রাত্রিটা স্বস্তি আর অস্থিরতা পার করে দ্রুত পায়ে ভোরের দিকে ছুটে চলে, সাথে আমার হেটে চলা পথটাও অন্ধকার থেকে আলোর দিকে ধাবিত হয়। একটা দিনের শুরুর আলোকিত হবার প্রক্রিয়াটাও বেশ জটিল। হুট করেই আলো চলে আসে না কিংবা খুব ধীরেও আসতে পারে না। মনে হয় কিছু সময় পরপর আকাশের কালো পর্দাটা আস্তে আস্তে কেউ শুভ্র একটা পর্দা দিয়ে পরিবর্তন করে দিচ্ছে। আর প্রতিবারই এই অন্ধকারটা একটু একটু করে কমে যাচ্ছে তাতে।
রাতের অন্ধকারে বড় বড় এই দালানগুলো যে আকাশ চুরি করে রেখেছে তা এতটা বোঝা যায় না যতটা দিনের আলো ফোটার পর বোঝা যায়। আমি এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের আকাশ দেখবো তর জো নেই। ডানে-বামে, সামনে-পেছনে সব জায়গাতেই এই দালানের উঁচু মাথার অবস্থান। তারপরও ভালো যে একেবারে আকাশটাকে ঢেকে দিতে পারে নি। তাদের উঁচু উঁচু মাথার ফাকা দিয়েই কিছুটা আকাশের এখনো দেখা মেলে। ঐ দিক দিয়েই আমি আকাশটুকু মুগ্ধতার সাথে দেখতে থাকি।
রাতটা যেমন সবাই ঘুমিয়ে কাটাতে পারে না, তেমনি দিনের শুরুতে সবাই আলসেমিও করতে পারে। এই শহরে আলসেমি আভিজাত্যের একটা লক্ষণ। ব্যস্ত ভঙ্গীতে কেউ কেউ দোকানপাট খুলতে থাকে, কেউ আবার তাদের পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে চলে। এদের কারো চোখে ঘুমের তৃপ্তি দেখতে পাই না আমি। সবাই যেন এক একটা রোবট। কোন এক অদৃষ্ট থেকে কেউ তাদের সুইচ চালু করে দিয়েছে আর তারা সেই নির্দেশ পেয়ে ছোটা শুরু করেছে। কারো কোন পরোয়া নেই, কোন কিছুতেই নেই।
দেখতে দেখতে নীরব শহরটা কোলাহল পূর্ণ হতে থাকে। রিক্সার টুংটাং আর গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। আমি এই ব্যস্ততার এক কোনায় অবস্থান নিতে চায়ের এক দোকানের পেতে রাখা টুলে বসি। তখনো দোকানির চা’য়ের পানি ফোটানো সম্পূর্ণ হয়নি। আমি বসে বসে তার গোছগাছ দেখতে থাকি। অল্প একটুখানি জায়গা। আর তাতেই দুনিয়াশুদ্ধ জিনিষ পত্রে বোঝাই। দোকানি এর মাঝেই তার ক্ষেত্র তৈরি করার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছেন দ্রুত গতিতে।
গতরাতে দ্রুত দ্রুত বাসা বাড়িতে ফিরে যাবার জন্যে যেই লোক গুলিকে দৌড়ঝাঁপ করতে দেখেছি আজকে আবারও তাদের দৌড়ঝাঁপ দেখছি। না, এখন বাসার উদ্দেশ্যে নয়। বরং নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে কে কত দ্রুত পৌছতে পারবে সে নিয়ে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে তাদের মাঝে। কোন একটা যাত্রী বোঝাই বাহন থামা মাত্রই তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে তারা। ভিন্ন গন্তব্যের ভিন্ন ভিন্ন বাহন কিন্তু তাদের লক্ষ্য করে এই দৌড় ঝাপের কোন ভিন্নতা দেখা যায় না। বরং যেন সিডি প্লেয়ারের রিপ্লে বাটন বার বার ক্লিক করে এখানে টেনে ধরছে এমন মনে হচ্ছে। এভাবেই চলতে থাকে তাদের।
পাশ দিয়ে গতকালের নাম না জানা সেই রিকশাওয়ালা রিকশা চালিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি ভেবে পাই না এদের এত মানুষিক শক্তির যোগানটা আসে কোথা থেকে। দিনভর শারীরিক এই পরিশ্রম করার পর কিভাবে এই ভোর পেরুতে না পেরুতেই এরা আবার ছুটে আসে। সত্যিই ঐ ছোট্ট চালার ঘরে কি এতটা শক্তি লুকানো আছে যে এই দুই চার ঘণ্টার বিশ্রাম এদের আবার নতুন উদ্যমে দিনভর ছুটিয়ে নিয়ে চলে? ইচ্ছে হয় ঐ চালাঘরে গিয়ে একটা রাত কাটিয়ে আসার। এদের এই উদ্যমের লুকানো শক্তিটা নিজ চোখে দেখে আসার। তার সাথে যদি কিছুটা শক্তি নিয়ে আসা যায় তাতেই বা মন্দ কি।
যেখানে বসেছি তার পাশেই এক হকার মাটিতে একটা পর্দায় পত্রিকা বিছানো শুরু করেছে। দিনের শুরুতেই গরম গরম খবরগুলিকে নির্বিকার ভঙ্গিতে গুছিয়ে নিচ্ছে সে। সবাই যে আগ্রহ নিয়ে পত্রিকার পাতায় ছাপা খবর গুলি পড়ে এর ছিটেফোঁটা আগ্রহ ও এই লোকটার মাঝে নেই। গোছানো শেষ হবার থেকেই একটু পরপর হাঁক ছাড়ছে সে “এই পেপার! পেপার!” বলে।
চা’য়ের দোকানি চা তৈরি করে ডাকছে “মামা চা নেন”। এবার এই লোকটার ভেতরে একটু উৎফুল্ল ভাব দেখতে পাই। দিনের শুরুতেই কাজ গুলি গুছিয়ে নিয়ে অনেকটাই আনন্দ কাজ করছে তার। কিন্তু কে জানে এই আনন্দ কতক্ষণ ধরে রাখতে পারবে সে? কে জানে কেউ ১ টা টাকার জন্যে এর সব আনন্দ নষ্ট করে দিবে না?
দ্রুত দ্রুত গরম চা’য়ের কাপে চুমুক লাগিয়ে কাপটা খালি করে দাম মিটিয়ে বেরিয়ে আসি দোকান থেকে। এবার আমার ক্লান্তি দূর করার পালা। রাতের স্নিগ্ধতা থেকে শুরু করে দিনের শুরুর ব্যস্ততা পর্যন্ত দেখতে দেখতে এখন অনেকটা ক্লান্ত বোধ করছি। আমিও এখন ছুট লাগালাম আমার সেই মাথা গোজার ঠাঁইয়ের দিকে.....
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন