় শিমুল যখন ওর গার্লফ্রেন্ডের প্যারা নিয়ে আক্ষেপ করছিল তখন বলেছিলাম- 'তোর উচিৎ সিলিং ফ্যানের তিন পাখায় তিনটা গামছা বেধে ঐ তিনটা একত্রে করে একটা ফাঁস বানিয়ে তারপর তা গলায় গলিয়ে ঝুলে পরা'। 

ব্যাস ঐ ওটুকুই কথা, আসলে আমরা প্রতিদিন ওর ঐ এক ঘ্যান ঘ্যান শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই কিছুটা বিরক্ত আর মজা করার জন্যেই ও কথা বলেছিলাম। বাকি সবাইও ঐ মজার কথাটাকে মজা ধরে নিয়েই ওকে ক্ষেপাচ্ছিল। কেউ কেউ ঐ অবস্থাতে সেল্ফি তুলে ওর গার্লফ্রেন্ডকে পাঠানোর আইডিয়া দিচ্ছিল, আবার কেউ বলছিল গার্লফ্রেন্ডকে উদ্দেশ্য করে সুসাইড নোট লিখে তারপর ঝুলে যাবার জন্যে।

এরপরই দ্বিতীয় ভুলটা করলাম; অবশ্য তখন ওটাকে কোনভাবেই আমার ভুল মনে হচ্ছিল না। বললাম- 'সবচেয়ে ভালো হয় তুই যদি ঝুলে যাবার পুরো ব্যাপারটা লাইভ করে দেখাস, তাতে জনগনের সাপোর্ট আর গার্লফ্রেন্ডের উপর প্যারার রিভেঞ্জ নেয়া, দুটোই হয়'। আর যায় কোথায়, সকলেই আমার আইডিয়াকে বাহ্‌বা দিতে দিতে শিমুলকে এই কাজ করার জন্যেই কথার খোঁচা মেরে যাচ্ছিল।

তারপর সন্ধ্যাটা ওভাবে শেষ করে যে যার বাসায় কিংবা মেসে ফিরে গেলাম। খুব ঘুম পাচ্ছিল বলে ফিরে এসে ফ্রেশ হয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই ঘুম ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে একদম রাত আড়াইটা! মোবাইলটা সাইলেন্ট করা ছিল, তাই কিছুই টের পাই নি। স্ক্রিনে দেখলাম মিসকলের বিশাল এক নোটিফিকেশন লিস্ট দেখা যাচ্ছে। ৮৬টা মিস কল সেখানে! এক একজন গড়ে ৬~৭ বার করে কল করেছে। সবার উপরের নাম্বারটা ছিল সুমনের। তাই ওকেই কল ব্যক করলাম। রিং পুরোটা হবার আগেই ও প্রান্ত থেকে কলটা রিসিভ হয়ে গেল!

খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে সুমন বলল- 'দেখেছিস?'। সুমনের এই উত্তেজনার জন্যে ওর সাথে কথা বলাই দুস্কর। ছোটখাটো থেকে শুরু করে গুরুতর সব কিছুতেই ওর সীমাহীন উত্তেজনা কাজ করে। তাই বোঝা দুস্কর কোনটা আসলে উত্তেজিত হবার মত ঘটনা, আর কোনটা সাধারন। তাই প্রশ্নের বিপরীতে ওকে প্রশ্নই করতে হল-'কী?'
- কী মানে? তুই এখনো দেখিসনি? কোথায় তুই? কই ছিলি এতক্ষণ?
- আরে ব্যাটা ঘুমাচ্ছিলাম। এখন বল কি দেখবো? হয়েছে টা কি?
- তার মানে তুই কিচ্ছু জানিস না?
- আরে এত্ত না পেঁচিয়ে কি দেখব, আর কি জানতে হবে সেটা বলতে পারিস না?
- তুই দ্রুত ফেসবুকে লগইন কর, আর শিমুলের ওয়ালে ঢু মেরে আমাদের গ্রুপ চ্যাটে দেখ।
বলেই কলটা কেটে দিল। ব্যাটা আহাম্মকের আহাম্মক, কি হয়েছে সেটা না বলে আমাকে বলে কিনা ফেসবুকে ঢুকতে। তবে শিমুলের কথা বলায় একটু আগ্রহ হল। বিকেলেই গার্লফ্রেন্ডের প্যারা নিয়ে কান্নাকাটি করছিল। মনে হয় এবারে ব্যাটা ব্রেকআপ-ট্রেকআপ কিছু একটা করে ফেলেছে। আর সেটা নিয়েই সুগভীর কোন পোষ্ট দিয়ে বসে আছে ফেসবুকে। অবশ্য এমনিতেও এখন আমি ফেসবুকেই ঢু মারতাম।

ফেসবুক এ্যাপটা চালু করে শিমুল নামটা সার্চ দিয়ে ওর প্রোফাইলে গলাম। সেখানে একটা লাইভ ভিডিওর পোষ্ট রয়েছে। অবশ্য এখন আর লাইভ নেই, প্রায় ঘন্টাখানিক আগে সেটা শেষ হয়েছে। এখন ওটার ভিডিওটা পোষ্ট হিসেবে রয়ে গেছে। ব্যাটা নিশ্চিত গার্লফ্রেন্ডের প্যারার বর্ণনা দিয়ে কান্নাকাটি করতে করতে বিশাল কোন ইমোশনাল লাইভ ভিডিও করেছিল। ক্লিক করলাম ভিডিওটাতে, কিন্তু ক্লিক করে যা দেখলাম সেটার জন্যে আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।

শিমুল প্রথমে ক্যামেরাটা ওর রুমের বুকসেলফের কোথাও সেট করল, মোটামুটি ঐ পজিশন থেকে ওর রুমের বিশাল একটা অংশ তাতে স্ক্রিনে চলে আসে। এরপর একটু দুরত্বে দাড়িয়ে শুরু করল ওর গার্লফ্রেন্ডের প্যারার বন্দনা। এতটুকু অবশ্য আমি আশা করেই রেখেছিলাম। কিন্তু ঐ অবস্থাটা বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হল না, কথার মোড় ঘুরে গেল আমার নাম উচ্চারণের সাথে সাথে। নাম ধরেই বলল আজ বিকেলে কি আইডিয়া দিয়েছিলাম ওকে, আর সেই আইডিয়াই সে এখন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে বলে ঘোষনা করল!!

