শুক্রবার, জুন ২১, ২০১৯

চাঁদের পথে...



চাঁদের সাথে পথ ধরে হেটে যেতে নেই কোন বাধা। বরং যুগে যুগে বহু মানুষ এই চাঁদের মায়ায় ডুবে সংসার ছেড়ে পথ হেঁটেছে চাঁদের পেছনে পেছনে। কেউ হয়েছে বৈরাগি, কেউ সন্যাসী আবার কেউ গিয়ে ঠেকেছে নির্জনে-মৃত্যুতে। গল্পে, কবিতায়, ভালোবাসা কিংবা অক্ষমতার আক্ষেপের বিক্ষিপ্ত বহিঃপ্রকাশে চাঁদ বরাবরই মানুষকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছে। সেই অনাদিকাল থেকে এখন অব্দি মানুষ চাঁদকে দেখে নিজের ভেতরকার উদাসীনতা অনুভব করে। নিজের মনের কোমলতাকে চাঁদের কোমল আলোর সাথে তুলনায় মেপে দেখে। ২ লক্ষ ৩৮ হাজার ৮৫৫ মাইল দূরে থেকেও কি অদ্ভুত মায়াতেই না চাঁদ আমাদের বিমুগ্ধ করে রেখেছে।

সবার মত আমিও চাঁদের সাথে পথ হেটে হারাতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম চাঁদের মায়ায় ডুবে লোকান্তর ত্যাগ করে সন্যাসী হতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, চাঁদ তার নেশা ধরিয়ে তার পিছু পিছু হাটিয়ে নিলেও কখনো হারিয়ে যাবার পথ বলে দেয় না। সে যেখানে নিয়ে যায় তারও একটা না একটা পরিচয় থাকে। সেখানেও কোন না কোন ভাবে অন্য কারও পৌছবার পথ জানা থাকে। ভিন পথে হাটিয়ে ভিন্ন করেও শেষ পর্যন্ত আবারও মিলের খাতায় ঠিকই জুড়ে দেয় সে। চাই তার ঠিকানা হোক মরু কিংবা মেরুতে। কেউ না কেউ ঠিকই সেখানে পৌছে যাবে। এই ভেবেই আর শেষ পর্যন্ত চাঁদের পেছনে আমার হারানো হয়নি।

তবে কি তাই ভেবে চাঁদের পিছু ছোটায় মানুষ খ্যান্ত দিবে? না, তা মোটেই হবার নয়। চাঁদে যে পথে হাটিয়ে নিয়ে যায় সে পথ সে প্রতিটা মানুষের জন্যেই আলাদা করে রাখে। দু'জন মানুষ একই পথে চাঁদের পিছু হেঁটেও কখনো এক পথের পথিক হয় না। তার প্রতিটি পথেই দেখা মেলে নতুন কোন নক্ষত্রের, যার প্রজ্বলনে মুসাফিরের অন্তর প্রজ্জলিত হয়। পথের প্রতিটা মোড়েই কোন না কোন কৃষ্ণগহবর তার গল্প নিয়ে দাড়িয়ে থাকে। যারা শোনার, তারা ঠিকই সেই গল্প শুনতে পায়। সেই গল্পের ভাব তাদের অন্তরকে আরও প্রসস্ত করে, করে তোলে আরও গভীরতর।  আর ঐ গল্প ঐ একটি মাত্র মানুষ ছাড়া দ্বিতীয় কেউ কোনদিন কোনকালে শুনতে পায় না।

এখানেই কি শেষ? না, এখানেও তাদের অন্তর তৃষ্ণা তৃপ্ত হয় না। তারা ছুটে যায় চাঁদের কাছে। খুব কাছ থেকে, একদম নিবিড় ভাবে তারা অনুভব করতে চায় চাঁদকে। কিন্তু সেখানেও নিয়েও চাঁদ মুচকি হাসে। তারা তো চাঁদে ছুয়ে দেখে ঠিকই, কিন্তু তার কোমলতার পেছনে যে রহস্য, তার আকর্ষণের পেছনে যে হাতছানি; তার হিসেব তারা কোন ক্যালকুলেশনেই মিলাতে পারে না। শেষ পর্যন্ত মনে আরও বেশি আক্ষেপ নিয়ে, অভিমানে মনকে পূর্ণ করে ফিরে আসে ধরণীর বুকে। অথচ নিজের বুকের মাঝে তখনও চাঁদের পিছুনে ছুটে যাবার ইচ্ছাকে দমন রাখতে পারে না।

তবুও আমি কিংবা আমরা বেহায়াপনার চুড়ান্ত করে বারংবার চাঁদের পিছনে হেঁটেছি। চাঁদের পূর্ণতায় নিজের পূর্ণতার রূপ খুঁজেছি, চাঁদের হারিয়ে যাওয়ায় নিজের মাঝে নিজেকে হারিয়ে দেখেছি। ফের যখন গোস্বা ছেড়ে চাঁদ আবারও আকাশের বুকে উঁকি দিয়েছে, আমরাও আমাদের মাঝে হারিয়ে ফেলা আসল আমিটাকে খুঁজে ধরে আবারও চাঁদের সাথে মিলিয়ে দেখেছি। আর বারংবারই নতুন চাঁদের মত নিজের মধ্যে নতুন কিছুই খুঁজে পেয়েছি। অবাক হয়েছি, যেমন করে প্রতিবারই পুরানো চাঁদকে নতুন করে দেখেও কিছু দেখা অপূর্ণ রয়ে গেছে, তেমনি নিজের মধ্যে নিজেকে আবিস্কার করতে গিয়ে প্রতিবারই বুঝতে শিখেছি আমার মধ্যে আমাকে দেখাও এখনো অপূর্ণই রয়ে গেছে।

তারপর? তারপর চাঁদের কাছে শিখেছি জীবনটার জোয়ার-ভাটার প্রয়োজনীয়তা। চাঁদ যেমন করে জোড়ারে দুনিয়ার সবকিছু নিজের দিকে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে। তেমনি আমরাও আনন্দ আর উল্লাসের তিব্রতায় আমাদের সবকিছু নিয়েই ব্যাকুল হয়ে পড়ি। আমাদের জোয়ারের ঐ সময়টাতে সবচেয়ে তুচ্ছ ব্যাপারও আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। অযথাই হাসি ঠাট্টায় সব দুরুত্ব ঘুচিয়ে কাছে টেনে নিতে থাকি প্রিয়জনদেরকে। আবার ঠিক ভাটার মত করে তার উল্টোটাও করতে থাকি। তখন মনের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা বিদ্বেষে সব দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিতে থাকে। গোছানো সব জিনিষই তখন ছুড়ে দিয়ে তছনছ করার ইচ্ছে জেগে উঠে। হয়তো মাঝে মাঝে মনের ভাটার পরিমানও বেড়ে যায়। আর তখন ইচ্ছেটা কেবল ইচ্ছেতে সীমাবদ্ধ থাকে না, তখন সেই ইচ্ছে আমাদের রাগ, আমাদের বদমেজাজ রূপে প্রকাশ পেতে থাকে। ছুড়ে ছিটিয়ে কটু কথার বানে দূর থেকে দূরে সরিয়ে দেয় প্রিয় মুখ গুলোকে।

এরপর? এরপর হয়তো কোনদিন সকল পিছুটান উপেক্ষা করে একদিন চাঁদের পিছু তার পথে হেঁটে বেড়াবো। কিংবা বাকি সবার মতই আমৃত্যু আক্ষেপ নিয়ে সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাবো...



লোকেশন: Bangladesh

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন