সুমন আর ফাহিমা, কলেজের কে চেনে না তাদের? ভিন্ন ভিন্ন শিফট, আর সেই ভিন্ন ভিন্ন শিফটেই নিজেদের দুষ্টামির জন্যে তারা সেরা। স্যারদের কটু কথা, হুমকি, নালিশ, গার্ডিয়ান ডেকে বিচার কোনটাই কাবু করতে পারেনি তাদের। মাস ৬ চলার পর স্যরেরাই তাদের দুষ্টামি নিয়ন্ত্রণে আনার হাল ছেড়ে দেয়। না ছেড়েই বা কি করবে? পড়ালেখায় তো আর দুষ্টামির জন্যে ফাঁকি দিচ্ছে না। ক্লাস টেস্ট, কোয়াটার টেস্ট সব কিছুতেই নিজেদের অবস্থান উপরের দিকেই ধরে রেখেছে তারা। সমস্যাটা যখন শুধুই দুষ্টামির তাহলে একটু ছাড় দেয়াই যায়, এই ভেবে ক্ষান্ত দিল তারা।
নিজেদের মধ্যে পরিচয় শুভ'র মাধ্যমে। দু'জনেরই কমন ফ্রেন্ড শুভ। ফাহিমা'র স্কুল ফ্রেন্ড আর সুমনের সাথে কলেজে পরিচয় হয় শুভ'র। কেমিস্ট্রি স্যর মিজানের কাছে তারা কোচিং করে একসাথে। শুভ'ই ডেকে নিয়ে ফাহিমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় সুমনের। ফাহিমার সাথে গল্প করার সময় সুমনকে ডেকে বলে- "দোস্ত! এইটা আমার দোস্ত। এইবার পরিচিত হয়ে নে।" এই শুভ'টাও কম ফাজিল না, ফামিহা এমনিতেই দুষ্টামির সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। মুখের উপরই বলে ফেললো- "তোর দোস্ত মানে তো আমারও দোস্ত। তাই না সুমন দোস্ত?” সুমন এই কথার পর আর যায় কোথায়। দুষ্টামিতে তো আর সেও কম যায় না। সাথে সাথেই উত্তর- "আব্বে দোস্ত! এইটা আবার কইতে হয় নাকি? আমরা সবাই তো গোল্লাছুট খেলার দোস্ত। কোন কথা নাই.." দুষ্টামিতে সবাই এক্সপার্ট সেইটা এক মুহূর্তেই বোঝা হয়ে যায় সবার।
কোচিং এ ও দুষ্টামি চলতো সমান তালে। তবে এখানে দুষ্টামির সাথে পড়ালেখার সিরিয়াসনেস একটু কলেজের তুলনায় বেশি ছিল সবার। নোট শেয়ারিং, কোচিং ক্লাস ডিসকাস আর মাঝে মাঝে ভিন্ন ভিন্ন স্যারদের প্রশ্ন জোগাড় করে নিজেদের মত করে প্রশ্নের গুরুত্ব খুঁজে নিতো তারা। ভালোই চলছিলো, কোচিং এর পর একটু ঘোরাঘুরি, ফাস্টফুড আর কফি শপেও আড্ডা চলতো তাদের। বন্ধুত্বটা একটু বেশি বেশি মনে হয়েছিল সকলের। আসলে সকলের না নিজেদেরও মনে হচ্ছিল। কিন্তু কেউ কখনো কাউকে কিছুই বলেনি। হয়তো বন্ধুত্বটা নষ্ট করতে চায় নি।
দেখতে দেখতে ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল চলে এল পড়ার চাপ বেড়ে গেলো সকলেরই। আড্ডা ইদানীং একেবারেই কম হয়। তবে প্রয়োজনে মাঝে মাঝে মোবাইল ফোনে আলাপ চলে। তারপর পরীক্ষা, অনেক টেনশন দুষ্টামি আর বিরক্তি নিয়ে পরীক্ষাটা ভালোয় ভালোয় শেষ করলো সকলেই। মাঝে ১২ দিন ছুটি ঘোষণা করলো কলেজ। ১২ দিন নিজেদের মত করে ছুটি কাঁটালো সবাই। যোগাযোগ ঐরকম করে আর করা হয়নি কারো সাথেই। ১২ দিন পরে আবার কলেজ আর কোচিং এর রুটিন মাফিক দৌড়াদৌড়ি শুরু। কিন্তু ৩ দিন হয় ফাহিমার কোন দেখা নেই। শুভ আর সুমন বার ২-৩ ফোনও দিয়েছিল, রিসিভ করেনি কিংবা কল ব্যাক ও করেনি সে।
আজ খোঁজ নিবো, কাল খোঁজ নিবো করতে করতে ৬ দিনের মাথায় ফাহিমাই ফোন দিয়ে সুমন আর শুভ'কে পরিচিত ফাস্টফুডে আসতে বলল বিকেলে। কি হয়েছে জানতে চাইলে তার উত্তর না দিয়ে কৌশলে এড়িয়ে গেল ফাহিমা। কোচিং শেষ করে বিকেল ৫ টার কিছু পর সুমন আর শুভ দুজনেই ফাস্টফুডে গিয়ে পৌঁছল। সারপ্রাইজটা তখনও অপেক্ষা করছিল তাদের জন্যে। তারা রেগুলার যে টেবিলটায় বসে আড্ডা দেয় সেখানে ফাহিমা আগে থেকেই অপেক্ষা করছে তাদের।
শুভ সোজা গিয়ে ফাহিমার ঘড়ে চেপে ধরেই বলতে শুরু করল-
» শয়তান! এতদিন কই ছিলি? খেয়ে দেয়ে তো মোটা হয়ে গেছিস। ফোন দিলাম এতগুলি করে খাওয়ার তালে ঐটাও শুনতে পাস নাই?
» আরে ছাড়! আজব তো! আগে কথা তো শুনবি। কোথায় জিজ্ঞাস করবি কেমন আছি না আছি। তা না, আগেই ঘাড়ে হাত।
» তোর কথা আর কি শুনবো? তুই তো খেয়ে দেয়ে মোটা হয়েই এসেছিস। ফর্সাও হয়েছিস কিছুটা।
» এই শয়তান, তোরে জিজ্ঞাস করছি আমি সুন্দর হইছি না মোটা হইছি?
বলেই উল্টা হাতে দিল শুভর পেটে এক কুনি। শুভ ফাহিমার ঘাড় ছেড়ে সুমনের পাশের চেয়ারটায় বসলো। এবার সুমন জিজ্ঞাস করলো-
» কি হয়েছে তোমার? আসলে না ফোনও রিসিভ করলে না, মেজর কোন সমস্যা ছিল নাকি?
» আস্তে ধীরে বৎস,আগে ঠাণ্ডা হও, ঠাণ্ডা খাও তারপর বলছি।
ইশারায় ওয়েটার ডাকল ফাহিমা, ওয়েটার আসলে তাকে বলল ৪ টা বার্গার আর ৪টা ঠাণ্ডা কিছু দেবার জন্যে। ওয়েটার চলে যাবার পর শুভ টিটকারি দিয়ে বলল-
» দেখ। এই কয়দিনেই খাওয়ার রুচি কত বেড়েছে মুটি টার। এখন ওর একারই ২টা বার্গার লাগে।
» শুভ!! একদম বাজে কথা বলবি না বললাম!! আর একজন আসছে, অর্ডারটা তার জন্যেই করেছি।
» আরও একজন? ঐটা আবার কে? কোন সুন্দরী কাজিন নাকি তোর??
» তোদের এই এক সমস্যা। কেউ আসবে শুনলেই সুন্দরী কাজিন আর বান্ধবী খুঁজিস তোরা।
» তো! আর কি ভাববো? আমরা তো স্ট্রেইট মাইন্ডের.... বুঝস না।
» হুম, বুঝিই তো তোরা কত বড় স্ট্রেইট শয়তান।
» এখন বল কে সেটা?
» আসুক, আসলেই বুঝতে পারবি।
অর্ডার দেয়া খাবার আসার আগেই একজন যুবক ফাস্টফুড শপে প্রবেশ করে আর ঠিক ফাহিমাদের টেবিলের সামনে এসে দাড়ায়। ফাহিমা তাকে দেখেই হেসে দেয়, আর বলে-
» সুমন, শুভ এ হচ্ছে ইমরান, পরিচিত হও। আর এরা দুইজন আমার খুব ভালো বন্ধু।
» হ্যালো সুমন এন্ড শুভ। নাইস টু মিট ইউয়্যু।
» নাইস টু মিট ইউয়্যু ঠ্যু, প্লিজ হ্যাভ এ সিট।
ইমরান নামের যুবকটি কোন ইতস্তত ছাড়াই ফাহিমার পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। এর পর ফামিহা বলতে শুরু করলো-
ফাহিমাঃ আমি এই কয়দিন আসি নি বা তোদের সাথে যোগাযোগ করি নি একটা বিশেষ কারণে।
শুভঃ কি কারণ?
ফাহিমাঃ এই যে ইমরান নামের ভদ্র চেহারার মানুষটা দেখছিস, এ আসলে যতটা দেখতে ভদ্র মনে হয় ততটা ভদ্র না। এই কয়দিন এই অল্প ভদ্র লোকটাকে একটু ভদ্রতা শিখিয়েছি।
শুভঃ মানে!!
ফাহিমাঃ মানে হচ্ছে.... পরীক্ষা শেষেই হুট করে এই অল্প ভদ্র লোকটার নামে আমাকে তিন কবুল পড়তে হয়েছে।
সুমনঃ কনগ্রাচুলেশন দোস্ত। কিন্তু এইভাবেই চেপে গেলি? আমাদের অন্তত একটা ফোন দিতে পারতি।
ফাহিমাঃ আরে কিভাবে দিবো। পরীক্ষা শেষ করে বাসায় পৌঁছেই আম্মুর মুখে শুনি এমন একটা ঘটনা। আমি নিজেই তো কিছু বুঝে উঠার আগে আমাকে কবুল বলিয়ে নিলো এই হতচ্ছাড়া লোকটা। আর তারপর গতকালই কেবল সিলেট ট্যুর থেকে ফিরলাম। আর এসেই প্রথমে তোদের সাথে যোগাযোগ করেছি।
সুমনঃ যাই হোক পার্টি কিন্তু পাওনা। মাফ হবে না কোন.....
ইমরানঃ মাফ চাইছে কে? সামনের সপ্তায় রিসিপশন অনুষ্ঠান হচ্ছে ঘটা করে। আপনারা দুইজন তার দুইদিন আগে থেকে ওখানে থাকবেন। কি থাকবেন তো??
সুমনঃ সে আবার জিজ্ঞাস করতে?
ফাহিমাঃ ঐক! তাহলে আমার দিক থেকে কে যাবে?
সুমনঃ আরে ধুর! তুই তো এখন পর। আপন তো ইমরান ভাই, হা! হা! হা! হা!
ফাহিমাঃ শয়তান! শুরুতেই পল্টি নিলি। মনে রাখিস কিন্তু...
তারপর আরও অনেকটা সময় আড্ডা দিয়ে বেরুলো তারা। ফাহিমা আর ইমরান ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একটা প্রাইভেট কারে করে ছুটলো। শুভ্র এতক্ষণ পর সুমনের দিকে তাকাল। সুমন হাসি মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করলো কতবড় অভিনেতা তার এই বন্ধুটি। পাক্কা অভিনেতাই বলতে হবে।
» কি করবি এখন?
» আর কি করবো? বাসায় যাবো। সন্ধ্যা তো হয়েই গেছে। কেন কোথাও যাবি?
» নাহ! কিন্তু....
» আরে এই তিনদিন একটু ভালো করে দেখে নিলে ঐ দুই দিন ম্যানেজ হয়ে যাবে। কোন কিন্তু নেই।
» সুমন শোন!
» আরে বলার আর কি আছে। তুই বাসায় বলে দেখ। আন্টি নিশ্চিত রাজী হবে এই দুইদিনের জন্য। আর আফটার অল ফাহিমার রিসিপশন বলে কথা।
» সুমন আমি কিন্তু এটা বলতে চাইছি না।
» কিছু বলতে হবে না, বাসায় যা ব্যাটা। বেশি রাত করলে কালকের ম্যাথ গুলি করে জমা দিতে পারবি না। আমি গেলাম।
বলেই আর কোন অপেক্ষা করলো না সুমন, সাইকেলটার দিকে হাটা দিল। শুভ দাড়িয়ে দেখছে, কিছুই বলতে পারলো না বন্ধুটাকে। হাসি খুশি এই দুষ্ট ছেলেটা এত চাপা স্বভাবের এটা কি এতদিন সে বুঝতে পেরেছিল? সত্যিই মানুষ কত আজব, আনন্দ গুলি দেখাতে পারলেও কেউ কেউ দুঃখ দেখাতে পারে না। পাশের কফি শপটাতে গান পরিবর্তন হয়ে পুরাতন একটা গান বেজে উঠলো....
চলে যাও.. বন্ধু তুমি চলে যাও..
হৃদয়ের বাধন ভেঙ্গে দিয়ে....
দেবনো না.. বাধা কোন দিবো না...
থেকে যাও.. নিজেকে নিয়ে....
দূরে... রবো আমি...
শুধু তোমার সুখ কামনায়....
স্মৃতি.... নিয়ে এই মন....
আজীবন ভালবাসবে তোমায়....
চলে যাও.. বন্ধু তুমি চলে যাও..
হৃদয়ের বাধন ভেঙ্গে দিয়ে....