তারপর বিছানার উপর হতে কিছু একটা তুলল, হাতে নেবার পর বুঝলাম ওগুলি আসলে গামছা। ওর স্টাডির চেয়ারটা বিছনার উপর তুলে তার উপর ও দাড়াল। এরপর ঠিক যেভাবে বলেছিলাম ওভাবেই তিনটি গামছা সিলিং ফ্যানের তিন পাখায় বাধল। আর তারপর গামছা গুলি একত্র করে ওটা দিয়ে একটা ফাঁস তৈরি করল। আমি নিশ্বাস চেপে ওর কাণ্ডকারখানা দেখছি। তবে মনে মনে ক্ষীণ একটা আশা চেপে ধরে আছি যে শেষ পর্যন্ত ও আসলে ওরকম কিছু করবে না।

তারপর আবার চেয়ার হতে বিছানা আর বিছানা হতে নেমে স্ক্রিনের সামনে এসে দাড়াল। সত্যি সত্যি এর পরে যা কিছু ঘটবে তার জন্যে সকল দায়ভার ও ওর গার্লফ্রেন্ডের উপর দিল আর আমাদের সবাইকে বিদায় জানাল।
এবার আমি সত্যি সত্যি ঘামতে শুরু করলাম। অন্য মোবাইলটা দিয়ে ততক্ষনে আবারও সুমনকে ফোন করতে শুরু করেছি। রিং হচ্ছে কিন্তু ব্যাটা এখন আর ফোন উঠাচ্ছে না। আর এদিকে মোবাইল স্ক্রিনে দেখছি শিমুল আবারও বিছানার উপর দাড় করানো চেয়ারটাতে উঠে দাড়িয়েছে। এরপর কাঁপা কাঁপা হাতে তিন গামছা দিয়ে তৈরি ফাসটা গলায় পড়ে নিচ্ছে।

গামছার ফাসটা গলায় গলিয়ে দেবার পর ঐ অবস্থাতেই চিৎকার করে বলল- "দোস্ত তোকে ধন্যবাদ চমৎকার এই আইডিয়াটা দেবার জন্যে"। এরপর বাকিটুকু আর দেখা হল না, হাত থেকে মোবাইলটা খসে পড়ল আপনা-আপনি।



তারপর কিভাবে কি হয়েছে তা আর আমি তেমন পরিস্কার ভাবে বলতে পারছি না। ঘোরের মাঝে সময়টা পার হয়েছে আমার। মাথাটা পুরো ঝিম মেরে ছিল পরের পুরোটাা সময়। তবে এখন মাথাটা আবার পরিস্কার ভাবে কাজ করতে শুরু করেছে। আর কিছুক্ষন পরেই কয়েকজন গার্ড আসবে আমাকে এই সেলটা থেকে নিয়ে যেতে।

ঠাণ্ডা মাথায় উদ্দেশ্যপ্রনেদিত ভাবে বন্ধুকে আত্মহত্যা করার নিমিত্তে প্রভাবিত করার জন্যে কোর্টে বিজ্ঞ বিচারক আমার 'মৃত্যুদণ্ডাদেশ' কার্যকর করার রায় দিয়েছেন.....




শুক্রবার, জুলাই ০১, ২০১৬

অদ্ভুতুড়ে 'ঢাকা-একা'



ঢাকা-একা। কথাটা একটু অন্যরকম মনে হলেও বাস্তবতায় একদম হাতে-নাতে মিলে যায় ঢাকা নামের এই শহরটাতে। এখানে দিনের শুরুতে যেমন হাজার মানুষ একসাথে চড়ে বেড়ায় তেমনি দিন শেষেও এক সাথেই ঝগড়া আর বাগড়া বাগাতে বাগাতে নীড়ে ছুটে চলে। এই যে একসাথে ছোটাছুটি আর বাগড়া দেয়ার উৎসব, তবুও এদের মাঝে থেকে যায় যোজন যোজন দূরত্ব। একসাথে বসে যতই হাসি ঠাট্টা আর চিল্লা-পাল্লা করুক না কেন, অর্থহীন ব্যাপার গুলি যে মনে খচখচ করতে থাকে, সে খবর কেউ কাউকে জানাতে পারে না। ঐ যে একটা দূরত্ব তাদের মাঝে, সেটাই তাদেরকে অনুমতি দেয় না এইসব বলে বেড়াবার। 

ঢাকা এবং একা। হ্যাঁ, এই একই সূত্রে সকলের মত আমিও ঐ মালায় গাঁথা। দিন নেই, রাত নেই কারণে-অকারণে আমি ছুটে বেড়াই আত্মীয়ের মত আচরণ করা এই অনাত্মীয়ের শহরে। মেস বাড়ির হাজার হৈ-হুল্লোড়, চিৎকার-চেঁচামেচি কিংবা বিশাল রকমের ঝগড়া অথবা দল বেধে মাঝে মাঝে বাজার করা এই সব কিছুর মাঝে বাদবাকি বাকি সবার মত আমিও একা।

এই যে মন খারাপের সন্ধ্যায় একা এতটা সময় ধরে এই ফুট ওভার ব্রিজটার উপর দাড়িয়ে আছি, কেউ কি আমাকে দেখছে? কেউ কি জানতে এসেছে সেই বিকেল থেকে এই এখানেই কেন দাড়িয়ে আছি? কেউ কি আসবে কেন ফিরে যাচ্ছি না তা জানতে? না, কেউই এসব নিয়ে ভাববে না, কারোই এই নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। সত্যি করে বলতে আমারও নেই। কে, কেন, কোথায়, কত সময় নিয়ে দাড়িয়ে আছে তা নিয়ে কেন আমি মাথা ঘামাব? আমি তো কেবলই ছুটবো, দায়হীন ভাবে চলবে সেই ছুটোছুটি।

দেখতে দেখতে শহুরে জীবনের ব্যস্ততা অনেকটাই কমে এসেছে, পাল্লা দিয়ে কমছে ছুটোছুটির পরিমাণও। যদিও এই শহর কখনোই ঘুমায় না। কেউ না কেউ, কোথাও না কোথাও, কোন না কোন কারণে ঠিকই ছুটে চলে। আর তার ছুটে চলায় জেগে থাকে শহরটা। মাঝে মাঝে ভাবি, শহরটা যদি একদিন জন্যে বিশ্রাম নিতে পালিয়ে যেত তবে কি হতো এই মানুষ গুলির!

