বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ০৩, ২০১৬

আত্মহত্যার প্রভাবন



কথায় মানুষ খুব দ্রুত প্রভাবিত হয়, তবে সবার কথায় না। কিছু কিছু মানুষ আজীবন শুধু বলেই যায়, তাদের কথা কেউ বিশেষ কর্ণপাত পর্যন্ত করে না। কিন্তু এই কিছু মানুষের বাইরে আরও অল্প কিছু মানুষ থাকে, যাদের দীর্ঘশ্বাসও মানুষের মনে বিশেষ অর্থ জাগিয়ে তোলে। ঠিক কী কারণে কিংবা কেন এমনটা হয় তার সঠিক কোন ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব না। এমন না যে তারা দেখতে সুদর্শন কিংবা তাদের কণ্ঠ সুমধুর বলেই এমনটা হয়। অথবা তাদের চিন্তাভাবনা অন্য সকলের তুলনায় অনেক অনেক ভিন্নতর হয়, এমনও নয়। তারাও আর দশজন সাধারণের মতই চিন্তাভাবনা করে একদম সাধারণ কথাই বলে। তবুও এই সাধারণ কথাই অন্য সকলের কাছে অসাধারণ কিছু হয়ে উঠে।

এরকম একটা হিসেব কষে যদি ভাবা হয় তবে আমাকেও সে তালিকার একজন ধরা যেতে পারে। অবশ্য এর কৃতিত্ব একক ভাবে আমার নয়। এই ব্যাপারটার সাথে বংশানুক্রমিক জিনের কোন একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। একদম নিশ্চিত না হলেও আমার জন্যে এমনটা ভাবা একদম অমূলক বলা যাবে না। কারণ জ্ঞান হবার পর থেকেই দেখেছি আমার বাবার কথায়ও মানুষ খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তার কোন একটা সিদ্ধান্ত বিনাবাক্যে সকলে মেনে নেয়। তার উত্তরসূরী হিসেবে আমার কথাতেও মানুষের গুরুত্ব কিংবা প্রভাবিত হবার ব্যাপারটা আমাকে কখনোই তেমন অবাক করত না।

হ্যাঁ, একটা সময় পর্যন্ত সত্যিই এই ব্যাপারটা আমায় মোটেই অবাক করত না। কিন্তু সব পরিবর্তন হয়ে গেল ছোট একটা দুর্ঘটনা ঘটবার পর। ঠিক কি কারণে জানা নেই, একদিন বিকেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবার সময় শিমুল যখন ওর গার্লফ্রেন্ডের প্যারা নিয়ে আক্ষেপ করছিল তখন বলেছিলাম- 'তোর উচিৎ সিলিং ফ্যানের তিন পাখায় তিনটা গামছা বেধে ঐ তিনটা একত্রে করে একটা ফাঁস বানিয়ে তারপর তা গলায় গলিয়ে ঝুলে পরা'। 

ব্যাস ঐ ওটুকুই কথা, আসলে আমরা প্রতিদিন ওর ঐ এক ঘ্যান ঘ্যান শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই কিছুটা বিরক্ত আর মজা করার জন্যেই ও কথা বলেছিলাম। বাকি সবাইও ঐ মজার কথাটাকে মজা ধরে নিয়েই ওকে ক্ষেপাচ্ছিল। কেউ কেউ ঐ অবস্থাতে সেল্ফি তুলে ওর গার্লফ্রেন্ডকে পাঠানোর আইডিয়া দিচ্ছিল, আবার কেউ বলছিল গার্লফ্রেন্ডকে উদ্দেশ্য করে সুসাইড নোট লিখে তারপর ঝুলে যাবার জন্যে।

এরপরই দ্বিতীয় ভুলটা করলাম; অবশ্য তখন ওটাকে কোনভাবেই আমার ভুল মনে হচ্ছিল না। বললাম- 'সবচেয়ে ভালো হয় তুই যদি ঝুলে যাবার পুরো ব্যাপারটা লাইভ করে দেখাস, তাতে জনগনের সাপোর্ট আর গার্লফ্রেন্ডের উপর প্যারার রিভেঞ্জ নেয়া, দুটোই হয়'। আর যায় কোথায়, সকলেই আমার আইডিয়াকে বাহ্‌বা দিতে দিতে শিমুলকে এই কাজ করার জন্যেই কথার খোঁচা মেরে যাচ্ছিল।

তারপর সন্ধ্যাটা ওভাবে শেষ করে যে যার বাসায় কিংবা মেসে ফিরে গেলাম। খুব ঘুম পাচ্ছিল বলে ফিরে এসে ফ্রেশ হয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই ঘুম ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে একদম রাত আড়াইটা! মোবাইলটা সাইলেন্ট করা ছিল, তাই কিছুই টের পাই নি। স্ক্রিনে দেখলাম মিসকলের বিশাল এক নোটিফিকেশন লিস্ট দেখা যাচ্ছে। ৮৬টা মিস কল সেখানে! এক একজন গড়ে ৬~৭ বার করে কল করেছে। সবার উপরের নাম্বারটা ছিল সুমনের। তাই ওকেই কল ব্যক করলাম। রিং পুরোটা হবার আগেই ও প্রান্ত থেকে কলটা রিসিভ হয়ে গেল!

খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে সুমন বলল- 'দেখেছিস?'। সুমনের এই উত্তেজনার জন্যে ওর সাথে কথা বলাই দুস্কর। ছোটখাটো থেকে শুরু করে গুরুতর সব কিছুতেই ওর সীমাহীন উত্তেজনা কাজ করে। তাই বোঝা দুস্কর কোনটা আসলে উত্তেজিত হবার মত ঘটনা, আর কোনটা সাধারন। তাই প্রশ্নের বিপরীতে ওকে প্রশ্নই করতে হল-'কী?'
- কী মানে? তুই এখনো দেখিসনি? কোথায় তুই? কই ছিলি এতক্ষণ?
- আরে ব্যাটা ঘুমাচ্ছিলাম। এখন বল কি দেখবো? হয়েছে টা কি?
- তার মানে তুই কিচ্ছু জানিস না?
- আরে এত্ত না পেঁচিয়ে কি দেখব, আর কি জানতে হবে সেটা বলতে পারিস না?
- তুই দ্রুত ফেসবুকে লগইন কর, আর শিমুলের ওয়ালে ঢু মেরে আমাদের গ্রুপ চ্যাটে দেখ।
বলেই কলটা কেটে দিল। ব্যাটা আহাম্মকের আহাম্মক, কি হয়েছে সেটা না বলে আমাকে বলে কিনা ফেসবুকে ঢুকতে। তবে শিমুলের কথা বলায় একটু আগ্রহ হল। বিকেলেই গার্লফ্রেন্ডের প্যারা নিয়ে কান্নাকাটি করছিল। মনে হয় এবারে ব্যাটা ব্রেকআপ-ট্রেকআপ কিছু একটা করে ফেলেছে। আর সেটা নিয়েই সুগভীর কোন পোষ্ট দিয়ে বসে আছে ফেসবুকে। অবশ্য এমনিতেও এখন আমি ফেসবুকেই ঢু মারতাম।

ফেসবুক এ্যাপটা চালু করে শিমুল নামটা সার্চ দিয়ে ওর প্রোফাইলে গলাম। সেখানে একটা লাইভ ভিডিওর পোষ্ট রয়েছে। অবশ্য এখন আর লাইভ নেই, প্রায় ঘন্টাখানিক আগে সেটা শেষ হয়েছে। এখন ওটার ভিডিওটা পোষ্ট হিসেবে রয়ে গেছে। ব্যাটা নিশ্চিত গার্লফ্রেন্ডের প্যারার বর্ণনা দিয়ে কান্নাকাটি করতে করতে বিশাল কোন ইমোশনাল লাইভ ভিডিও করেছিল। ক্লিক করলাম ভিডিওটাতে, কিন্তু ক্লিক করে যা দেখলাম সেটার জন্যে আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।

শিমুল প্রথমে ক্যামেরাটা ওর রুমের বুকসেলফের কোথাও সেট করল, মোটামুটি ঐ পজিশন থেকে ওর রুমের বিশাল একটা অংশ তাতে স্ক্রিনে চলে আসে। এরপর একটু দুরত্বে দাড়িয়ে শুরু করল ওর গার্লফ্রেন্ডের প্যারার বন্দনা। এতটুকু অবশ্য আমি আশা করেই রেখেছিলাম। কিন্তু ঐ অবস্থাটা বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হল না, কথার মোড় ঘুরে গেল আমার নাম উচ্চারণের সাথে সাথে। নাম ধরেই বলল আজ বিকেলে কি আইডিয়া দিয়েছিলাম ওকে, আর সেই আইডিয়াই সে এখন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে বলে ঘোষনা করল!!

তারপর বিছানার উপর হতে কিছু একটা তুলল, হাতে নেবার পর বুঝলাম ওগুলি আসলে গামছা। ওর স্টাডির চেয়ারটা বিছনার উপর তুলে তার উপর ও দাড়াল। এরপর ঠিক যেভাবে বলেছিলাম ওভাবেই তিনটি গামছা সিলিং ফ্যানের তিন পাখায় বাধল। আর তারপর গামছা গুলি একত্র করে ওটা দিয়ে একটা ফাঁস তৈরি করল। আমি নিশ্বাস চেপে ওর কাণ্ডকারখানা দেখছি। তবে মনে মনে ক্ষীণ একটা আশা চেপে ধরে আছি যে শেষ পর্যন্ত ও আসলে ওরকম কিছু করবে না।

তারপর আবার চেয়ার হতে বিছানা আর বিছানা হতে নেমে স্ক্রিনের সামনে এসে দাড়াল। সত্যি সত্যি এর পরে যা কিছু ঘটবে তার জন্যে সকল দায়ভার ও ওর গার্লফ্রেন্ডের উপর দিল আর আমাদের সবাইকে বিদায় জানাল।
এবার আমি সত্যি সত্যি ঘামতে শুরু করলাম। অন্য মোবাইলটা দিয়ে ততক্ষনে আবারও সুমনকে ফোন করতে শুরু করেছি। রিং হচ্ছে কিন্তু ব্যাটা এখন আর ফোন উঠাচ্ছে না। আর এদিকে মোবাইল স্ক্রিনে দেখছি শিমুল আবারও বিছানার উপর দাড় করানো চেয়ারটাতে উঠে দাড়িয়েছে। এরপর কাঁপা কাঁপা হাতে তিন গামছা দিয়ে তৈরি ফাসটা গলায় পড়ে নিচ্ছে।

গামছার ফাসটা গলায় গলিয়ে দেবার পর ঐ অবস্থাতেই চিৎকার করে বলল- "দোস্ত তোকে ধন্যবাদ চমৎকার এই আইডিয়াটা দেবার জন্যে"। এরপর বাকিটুকু আর দেখা হল না, হাত থেকে মোবাইলটা খসে পড়ল আপনা-আপনি।



তারপর কিভাবে কি হয়েছে তা আর আমি তেমন পরিস্কার ভাবে বলতে পারছি না। ঘোরের মাঝে সময়টা পার হয়েছে আমার। মাথাটা পুরো ঝিম মেরে ছিল পরের পুরোটাা সময়। তবে এখন মাথাটা আবার পরিস্কার ভাবে কাজ করতে শুরু করেছে। আর কিছুক্ষন পরেই কয়েকজন গার্ড আসবে আমাকে এই সেলটা থেকে নিয়ে যেতে।

ঠাণ্ডা মাথায় উদ্দেশ্যপ্রনেদিত ভাবে বন্ধুকে আত্মহত্যা করার নিমিত্তে প্রভাবিত করার জন্যে কোর্টে বিজ্ঞ বিচারক আমার 'মৃত্যুদণ্ডাদেশ' কার্যকর করার রায় দিয়েছেন.....




মঙ্গলবার, অক্টোবর ২৫, ২০১৬

সামাজিক মূল্যায়ণঃ চটকদার অভিনেতা বনাম প্রকৃত সত্যপরায়ণ মানুষ



একবার এক ভদ্রলোক ফ্রান্সে ঘুরতে গেলে এক বিলবোর্ডে তার নজর আটকে যায়। সেটি ছিল এক প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠানের বিলবোর্ড। প্রতিযোগীতার বিষয়বস্তু ছিল, বিখ্যাত কৌতুকাভিনেতা স্যর চ্যারলি চ্যাপলিনকে অনুকরণের অভিনয় প্রতিযোগীতা (Charlie Chaplin Lookalike Contest)।

অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্যে অনেক প্রতিযোগীই ইতোমধ্যে সেখানে উপস্থিত হয়েছে। সকলেই চার্লি চ্যাপলিনের মত পোষাক পড়ে, আর তার মত মেকআপ নিয়ে সেখানে উপস্থিত। ভদ্রলোক ব্যাপারটি দেখে দ্রুত তার হোটেলে চলে গেলেন আর খুব দ্রুত সেজে-গুজে আবারও সেখানে ফিরে আসলেন; নাম লেখালেন ঐ প্রতিযোগীতায়।

নির্দিষ্ট সময় পর প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়ে আবার শেষও হয়ে গেল। সকলেই নিজ নিজ প্রতিভা আর অভিনয় গুনকে কাজে লাগিয়ে মঞ্চে নিজেকে চার্লি চ্যাপলিনের রূপে উপস্থাপন করে গেল। তাদের অভিনয় দেখে মনেই হচ্ছিল না যে তারা আলাদা আলাদা কোন মানুষ। বরং মনে হচ্ছিল তারা বুঝি সকলেই এক একজন চার্লি চ্যাপলিন। তবুও যখন এটি একটি প্রতিযোগীতা, তাই তাদের মাঝে যারা ভালো করেছিলেন তাদেরকে বিজয়ী হিসেবে নির্বাচিত করা হচ্ছিল। একে একে সকল বিজয়ীদের নাম ঘোষনা করা হল। দেখা গেল ফ্রান্সে ঘুরতে আসা ঐ ভদ্রলোকটিও প্রতিযোগীতায় জিতে গেছেন। তবে তিনি প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় না হয়ে হয়েছেন সপ্তম স্থান অধিকারী। আর ঐ প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠানে কেবল ঐ সাতজনকেই বিজয়ী ঘোষনা করা হয়।

মজার ব্যাপার হল প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করে সপ্তম হওয়া ঐ ভদ্রলোক আর কেউ নন; সয়ং স্যর চার্লি চ্যাপলিন।

এমন ঘটনার পর স্যর চার্লি চ্যাপলিন ভাবতে বসলেন-
আসলেই কি তিনি নিজে প্রকৃত চার্লি চ্যাপলিন? নাকি যে ছয়জন অভিনয় গুণে তাকে টপকে গেছে তারাই এক একজন প্রকৃত চার্লি চ্যাপলিন?

এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই তিনি অনুধাবন করলেন-
তারা সকলেই কেবল চার্লি চ্যাপলিনের বাহ্যিক রূপ, তার চালচলন, চলচিত্রে প্রদর্শত অভিব্যক্তিকেই নকল করে নিজেদের মাঝে ধারণ করতে পারে। ভেতর থেকে চার্লি চ্যাপলিনের অন্তর, তার ভাবনা কিংবা তার স্বাধীন চিন্তা-চেতনাকে কোনভাবেই কোনদিন নকল করতে পারবে না। আর এমনটা যে শুধু তার বেলায়তে ঘটবে তা কিন্তু নয়; বরং এ দুনিয়ার কারোর হৃদয়, চিন্তা-চেতনা, বিচারভঙ্গী অন্যকেউ এভাবে নকল করে নিজের মাঝে ধারণ করতে পারবে না। সেটা কোনভাবেই সম্ভব নয়।

কিন্তু আমারদের সমাজ, সমাজে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী, এই দুনিয়া কোন কিছুই অন্তর দিয়ে চলে না; তারা চলে অভিনয় গুণে। যে ব্যক্তি যত বড় অভিনেতা, তার গ্রহনযোগ্যতা এ দুনিয়াতে তত বেশি।

আর সেই ভাবনার অনুধাবন থেকেই স্যর চার্লি চ্যাপলিন লিখেছিলেন-
We live in a world where showman succeed and the true man fail






¶ বর্ণিত ঘটনাটি গালগপ্প হিসেবেই প্রচলিত। স্যর চার্লি চ্যাপলিনের জীবন ঘটনা নিয়ে লেখা কোন বই কিংবা দলিলে উপরুক্ত ঘটনার গ্রহণযোগ্য কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। পাশাপাশি প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠানের স্থান নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। মূলত ঐ সময় খুব জনপ্রিয় একটি প্রতিযোগীতা ছিল এটা। প্রায় প্রতিটি বড় শহর আর উল্লেখযোগ্য প্রতিভা অন্বেষণ করা বিভিন্ন আয়োজকেরা এটি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে এমন প্রতিযোগীতার আয়োজন করছিলেন। একই সাথে প্রতিযোগীতায় স্যর চার্লি চ্যাপলিনের সপ্তম অবস্থান নিয়েও অনেক দ্বিমত রয়েছে। তবুও হাজার বিতর্কে ভরা এই গালগল্পটির বিষয়বস্তু কোনভাবেই 'গালগল্প' হিসেবে ধরে নেয়া সম্ভব নয়।






সোমবার, অক্টোবর ১৭, ২০১৬

রম্যঃ বিল আর জব্‌স এর গোপন কথোপকথন


স্টিভ জব্‌স গত হয়েছেন বেশ কয়েক বছর হল। প্রযুক্তির মানুষ, তার উপর প্রতিভাবান। শান্তির ঘুম ঘুমিয়েও ওপারে শান্ত ছেলের মত বসে থাকতে পারেন নি। ওপারে গিয়েই সকলের খোজ খবর নিতে আর প্রিয় বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করার জন্যে একটা স্পেশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করে ফেললেন। তারপর সেই গোপন নেটওয়ার্কের অতি গোপন এক চ্যানেল দিয়ে যোগাযোগ করলেন প্রাণপ্রিয়(!) বন্ধু বিল গেট্‌সের সাথে। কিন্তু আমাদের দুষ্টু হ্যাকারেরা ঠিকই সেই অতি গোপন চ্যানেলের খোঁজ পেয়ে যায়। আর সেখানেই কান পেতে শুনে নেয় দুই বন্ধুর কথোপকথন...

রিং রিং টিং....রিং রিং... টিং...

বিল গেট্‌সঃ হ্যালো!

স্টিভ জব্‌সঃ কি হে বন্ধু! কেমন আছো?

বিল গেট্‌সঃ আরে! জব্‌স নাকি? কি খবর ভায়া?

স্টিভ জব্‌সঃ খবর তো সব তোমাদের কাছে, আমি তো সব খবরের বাইরে চলে এলাম। ভুলে গেলে?

বিল গেট্‌সঃ আরে কি যে বল না। তোমাকে কি আর চাইলেই ভোলা যায়? শুধু আমিই নই, বরং তোমার আবিষ্কার গুলির বদৌলতে মানুষ আমার চেয়ে বেশি তোমাকেই নিয়ে আলোচনা করে।

স্টিভ জব্‌সঃ হা হা! তাই নাকি? তাহলে নিশ্চই খুব বাজে অবস্থা চলছে দুনিয়াতে।

বিল গেট্‌সঃ তা যা বলেছ। তুমিই ভালো করেছো। নিজের নামের সাথে সম্মানটাকে নিয়ে আগেই কেটে পড়েছ। আর আমরা রয়ে গেলাম বদনামের সকল কোটা পূরণ করার জন্যে।

স্টিভ জব্‌সঃ আরেহ্‌ নাহ! দেখছি তো কি অবস্থা চলছে ওখানে। সেদিন দেখলাম আমার কোম্পানি iPhone 7 রিলিজ করেছে। আহাম্মক গুলি নিজে থেকে এখনো কিছুই করতে পারছে না। আমার হ্যান্ড স্কেচ গুলি উল্টো পাল্টা কোনরকম বুঝে iPhone এর নামটাকে বদনাম করছে দিন দিন। আর সেই বদনামের ভাগীদার এপারে বসে আমিও হচ্ছি সমান তালে।

বিল গেট্‌সঃ আচ্ছা, বাদ দাও ওসব কথা। তোমার কথা বল। তোমার ওদিকে সময় কেমন কাটছে? আচ্ছা ওপারের ব্যাপার স্যাপার কেমন, একটু বল তো শুনি।

স্টিভ জব্‌সঃ এপারের ব্যাপার স্যাপার একদম মন্দ না। তবে তোমার জন্যে খুব বড় একটা দুঃসংবাদ আছে বন্ধু।

বিল গেট্‌সঃ দুঃসংবাদ! বল কি? এখনো তো ওপারে গেলামই না, তার আগেই দুঃসংবাদ! তা কি দুঃসংবাদ একটু বলবে?

স্টিভ জব্‌সঃ হ্যাঁ, বিরাট দুঃসংবাদ বলতে পারো। এপারে সবই আছে, কিন্তু কোন বাউন্ডারি নেই।

বিল গেট্‌সঃ এ্যা! তা এটা কেমন দুঃসংবাদ হল?

স্টিভ জব্‌সঃ আহা! বুঝছো না কেন? সৃষ্টিকর্তা খুব চালাকির সাথে এই কাজটা করেছেন। তিনি কোন বাউন্ডারিই রাখেন নি কোথাও। আর তাই এপারে করাও কারও windows (জানালা) কিংবা Gates (দরজা) এরও প্রয়োজন হয় না।

বিল গেট্‌সঃ ওহো! তবে বিরাট দুঃসংবাদই বলতে হয়। তবে আমার মনে হয় কি জানো? দুঃসংবাদ আমার জন্যে যেমনই হোক, তোমার দুঃখ বোধ কিন্তু এপারের তুলনায় ওপারেই বেশিই।

স্টিভ জব্‌সঃ কেন? কেন?? আমার দুঃখ বোধ বেশি হবে কেন?

