সে অনেক...অনেকদিন আগের কথা। সেই দূর সিমান্ত পেরিয়ে সাগরের নীল ঘেষে ছিল এক রাজ্য। গল্পে গল্পে আমরা যে সুখ-সম্মৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ রাজ্যের কথা বলি, এই রাজ্যটি ছিলো ঠিক তারই এক জলজ্যান্ত উদাহরণ। সেই রাজ্যে গরীব থাকলেও কেউ অনাহরী ছিলো না। ক্ষুধা পেটে নিয়ে কেউ ঘুমাতে যেতো না। অভাবে স্বভাব নষ্ট করে কেউ সেখানে চুরি করতে যেতো না। পরিপূর্ণ সুখের নগরি বলতে আমরা যেমনটা কল্পনা করি, রাজ্যটি ছিল ঠিক সেই রকমের।
কিন্তু এত সব পূর্নতার মাঝেও সেখানে একটি অপূর্ণতা ঠিকই উপস্থিত ছিলো। সেই রাজ্যের যে রাজা, সে সুখে থাকলেও শারিরিক ভাবে সে ছিলো অপূর্ণ। সেই ছোট্ট কালে একবার দারুণ অসুস্থ হয়ে তাকে হারাতে হয় তার একটি পা আর একটি চোখ। অথচ শারিরিক এই অপূর্ণতা কখনোই তার হৃদয়ে ভালোবাসার কমতি ফেলেনি। যেমনটি তার হৃদয় ছিলো কোমলোতায় পরিপূর্ণ তেমনি তার মগজ ছিলো সুক্ষ্মবুদ্ধিতে ভরপুর। আর তাইতো রাজ্যের সবাই তাদের এই প্রজাবৎসল রাজাকে সত্যিকার অর্থেই হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতো, তার মঙ্গল কামনা করতো।
তো একদিনের কথা, সেদিন রাজা দরবারের কাজ শেষ করে তার প্রাসাদ ঘুরে ঘুরে দেখছিলো। প্রাসাদের হলঘর ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে গিয়ে চোখ পড়লো তার পূর্বপুরুষদের তৈলচিত্রের দিকে। চিত্রে তার সব পূর্বপুরুষ ব্যক্তিত্ব দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। এই হল দিয়ে পার হবার সময় ছবিগুলোতে চোখ পড়লেই গর্বে তার বুক ফুলে উঠে। সে জানে, তার মতই তার অনুজেরা এই হল দিয়ে হেঁটে যাবার সময় গর্বিত হবে। তারা এই তৈলচিত্র দেখেই তাদের পূর্বপুরুষদের বুঝতে শিখবে, স্মৃতিতে জড়িয়ে রাখবে। তাদের ব্যক্তিত্ব আর মহত্বকে নিজেদর মধ্যে ধারণ করবে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই মনে পড়লো, পূর্বপুরুষদের এই সারি সারি ছবির মধ্যে এখনো তার ছবিটি স্থান পায় নি। আর পারবেই বা কিভাবে! তার এই অপুর্ণ শারিরিক অবস্থা এতটা প্রসন্ন হয়নি যে বলিষ্ঠ একটি চরিত্র ঐরকম একটি তৈলচিত্রে ফুটে উঠবে। এই ভেবেই হঠাতই তার মন খারাপ হয়ে উঠলো। তারপরও সে হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। পরবর্তি দিনই রাজসভায় সে এই কথা উঠালো। আর তারপরই নানা রাজ্যের চিত্রকরদের তার রাজদরবারে নিমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হলো।
দূর দূরান্ত থেকে অনেক নামীদামী চিত্রকর উপস্থিত হলো সেই দরবারে। উপস্থিত সেই মজলিসে রাজা বললেন-
আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ আমার আমন্ত্রণে সাড়া দেবার জন্যে। আমি খুবই আনন্দিত যে আপনারা এত অল্প সময়ে নিজ নিজ ব্যস্ততা ফেলে আমরার আমন্ত্রণ রক্ষা করতে আমার দরবারে উপস্থিত হয়েছেন। অবশ্য এভাবে আপনাদের আমন্ত্রণ জানাবার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণও রয়েছে।
আপনারা সকলেই জানেন আমাদের এই রাজপরিবারের শেকড় এই রাজ্যের গোড়াপত্তন থেকেই রাজ্যকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করে আসছে। আমার সকল পূর্বপুরুষেরা বেশ সফলতার সাথেই তাদের এই রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ আর নিরাপত্তা প্রদাণ করেছে। আর সেই ধারাবাহিকতায় আজকে এই সিংহাসনে আমার অবস্থান।
পূর্বপুরুষদের মত না হলেও আমি চেষ্টা করেছি আমার সর্বোচ্চোটা দিয়ে তাদের এই সফলতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে। কিন্তু তবুও আমার শারিরিক অপূর্ণতা আমাকে কিছু বিষয় থেকে হয়তো পিছিয়ে রেখেছে। হয়তো আমার এই অপূর্ণতা আমার মাঝেও একটি হীনমন্যতা সৃষ্টি করেছে। আর সেই হীনমন্যতার কারণেই এখন অব্দি আমি আমার পূর্বপুরুষদের পারিবারিক তৈলচিত্রের সাথে নিজের একটি চিত্র এখনো স্থান দিতে পারি নি।
বন্ধুগন, অনেক দেরিতে হলেও আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার পূর্বপুরুষেরা তৈলচিত্রের যে মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট আর বলিষ্ঠতার বার্তা তাদের অনুজদের নিকট পৌঁছানোর জন্যে রেখে গেছেন; সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আমিও আমার একটি চিত্র আমার পূর্বপুরুষদের সাথে রেখে যেতে চাই। যাতে আমার পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের তৈলচিত্র দেখে আমাদের বুঝতে পারে, অনুধাবন করতে পারে, তৈরি করতে পারে আপন বৈশিষ্ট আমাদের আদলে।
সম্মানিত বন্ধুগন, আপনারা সকলেই আমার শারিরিক অপূর্ণতা লক্ষ করেছেন। আমি চাই না আমার এই শারিরিক অপূর্ণতা সেই চিত্রে স্থান পাক। বরং আমি চাই এই শারিরিক অপূর্ণতা ঢেকে এমন একটি তৈলচিত্র তৈরি হোক, যা দেখে আমার পরবর্তী প্রজন্মের অনুজেরা অনুপ্রেরণা পাবে; যেমনটি আমি আমার পূর্বপুরুষদের চিত্র দেখে পেয়েছি।
আর এমন একটি অসাধারণ চিত্র অঙ্কনের দায়িত্ব আমি আপনাদের উপর অর্পন করছি। যদি আপনাদের মাঝে কেউ এই অসম্ভবটি সম্ভব করতে পারেন তাকে এই দরবার হতে পুরস্কৃত এবং সম্মানিত করা হবে।
রাজার এমন আহ্বানে সকল চিত্রশিল্পী চিন্তায় পড়ে গেলো। একজন রাজা, যার একটি চোখ এবং একটি পা নেই; আদৌ কি তার এমন কোন চিত্র অঙ্কন করা সম্ভব যা হবে তার পূর্ববর্তী পুরুষদের মত বলিষ্ঠ আর আকর্ষনীয়! নামী দামী সকল চিত্রকরই অনুধাবন করলেন এমন আকর্ষণীয় কোন চিত্র আসলে তৈরি করা সম্ভব নয়। আর যদি চিত্রে ভুল করে কেউ তার এই অপূর্ণ প্রতিকৃতি ফুটিয়েই তোলে তাতে রাজার আপন ব্যক্তিত্ব পরবর্তী প্রজন্মের নিকট প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে রইবে। আর সেটি দেখে রাজার মনক্ষুন্ন হতে পারে, যার ফলাফল হিসেবে মিলতে পারে কঠিন শাস্তি। তাই একে একে সকল চিত্রশিল্পীই নানান ছুতোয় নিজেদের ব্যর্থতা প্রকাশ করতে লাগলেন।
কিন্তু আমন্ত্রিত এই চিত্রশিল্পীদের মাঝেই এক অখ্যাত চিত্রকর হাত তুলে রাজার দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা করলেন। রাজা যখন তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে কথা বলবার অনুমতি দিলেন তখন সেই চিত্রকর বলল- আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনি যা চাচ্ছেন তা আমি তৈরি করে দিতে পারবো। কিন্তু আমি যেহেতু কোন খ্যাতমান চিত্রকর নই তাই আপনি আদৌ কি আমাকে আপনার তৈলচিত্রটি অঙ্কন করার অনুমতি প্রদাণ করবেন?
চিত্রকরের এমন কথা শুনে রাজা বললো- আমি খুব আনন্দের সাথেই আপনাকে আমার এমন একটি চিত্র অঙ্কনের অনুমতি প্রদাণ করলাম।
বাকি সব নামী-দামী চিত্রকর এমন প্রস্তাবে হতবাক হয়ে গেলো। তারা ভেবেই পেলো না কিভাবে এমন একটি চিত্র তৈরি হবে যেখানে রাজার অপূর্ণতা ঢেকে তাকে বেশ আকর্ষণীয় ভাবে উপস্থাপন করা যাবে! তাও আবার সেটি আঁকবে এক অখ্যাত চিত্রকর, যার নাম আজকের এই মজলিসে উপস্থিত হয়েও অনেকের অজানা!