রাস্তার জ্যাম কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। মাঝে মাঝে সাই সাই করে কিছু যান ছুটে যাচ্ছে। এই কয়েক ঘণ্টাই এই রাস্তাটার বিশ্রামের সময়। এরপর দিনের আলো ফুটলেই আবার শুরু হবে ছোটাছুটি, তাকে বয়ে বেড়াতে হবে ক্ষুদ্র থেকে দীর্ঘাকার সকল বাহন। আর সাথে করে পোহাতে হবে জ্যামের দাপট। সকলের সাথে রোদে পুড়বে, বৃষ্টি হলে তাতেও ভিজবে কিন্তু তবুও দিন শেষে দোষ সব তার ঘাড়েই চাপবে। অবাক হবার কিছু নেই; আমি, আপনি আর আমরাই বিভিন্ন অজুহাতে রাস্তাগুলির দোষ দিয়ে বেড়াই। বলে বেড়াই- 'ঐ রোডটাতে গেলেই জ্যামে বসে থাকতে হয়, রোডটাই কুফা'; 'আজিব এক রোড, সারাদিনই জ্যাম লেগে থাকে'; কিংবা 'কি এক রোড, এই টুকুন বৃষ্টিতেই হাঁটু পানি!'

চারিদিকেই মোটামুটি একধরণের নীরবতা বিরাজমান। পথচারীও কাউকে নজরে আসছে না। এসব ছাইপাঁশ যখন ভাবছি তখন নজরে পড়ল একজন লোক সিঁড়ি ভেঙ্গে ফুট-ওভার ব্রিজটাতে উঠে আসছে। সাধারণত এত রাতে কাউকে ফুট-ওভার ব্রিজ দিয়ে রাস্তা পার হতে দেখা যায় না। এর অবশ্য দুটো কারণ আছে। প্রথমত, রাতে রাস্তা প্রায় ফাকাই থাকে। যেখানে দিনের বেলা হাজারও ট্রাফিক আর গাড়ির ছুটোছুটির মধ্যে মানুষ রাস্তা পার হতে ফুট-ওভার ব্রিজ ব্যবহার করে না সেখানে রাতে ফাঁকা রাস্তা পেয়েও তা করতে যাবে, অন্তত এ দেশে তেমনটা ভাবাটাও বোকামি। তবে প্রথম কারণটার চেয়েও দ্বিতীয় কারণটা বেশি যুক্তিপূর্ণ। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের গভীরতা যত বাড়তে থাকে ফুট-ওভার ব্রিজ গুলি সাধারণ মানুষের জন্যে ততটাই অনিরাপদ হতে থাকে। ছিনতাই, মাদকাসক্তদের খপ্পরে পড়ার মত ঘটনা এখন এখানে নিত্যদিনের রুটিনের মত। মাথা ঘামাবার কেউ নেই, এড়িয়ে চলাই একমাত্র শান্তিপূর্ণ উপায়।

লোকটা প্রায় নিঃশব্দেই উঠে আসল। আড়চোখে দেখতে পাচ্ছি লোকটাকে। খুব ধীরে-সুস্থেই হেটে আসছে সে। এমনটাও সাধারণত হয় না। ফুট-ওভার ব্রিজে দিনে কিংবা রাতে কোন বেলাতেই কোন মানুষ এত শান্ত ভাবে চলাচল করে না। তবে চলাচল করে না তার মানে এই নয় যে করতেও পারবে না। এই যেমন লোকটি করছে। ধীরে ধীরে লোকটির সাথে আমার দূরত্ব কমতে লাগল। এখন তার পদশব্দ আমার কাছে স্পষ্ট। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে আসতে ঠিক আমার পেছনেই থামল। একটু অপেক্ষা করে জিজ্ঞাস করল- "কি ব্যাপার? এভাবে এখানে দাড়িয়ে কি করছেন?"

আমি অবশ্য এমন প্রশ্নে খুব একটা অবাক হলাম না। এই নগরে বাদ বাকি সবার মত নিরাপত্তা প্রদানে নিয়োজিত এমন মানুষও বসবাস করে। তারাও প্রায়ই নিজেদের পোশাকের বাইরে ঘোরাফেরা করে। ছোটবেলাতে সাদা পোশাকের পুলিশ বলে একটা কথা খুব শুনতাম। শুনতে শুনতে তখন একটা ধারণা হয়েছিল যে, হয়তো ঐ পুলিশের চাকরি করা লোকগুলি পুলিশের পোশাকের বাইরে সবসময় সাদা পোশাক পড়েই ঘোরাফেরা করে। আর তাই হয়তো তাদের 'সাদা পোশাকের পুলিশ' বলে লোকে। ধারণাটা দীর্ঘসময় পর্যন্ত বয়ে বেড়িয়েছি। পরে অবশ্য জানতে পেরেছি কত ভুল ধারণাই না বয়ে বেড়াচ্ছি আমি আমারই এই মস্তিষ্কে। সে যাই হোক, যেভাবে এত সময় এখানে দাড়িয়ে আছি তাতে তাদের চোখে পড়াটা খুব অস্বাভাবিক নয়। তাই ততটা আগ্রহ না দেখিয়ে কিংবা কিছুটা অবহেলা নিয়ে পিছু না ঘুরেই বললাম- এমনিতেই, ভালো লাগছে না। তাই এখানে দাড়িয়ে আছি।

ভাবলাম এবারে বুঝি নাম ঠিকানা জিজ্ঞাস করে সন্দেহভাজন হিসেবে গাড়িতে তুলবে। তারপর হয় সারাটা রাত ঘুরে বেড়িয়ে সকাল সকাল ডিউটি শেষে কিছু কড়া কথা বলে ছেড়ে দিবে কিংবা মায়া করে লক-আপে রেখে দিবে। তারপর পরিচিতদের ডেকে এনে ছুটতে হবে সেই মায়া ভরা খাতিরদারি থেকে। অবশ্য তাদের এই খাতিরদারির হাত থেকে সহজে রেহাই পাবার মত আমার পরিচিত কেউ নেই। না আছে এই শহরে, না আছে অন্য কোথাও। তবুও পিছু ঘুরে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকালাম না। ঠায় নিজের অবস্থানেই দাড়িয়ে রইলাম।

কিছুক্ষন অপেক্ষা করে প্রশ্নকর্তাও আমার মত ফুট ওভার ব্রিজটার রেলিং এর উপর হাত ভর করে দাঁড়াল। জিজ্ঞাস করল- সঙ্গে সিগারেট আছে?

ঢাকা শহরের অর্ধশত সিগারেট খোর রুমমেট আর বন্ধুদের সাথে থেকেও আমি ঐ একটা বস্তু এখনো খেতে শিখলাম না। এটা নিয়েও মাঝে মাঝে লজ্জায় কিংবা বিব্রতকর মুহূর্তে পড়তে হয়। এই যেমন এই মুহূর্তটা। এ শহরে সাধারণত পরিচিত কিংবা অপরিচিত কেউ আপনার কাছে তেমন কিছু না চাইলেও সিগারেট জিনিষটা অবশ্যই চাইবে। তারপর যখন ঐ বস্তু আমি "খাই না" বলে জানাই তখন কিছুটা অবজ্ঞা আর কৃত্রিম বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকবে। সব শেষে কেউ কেউ বাহ্‌বা দিবে আর কেউ কেউ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে দুটা কথা শুনিয়ে দিবে। 

মনে মনে এমন একটা পরিস্থিতি হবে চিন্তা করেই উত্তর দিলাম- না, সিগারেট খাই না আমি।

লোকটা যেন আমার উত্তরে খুব মজা পেয়েছে এমন ভাব নিয়ে বলল- খেতে বললাম কখন? জিজ্ঞাস করলাম আছে কি না আপনার সাথে।

বিরক্ত নিয়ে এইবার লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম- যে জিনিষ আমি খাই না সে জিনিষ কেন পকেটে নিয়ে কোন লজিকে ঘুরবো আমি? ফাজলামো করেন?

শেষ কথাটা বলেই মনে হল একটু বেশি হয়ে গেছে। এসব নিয়ে অনেকেই মজা করে আমার সাথে। সিগারেট খাই না জেনে মজা নেবার চেষ্টা করে। বেচারাও হয়তো ভেবেছিল তেমন কিছুই করবে। কিন্তু তার বিপরীতে এমনি ভাবে ফাজিল উপাধি পেয়ে যাবে, তা নিশ্চই আশা করেনি। 

কটু কিছু কথার প্রস্তুতি মনে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। কিন্তু না, লোকটা তেমন কিছুই করল না। পাশেই দাড়িয়ে রইল। সম্ভবত 'ফাজিল' উপাধিটা হজম করতে বেচারার বেগ পেতে হচ্ছে। এমনিতেই মন খারাপ, তার উপর এমন পরিস্থিতি মনটা আরও খারাপ করে দিল। কড়া কথা বলার জন্যে ক্ষমা চাইতে যাবো এমন মুহূর্তেই লোকটা বলল- সরি বলার মত এমন কোন কাজ আপনি করেন নি কায়েস সাহেব। মন খারাপের সময় কেউ যেচে এসে দুষ্টুমি করতে চাইলে এমন কিছু বলাটাই বরং স্বাভাবিক। 

কিছুটা অবাক হলেও তা প্রকাশ করলাম না। অবাক হবার দুটো ব্যাপার ঘটেছে। প্রথমত যতদূর মনে হচ্ছে লোকটাকে আমি সরাসরি চিনি না, সেই হিসেবে আমার নাম তার জানবার কথা নয়। তারপরও ধরে নিলাম কোন না কোন মাধ্যমে সে আমার নাম জানতেই পেরেছে। আর দ্বিতীয় ব্যাপার হল, আমি যে এই মুহূর্তে তাকে সরি বলতে যাচ্ছিলাম সেটা সে কিভাবে আঁচ করল? অবশ্য সেটাও আচ করা খুব কঠিন কিছু নয়, যেহেতু নাম জানে সেই হিসেবে আমার স্বভাব সম্বন্ধে কিছু জেনে নেয়া একেবারে অসম্ভব কোন কর্ম নয়।

এইসব সাত-পাঁচ ভাবার মাঝেই লোকটা আবার বলল- অবশ্য এমন ঘটনা ঘটবার পর মন খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। 

এবারে কিন্তু বিস্মিত হতেই হল। বিকেলে কি ঘটেছে সেটা একমাত্র আমি ছাড়া এখনো কেউ জানে না। মেসের দিকে যাইনি, কাউকে ফোন করিনি কিংবা এর মাঝে পরিচিত কারো সাথে দেখাও হয়নি যে কাউকে ঘটনাটা বলব। তাহলে এই লোক কিভাবে জানল কি ঘটেছে? নাকি এটাও আন্দাজে বলা কথার মত? গণকেরা যেভাবে হাত দেখে ১০টা আন্দাজে কথা বলবে, আর সেই কথা গুলি এতটাই কমন ব্যাপার হয় যে পৃথিবীর যে কারো সাথেই ঐ ১০ কথার ৪/৫টি মিলেই যাবে। তেমনি মন খারাপ হলে কোন না কোন ঘটনা তো এর পেছনে থাকবেই। লোকটা কি তবে এমন ভেবেই কথাটা বলল?