রাজার অনুমতি নিয়েই সেই অখ্যাত চিত্রকর তার কাজ শুরু করলেন। রাজদরবারের এক কোনে তাকে তার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি প্রদাণ করা হলো। আর সকল সরঞ্জমাদি হাতে পেয়েই শুরু করলো চিত্রকর তার কাজ।
ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে যাচ্ছে। সব চিত্রকরের মধ্যে ফিস্ফিস শব্দে নানা কথা ঘুরছে দরবার জুড়ে। সবাই আশঙ্কা করছে আজই গর্দান যাবে এই গর্দভ চিত্রকরের।
দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা, সকলেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে চিত্রকরের তৈরি সেই কাঙ্খিত চিত্রটি দেখবার জন্যে। দিন গরিয়ে সন্ধ্যায় সকলেই ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। কিন্তু তাদের আগ্রহের সামনে তাদের ক্লান্তি আর ক্ষুধার যেন মৃত্যু ঘটেছে আজ।
সন্ধ্যার বেশ খানিকটা পর চিত্রকর তার হাতের ব্রাশটি রাখলেন। জানালেন তার কাজ সমাপ্ত হয়েছে। সাথে সাথেই দুইজন প্রহরী এসে চিত্রকরের ক্যানভাসটি রাজদরবারের দিকে ঘুরিয়ে দিলো। মজলিসে উপস্থিত সকল মন্ত্রী, সকল সভাসদস্য, খ্যাতিমান চিত্রকরেরা এমনকি খোদ রাজা নিজেই সেই চিত্র দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে রইলেন!
এ কি করে সম্ভব! এমনটাও যে হতে পারে তা কি ভেবে দেখেছিল কেউ!
রাজা ঠিক যেভাবে তার তৈলচিত্রে তার ব্যক্তিত্ব আর বৈশিষ্টকে ফুটিয়ে তুলতে অনুরোধ করেছিলেন, ঠিক ঐভাবেই তাকে এই তৈলচিত্রে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বিস্ময়ে কারও মুখে কোন রা'ও ফুটলো না।
চিত্রকর তার ঐ তৈলচিত্রে রাজাকে একেছেন এমন একটি ভঙ্গিমায় যেখানে রাজা একটি ঘোড়ার উপর বসে আছেন, আর সে তার একটি চোখ বন্ধ করে আরেকটি চোখ দিয়ে তীরের নিশানা ঠিক করছেন। তার ঐ ভঙ্গীমায় তার সেই অপূর্ণ একটি চোখ আর একটি পা সম্পূর্ণরূপে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। আর একই সাথে প্রকাশ পাচ্ছে রাজার বিচক্ষণতা, বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব আর রাজা হিসেবে তার রাজ্যের রক্ষণক্ষমতা!
তৈলচিত্রটি দেখে রাজা দারুণ খুশি হয়ে উঠলেন। আর একই সাথে ঐ অখ্যাত চিত্রশিল্পীকে এই রাজ্যের প্রধাণ চিত্রশিল্পী হিসেবে ঘোষনা দিলেন। সাথে আরও দিলেন মূল্যবান অনেক পুরস্কার।
⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎ নীতিনিষ্ঠ মূল্যায়ন ⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎
আমাদের সকলেরই উচিৎ অন্যের ঘাটতিকে উপেক্ষা করে তাদের ইতিবাচক দিককে গ্রহণ করা, তাকে প্রকাশ করা। আমাদের শেখা উচিৎ কিভাবে নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা প্রতিভাটি সকলের সামনে ইতিবাচক ভাবে উপস্থাপন করা যায়। যদি আমরা নেতিবাচক অবস্থাতেও ইতিবাচক চিন্তা করতে পারি, ইতিবাচক মনোভাব দেখাতে পারি তাহলে আমরা আরও বেশি দক্ষতার সাথে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমাদের সকল সমস্যাকে সমাধান করতে সক্ষম হবো। আমাদের ভেতর যেসকল দূর্বলতা ঘাপটি মেরে রয়েছে, সে সকল দূর্বলতা ঢাকতেই আমরা সদা সচেষ্ট থাকি। অথচ যদি ইতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ আমরা ঘটাতে পারি তখন আমাদের ঐসব দূর্বলতা কাটিয়ে আমরা সকলেই একই কাতারে এসে দাড়াতে পারবো। হতে পারবো নিজ নিজ ক্ষেত্রের শ্রেষ্ঠতম একজন!
…………………………………………
মূল লেখকঃ অজ্ঞাত
সোর্সঃ "Moral Stories" via pinterest.com