আমি কেবল কিছু সময় লোকটার দিকেই তাকিয়ে রইলাম। বয়স কত হবে লোকটার? ৩৫? ৪০? নাকি ৫০? কি জানি, নিয়নের আলো লোকটার বয়স অনুমান করতে দিচ্ছে না। আলোটাই যেন কেমন আধার করে রেখেছে জায়গাটাকে। আরও বিভ্রান্ত করছে লোকটার চাহনি। একবার মনে হচ্ছে লোকটা আমার অবস্থা বুঝে হাসছে, আরেকবার মনে হচ্ছে মুখ গম্ভীর করেই চেয়ে আছে। 

লোকটা আবারও বলতে শুরু করল- দেখুন কায়েস সাহেব, জীবনের সময়টা এত ক্ষুদ্র যে মন খারাপ করে কাটানো সময় গুলি এখানে বিলাসিতা করে সময় নষ্ট করা। এই যে আমরা, সময়ের যে স্রোতে ভেসে চলেছি সেটাকে কোনভাবেই পরিবর্তন করতে পারব না। পেছনে ঠেলেও ফিরে যাবার কোন সুযোগ নেই। যদি সম্ভব হতো তবে অনেক পরিবর্তনই করে নেয়া যেতো, শুধরে নেয়া যেতো নিজের অনাকাঙ্ক্ষিত সকল ভুল গুলিকে। অথচ এমনটা করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। আপনি হয়তো বিজ্ঞানের দোহাই দিবেন। বলবেন, লজিক্যালি সময়ের পেছনে ছুটে যাওয়া যায়। কিন্তু সেই আপনিই আবার বলবেন লজিক্যাললি সম্ভব হলেও বাস্তবে তা তা এখনো সম্ভব নয়। তাই বলছিলাম এভাবে অযথাই সময়গুলিকে অপচয় না করে উপভোগ করুন। 

একটানা কথা গুলি বলে গেল লোকটি। আমার বিস্ময়-ভাব তখনও কাটিয়ে উঠতে পারি নি। এরই মাঝে লোকটি আবারও বলতে শুরু করল-

ভালো করে সময় গুলিকে খেয়াল করে দেখবেন। আমরা সবসময়ই চেষ্টা করি নিজের সাধ্যের সর্বোচ্চ ভালো সময়টাকে পেতে, আনন্দময় সময়টাতে ডুবে থাকতে আর প্রাপ্তির আনন্দে মেতে থাকতে। কিন্তু যতই চেষ্টা করি এইসবের মাঝে আমরা ডুবতে পারি না। তবে হ্যাঁ, কাছাকাছি যাবার একটা সুযোগ তৈরি হয়ে যায় বটে। আর যদি কখনো ভাগ্যটা সহায় না হয় তখন ছিটকে পড়ি। তবে সমস্যাটা ছিটকে পড়ে যাওয়াতে নয়। সমস্যাটা হল ছিটকে পড়ে যাবার পর সেখানেই পড়ে থাকাতে। আমরা প্রায় সকলেই খারাপ সময়ে প্রবেশ করার পর ঐ খারাপ সময়টাকে নিয়েই টেনে হিঁচড়ে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু এই খারাপ সময়টাকে বয়ে বেড়াবার কিছু নেই। চেষ্টা করলেই নতুন উদ্যম নিয়ে ভিন্ন কোন ভালো সময়ের দিকে ছুটে যাওয়া সম্ভব। পথের দূরত্ব একটু বেশি হতে পারে কিন্তু তাই বলে সেখানে পৌঁছানো অসম্ভব নয়। বরং আমি বলব খারাপ সময়টা আপনাকে ভিন্ন আরেকটা ভালো সময়ে পৌঁছে দেবার একটা পোর্টালের মত কাজ করে। আপনাকে শুধু বুঝতে হবে কোন পোর্টালে আপনি প্রবেশ করতে চান।

আমি একরকম হা করেই লোকটার কথা গিলছিলাম। কোন কথাই মস্তিষ্কে প্রবেশ করছিল না, কিন্তু কথা গুলির গুরুত্ব ঠিকই বুঝে নিতে পারছিলাম। এমন মুহূর্তে হুস করে একটা ট্রাক ছুটে চলে গেল। ট্রাক চালকদের সম্ভবত সবসময় ট্রাফিকে বসে থাকার দরুন কিছুক্ষণ পরপর হর্ন বাজাবার একটা অভ্যাস তৈরি হয়ে যায়। নয়তো এমন ফাঁকা রাস্তায় কোন প্রয়োজন লোকটা ট্রাক ছুটাতে ছুটাতে হর্ন বাজাবে তা আমার বুঝে আসে না। 

এই টুকু সময়ের জন্যেই লোকটার উপর থেকে মনোযোগ ছুটে গিয়েছিল। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম লোকটা নিঃশব্দে ফুট-ওভার ব্রিজটার অপর প্রান্তের সিঁড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। লোকটাকে ডাকতে যেয়েও কেন জানি ডাকতে পারলাম না। মনের ভেতর কে যেন বলছিল- "তোমার যা জানার তা জেনেছ। নতুন করে আর কিছুই জানার নেই"।

দেখতে দেখতে লোকটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। তারপর অল্প সামনে এগিয়ে একটা বিল্ডিং এর মোড়ে একটু থামল। পেছনে ঘুরে একবার একটু তাকাল আমার দিকে। মনে হল আমার দিকে তাকিয়ে মাথাটা একটু ঝাঁকাল, তারপর ধীরে সুস্থেই বিল্ডিং এর মোড়ের পথ ধরে হারিয়ে গেল, হারাল আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে।

দূরে কোন মসজিদে মুয়াজ্জিন নামাজের আহ্বানে ডেকে চলেছে। এত দূর থেকে স্পষ্ট না হলেও তার আহ্বানের মাধুর্য বুঝতে কোন কষ্ট হচ্ছিল না। এবারে আমার ফেরা উচিৎ। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে এই শহরের পথ গুলি আবারও জীবিত হবে। দিক-বিদিক ভুলে দীর্ঘশ্বাস চেপে ছুটবে মানুষ। দেখতে দেখতে মানুষের ব্যস্ততা আর জ্যামের জঞ্জালে শহরটা আবারও তার পরিচিত রূপে ফিরে আসবে।








মঙ্গলবার, মে ১৩, ২০১৪

অনুগল্প - না বলা বিদায় বেলা




সুমন আর ফাহিমা, কলেজের কে চেনে না তাদের? ভিন্ন ভিন্ন শিফট, আর সেই ভিন্ন ভিন্ন শিফটেই নিজেদের দুষ্টামির জন্যে তারা সেরা। স্যারদের কটু কথা, হুমকি, নালিশ, গার্ডিয়ান ডেকে বিচার কোনটাই কাবু করতে পারেনি তাদের। মাস ৬ চলার পর স্যরেরাই তাদের দুষ্টামি নিয়ন্ত্রণে আনার হাল ছেড়ে দেয়। না ছেড়েই বা কি করবে? পড়ালেখায় তো আর দুষ্টামির জন্যে ফাঁকি দিচ্ছে না। ক্লাস টেস্ট, কোয়াটার টেস্ট সব কিছুতেই নিজেদের অবস্থান উপরের দিকেই ধরে রেখেছে তারা। সমস্যাটা যখন শুধুই দুষ্টামির তাহলে একটু ছাড় দেয়াই যায়, এই ভেবে ক্ষান্ত দিল তারা।

নিজেদের মধ্যে পরিচয় শুভ'র মাধ্যমে। দু'জনেরই কমন ফ্রেন্ড শুভ। ফাহিমা'র স্কুল ফ্রেন্ড আর সুমনের সাথে কলেজে পরিচয় হয় শুভ'র। কেমিস্ট্রি স্যর মিজানের কাছে তারা কোচিং করে একসাথে। শুভ'ই ডেকে নিয়ে ফাহিমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় সুমনের। ফাহিমার সাথে গল্প করার সময় সুমনকে ডেকে বলে- "দোস্ত! এইটা আমার দোস্ত। এইবার পরিচিত হয়ে নে।" এই শুভ'টাও কম ফাজিল না, ফামিহা এমনিতেই দুষ্টামির সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। মুখের উপরই বলে ফেললো- "তোর দোস্ত মানে তো আমারও দোস্ত। তাই না সুমন দোস্ত?” সুমন এই কথার পর আর যায় কোথায়। দুষ্টামিতে তো আর সেও কম যায় না। সাথে সাথেই উত্তর- "আব্বে দোস্ত! এইটা আবার কইতে হয় নাকি? আমরা সবাই তো গোল্লাছুট খেলার দোস্ত। কোন কথা নাই.." দুষ্টামিতে সবাই এক্সপার্ট সেইটা এক মুহূর্তেই বোঝা হয়ে যায় সবার।

কোচিং এ ও দুষ্টামি চলতো সমান তালে। তবে এখানে দুষ্টামির সাথে পড়ালেখার সিরিয়াসনেস একটু কলেজের তুলনায় বেশি ছিল সবার। নোট শেয়ারিং, কোচিং ক্লাস ডিসকাস আর মাঝে মাঝে ভিন্ন ভিন্ন স্যারদের প্রশ্ন জোগাড় করে নিজেদের মত করে প্রশ্নের গুরুত্ব খুঁজে নিতো তারা। ভালোই চলছিলো, কোচিং এর পর একটু ঘোরাঘুরি, ফাস্টফুড আর কফি শপেও আড্ডা চলতো তাদের। বন্ধুত্বটা একটু বেশি বেশি মনে হয়েছিল সকলের। আসলে সকলের না নিজেদেরও মনে হচ্ছিল। কিন্তু কেউ কখনো কাউকে কিছুই বলেনি। হয়তো বন্ধুত্বটা নষ্ট করতে চায় নি।

দেখতে দেখতে ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল চলে এল পড়ার চাপ বেড়ে গেলো সকলেরই। আড্ডা ইদানীং একেবারেই কম হয়। তবে প্রয়োজনে মাঝে মাঝে মোবাইল ফোনে আলাপ চলে। তারপর পরীক্ষা, অনেক টেনশন দুষ্টামি আর বিরক্তি নিয়ে পরীক্ষাটা ভালোয় ভালোয় শেষ করলো সকলেই। মাঝে ১২ দিন ছুটি ঘোষণা করলো কলেজ। ১২ দিন নিজেদের মত করে ছুটি কাঁটালো সবাই। যোগাযোগ ঐরকম করে আর করা হয়নি কারো সাথেই। ১২ দিন পরে আবার কলেজ আর কোচিং এর রুটিন মাফিক দৌড়াদৌড়ি শুরু। কিন্তু ৩ দিন হয় ফাহিমার কোন দেখা নেই। শুভ আর সুমন বার ২-৩ ফোনও দিয়েছিল, রিসিভ করেনি কিংবা কল ব্যাক ও করেনি সে।

আজ খোঁজ নিবো, কাল খোঁজ নিবো করতে করতে ৬ দিনের মাথায় ফাহিমাই ফোন দিয়ে সুমন আর শুভ'কে পরিচিত ফাস্টফুডে আসতে বলল বিকেলে। কি হয়েছে জানতে চাইলে তার উত্তর না দিয়ে কৌশলে এড়িয়ে গেল ফাহিমা। কোচিং শেষ করে বিকেল ৫ টার কিছু পর সুমন আর শুভ দুজনেই ফাস্টফুডে গিয়ে পৌঁছল। সারপ্রাইজটা তখনও অপেক্ষা করছিল তাদের জন্যে। তারা রেগুলার যে টেবিলটায় বসে আড্ডা দেয় সেখানে ফাহিমা আগে থেকেই অপেক্ষা করছে তাদের।

শুভ সোজা গিয়ে ফাহিমার ঘড়ে চেপে ধরেই বলতে শুরু করল-

» শয়তান! এতদিন কই ছিলি? খেয়ে দেয়ে তো মোটা হয়ে গেছিস। ফোন দিলাম এতগুলি করে খাওয়ার তালে ঐটাও শুনতে পাস নাই?

» আরে ছাড়! আজব তো! আগে কথা তো শুনবি। কোথায় জিজ্ঞাস করবি কেমন আছি না আছি। তা না, আগেই ঘাড়ে হাত।

» তোর কথা আর কি শুনবো? তুই তো খেয়ে দেয়ে মোটা হয়েই এসেছিস। ফর্সাও হয়েছিস কিছুটা।

» এই শয়তান, তোরে জিজ্ঞাস করছি আমি সুন্দর হইছি না মোটা হইছি?


বলেই উল্টা হাতে দিল শুভর পেটে এক কুনি। শুভ ফাহিমার ঘাড় ছেড়ে সুমনের পাশের চেয়ারটায় বসলো। এবার সুমন জিজ্ঞাস করলো-

» কি হয়েছে তোমার? আসলে না ফোনও রিসিভ করলে না, মেজর কোন সমস্যা ছিল নাকি?

» আস্তে ধীরে বৎস,আগে ঠাণ্ডা হও, ঠাণ্ডা খাও তারপর বলছি।

ইশারায় ওয়েটার ডাকল ফাহিমা, ওয়েটার আসলে তাকে বলল ৪ টা বার্গার আর ৪টা ঠাণ্ডা কিছু দেবার জন্যে। ওয়েটার চলে যাবার পর শুভ টিটকারি দিয়ে বলল-

» দেখ। এই কয়দিনেই খাওয়ার রুচি কত বেড়েছে মুটি টার। এখন ওর একারই ২টা বার্গার লাগে।

» শুভ!! একদম বাজে কথা বলবি না বললাম!! আর একজন আসছে, অর্ডারটা তার জন্যেই করেছি।

» আরও একজন? ঐটা আবার কে? কোন সুন্দরী কাজিন নাকি তোর??

» তোদের এই এক সমস্যা। কেউ আসবে শুনলেই সুন্দরী কাজিন আর বান্ধবী খুঁজিস তোরা।

» তো! আর কি ভাববো? আমরা তো স্ট্রেইট মাইন্ডের.... বুঝস না।

» হুম, বুঝিই তো তোরা কত বড় স্ট্রেইট শয়তান।

» এখন বল কে সেটা?

» আসুক, আসলেই বুঝতে পারবি।

অর্ডার দেয়া খাবার আসার আগেই একজন যুবক ফাস্টফুড শপে প্রবেশ করে আর ঠিক ফাহিমাদের টেবিলের সামনে এসে দাড়ায়। ফাহিমা তাকে দেখেই হেসে দেয়, আর বলে-

» সুমন, শুভ এ হচ্ছে ইমরান, পরিচিত হও। আর এরা দুইজন আমার খুব ভালো বন্ধু।

» হ্যালো সুমন এন্ড শুভ। নাইস টু মিট ইউয়্যু।

» নাইস টু মিট ইউয়্যু ঠ্যু, প্লিজ হ্যাভ এ সিট।

ইমরান নামের যুবকটি কোন ইতস্তত ছাড়াই ফাহিমার পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। এর পর ফামিহা বলতে শুরু করলো-

ফাহিমাঃ আমি এই কয়দিন আসি নি বা তোদের সাথে যোগাযোগ করি নি একটা বিশেষ কারণে।

শুভঃ কি কারণ?

ফাহিমাঃ এই যে ইমরান নামের ভদ্র চেহারার মানুষটা দেখছিস, এ আসলে যতটা দেখতে ভদ্র মনে হয় ততটা ভদ্র না। এই কয়দিন এই অল্প ভদ্র লোকটাকে একটু ভদ্রতা শিখিয়েছি।

শুভঃ মানে!!

ফাহিমাঃ মানে হচ্ছে.... পরীক্ষা শেষেই হুট করে এই অল্প ভদ্র লোকটার নামে আমাকে তিন কবুল পড়তে হয়েছে।

সুমনঃ কনগ্রাচুলেশন দোস্ত। কিন্তু এইভাবেই চেপে গেলি? আমাদের অন্তত একটা ফোন দিতে পারতি।

ফাহিমাঃ আরে কিভাবে দিবো। পরীক্ষা শেষ করে বাসায় পৌঁছেই আম্মুর মুখে শুনি এমন একটা ঘটনা। আমি নিজেই তো কিছু বুঝে উঠার আগে আমাকে কবুল বলিয়ে নিলো এই হতচ্ছাড়া লোকটা। আর তারপর গতকালই কেবল সিলেট ট্যুর থেকে ফিরলাম। আর এসেই প্রথমে তোদের সাথে যোগাযোগ করেছি।

সুমনঃ যাই হোক পার্টি কিন্তু পাওনা। মাফ হবে না কোন.....

ইমরানঃ মাফ চাইছে কে? সামনের সপ্তায় রিসিপশন অনুষ্ঠান হচ্ছে ঘটা করে। আপনারা দুইজন তার দুইদিন আগে থেকে ওখানে থাকবেন। কি থাকবেন তো??

সুমনঃ সে আবার জিজ্ঞাস করতে?

ফাহিমাঃ ঐক! তাহলে আমার দিক থেকে কে যাবে?

সুমনঃ আরে ধুর! তুই তো এখন পর। আপন তো ইমরান ভাই, হা! হা! হা! হা!

ফাহিমাঃ শয়তান! শুরুতেই পল্টি নিলি। মনে রাখিস কিন্তু...

তারপর আরও অনেকটা সময় আড্ডা দিয়ে বেরুলো তারা। ফাহিমা আর ইমরান ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একটা প্রাইভেট কারে করে ছুটলো। শুভ্র এতক্ষণ পর সুমনের দিকে তাকাল। সুমন হাসি মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করলো কতবড় অভিনেতা তার এই বন্ধুটি। পাক্কা অভিনেতাই বলতে হবে।

» কি করবি এখন?

» আর কি করবো? বাসায় যাবো। সন্ধ্যা তো হয়েই গেছে। কেন কোথাও যাবি?

» নাহ! কিন্তু....

» আরে এই তিনদিন একটু ভালো করে দেখে নিলে ঐ দুই দিন ম্যানেজ হয়ে যাবে। কোন কিন্তু নেই।

» সুমন শোন!

» আরে বলার আর কি আছে। তুই বাসায় বলে দেখ। আন্টি নিশ্চিত রাজী হবে এই দুইদিনের জন্য। আর আফটার অল ফাহিমার রিসিপশন বলে কথা।

» সুমন আমি কিন্তু এটা বলতে চাইছি না।

» কিছু বলতে হবে না, বাসায় যা ব্যাটা। বেশি রাত করলে কালকের ম্যাথ গুলি করে জমা দিতে পারবি না। আমি গেলাম।

বলেই আর কোন অপেক্ষা করলো না সুমন, সাইকেলটার দিকে হাটা দিল। শুভ দাড়িয়ে দেখছে, কিছুই বলতে পারলো না বন্ধুটাকে। হাসি খুশি এই দুষ্ট ছেলেটা এত চাপা স্বভাবের এটা কি এতদিন সে বুঝতে পেরেছিল? সত্যিই মানুষ কত আজব, আনন্দ গুলি দেখাতে পারলেও কেউ কেউ দুঃখ দেখাতে পারে না। পাশের কফি শপটাতে গান পরিবর্তন হয়ে পুরাতন একটা গান বেজে উঠলো....


চলে যাও.. বন্ধু তুমি চলে যাও.. 
হৃদয়ের বাধন ভেঙ্গে দিয়ে.... 
দেবনো না.. বাধা কোন দিবো না... 
থেকে যাও.. নিজেকে নিয়ে.... 

দূরে... রবো আমি... 
শুধু তোমার সুখ কামনায়.... 
স্মৃতি.... নিয়ে এই মন.... 
আজীবন ভালবাসবে তোমায়.... 

চলে যাও.. বন্ধু তুমি চলে যাও.. 
হৃদয়ের বাধন ভেঙ্গে দিয়ে....







শনিবার, অক্টোবর ১২, ২০১৩

নিঃশব্দের গল্প...

- এই ছেলে এখানে কিভাবে আসলে? কাকে চাও?
কোন উত্তর নেই। একটু তাকিয়ে আবার তার দৃষ্টি মাটিতে নিয়ে গেল।

- এই ছেলে! আমি তোমাকে কি জিজ্ঞাস করলাম??
এইবার ছেলেটা ভাল করে তাকাল আর একটু হাসি দিল; যেন এটাই তার উত্তর।

- এখানে দাড়িয়ে আছো কেন?? কাকে চাই?? সমস্যা কি তোমার, কথার জবাব দিচ্ছ না কেন??

ছেলেটা কিছু না বলে পকেট থেকে ছোট্ট এতটা নোটবই আর একটা পেন্সিল বের করলো। তারপর নোটবই টা খুলে তাতে কিছু একটা লিখে বাড়িয়ে দিল। তাতে লিখা "দুঃখিত, আমি কথা বলতে পারি না। তবে শুনতে আর লিখতে পারি।"

এটা দেখে রাকিব সাহেবের হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল। রাজপুত্রের মত একটা ছেলে, কিন্তু কত বড় অন্যায় করেছে বিধাতা তার সাথে। মনের কথা গুলি মুখে নিয়ে আসতে পারে না বেচারা। এটা ভাবতে ভাবতেই অন্য একটা ছেলের কথাও মনে পরে গেল। তার নিজের ছেলে, আবির। আবিরও কথা বলতে পারতো না এই ছেলেটির মত। ঠিক এই ছেলেটির মতই কথা শুনতে আর বুঝতে পারতো। হাসির শব্দ করতে পারতো না। তবুও মুখে সবসময় একটা মায়া-মাখানো হাসি ঝুলিয়ে রাখতো।

আবিরের কথা মনে পরেনা সেই কবে থেকে। হঠাৎ করেই খুব জ্বর হল। ঐ সময় ছেলেকে ডাক্তার পর্যন্ত দেখানোর সামর্থ্য ছিল না তার। দুইদিন ভোগার পর হঠাৎ করেই জ্বর ভাল হয়ে গেল। খুব দুষ্টামি করলো সারাদিন। সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েও পড়লো। কিন্তু রাতে ঘুমিয়ে ছেলেটা আর সকালে উঠলো না, ঘুমিয়েই থাকলো। কত ডাকাডাকি করলো কিন্তু ছেলেটা তার ডাক যেন গা'ই করলো না। ঘুমিয়েই থাকলো নিজের মত করে।

ঐদিন থেকে বিধাতার উপর একটা আক্রোশ জন্মে গেছে মনে। আক্রোশ জন্মেছে দারিদ্রতার প্রতি। তার আক্রোশ তাকে এখন পাজেরো গাড়িতে চলার মত অবস্থা করে দিয়েছে। বিরাট এসি রুমে বসে বসে সময় কাটানোর সুযোগ করে দিয়েছে। এখন ইচ্ছে করলেই দেশের বাইরে চেকআপের জন্যে যেতে পারে সে।

ভুল করেও এত বছর সে আবিরের কথা মনে করে নি। কিন্তু আজ মনে হয়েই গেল। সাথে মেজাজটাও খারাপ হয়ে গেল তার। একটু রুক্ষ স্বরেই জিজ্ঞাস করলো ছেলেটিকে,
- তা এখানে দাড়িয়ে আছো কেন? কাকে চাই??
ছেলেটি আবারও একটা হাসি দিয়ে নোটবইটাতে লিখে তাকে দেখালো। সেখানে লেখা আছে, "আপনার সাথে"

রাকিব সাহেব এইবার আরো একটু বিরক্তি নিয়ে বললেন
- আমার সাথে মানে কি? তুমি কি জানতে আমি এই সময়ে এখানে আসবো? আর এখানে কেন আমার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে?
ছেলেটা আবারও নোটবইতে লিখে দেখালো "আমি এখানে প্রতিদিন অপেক্ষা করছি, গত ২মাস ধরে আপনার জন্যে"

এইবার রাকিব সাহেব একটু অবাক হয়ে বললেন
- টানা দুইমাস ধরে অপেক্ষা করছো আমার জন্যে? তাও আমার গ্যারেজের আড়ালে? ঠিক কি কারণে জানতে পারি?

ছেলেটা আবারও লিখলো, আর আস্তে করে তার চোখের সামনে ধরলো নোটবইটা। সেখানে স্পষ্ট করে লিখা
"বাবা আমি আবির"

রাকিব সাহেব এতটুকু পড়েই জ্ঞান হারালেন।

পরের দিন পেপারে একটা শোকবার্তা ছাপা হলো। সেটা স্বনামধন্য শিল্পপতি রাকিব সাহেবের মৃত্যু সংবাদ। সন্ধ্যায় তার ড্রাইভার তাকে গ্যারেজের পাশে মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় আবিস্কার করে। সাথে সাথে হাসপাতালেও নেয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সবাই ধারনা করলো হঠাৎ করেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন তিনি। কিন্তু কেউ জানতে পারলো নিঃশব্দ ঐ ছেলেটির কথা।