বিল গেট্‌সঃ না, মানে..। আসলে সৃষ্টিকর্তা তো সৃষ্টির শুরুতেই Apple(আপেল) ধরা-ছোঁয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। আর তার উপর তুমি ওপারে যাবার আগেই সবাইকে বুঝিয়ে-পড়িয়ে দিয়েছিলে যে Apple এর দাম কেমন চড়া হতে পারে। তাই বোধ করি ওপারে Apple প্রোডাক্ট কেউ লোভে পড়েও ধরে ছুঁয়ে দেখবার ইচ্ছে করবে না।

স্টিভ জব্‌সঃ তা অবশ্য খারাপ বল নি। তবে কি জানো? এপারে কিন্তু Apple এর জন্যে কিন্তু কোন Bill করা হয় না, একদম ফ্রি। এখানে-সেখানে ঝুলে আছে। আর ভয়েস কমান্ড আর মাইন্ড রিডিং সিস্টেম এত উন্নত যে, কারও ইচ্ছে হলে ওগুলি না ছুঁয়েই নিজেদের কাজ অনায়াসে করে নিতে পারে।

বিল গেট্‌সঃ তাহলে তো ব্যাপারটা তোমার জন্যে ব্যালেন্স হল মনে হচ্ছে।

স্টিভ জব্‌সঃ কেমন? কেমন??

বিল গেট্‌সঃ মানে এপারে তোমার কোম্পানিটা তোমাকে ছাড়া Jobs Less, আর ওপারে তুমি নিজে Jobs Less। তবে তুমি তাতে খুব বেশি বিচলিত হয়ো না। যেভাবে আইফোনের ডেভেলপমেন্ট এগুচ্ছে তাতে অচিরেই তোমার কর্মীরাও Steve-এর শূন্যতা মানে Jobs Less অবস্থাটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারবে।

স্টিভ জব্‌সঃ হা হা হা! আচ্ছা বন্ধু, উঠতে হচ্ছে এখন। গার্ডটা সম্ভবত এই নেটওয়ার্কের খবর টের পেতে শুরু করেছে। পাই পাই করে এদিক সেদিক খোঁজা খুঁজি করছে।

বিল গেট্‌সঃ আচ্ছা যাও, তবে সময় পেলে আবার যোগাযোগ করো কিন্তু।

স্টিভ জব্‌সঃ করবো করবো! অবশ্যই করবো। আর সেটা সম্ভব না হলে তোমাকেই এপারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবো 😉





সোমবার, আগস্ট ২৯, ২০১৬

টোকা'র শব্দ



নীরবতার দরজায় হালকা টোকা দিয়ে যাচ্ছিল কেউ।
আমার প্রয়োজন অখণ্ড নীরবতা, সেখানে এই হালকা টোকার শব্দও আমার কাছে আল্ট্রাসনিক জেটের ইঞ্জিনের শব্দ মনে হচ্ছিল।

অখণ্ড নীরবতা প্রয়োজন আমার, চিৎকার করে তাড়িয়ে দিতে গেলে আমারই গড়া নীরবতার শীর্ণ কাঁচের দেয়াল ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়বে আমার চারিপাশ। তাই অপেক্ষা শুরু করলাম, ক্লান্ত আর বিরক্ত হয়ে টোকার শব্দ সৃষ্টিকারী যদি আপন ইচ্ছেতেই দূর হয় -সেই আশায়। কিন্তু দীর্ঘ সময় পরেও তেমন কিছুই ঘটল না। মৃদু টোকার শব্দ বিরতিহীন ভাবে বেজেই চলছিল। ওদিকে আমার অপেক্ষার কাল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতরই হচ্ছিল কেবল।

তারপর একটা সময় আপনা-আপনিই টোকার শব্দ থেমে গেল। আনন্দ যেন ঠিক সে মুহূর্তেই আমাকে ঘিরে ধরল। অবশেষে ফিরে পেলাম আমি আমার অখণ্ড নীরবতা! কিন্তু ঐ আনন্দের আবেশ খুব বেশি সময় টিকে থাকল না। যদিও আমি এই অখণ্ড নীরবতা পাবার আশায় এতটা সময় বিরক্তি নিয়ে অপেক্ষা করে গেছি। তবুও এখন এই অখণ্ড নীরবতাকে আমি আর নিতে পারছি না।

দরজার ওপাশের শব্দ বন্ধ হলেও মনের গহীনে কোথাও মৃদু টোকার শব্দ বিরতিহীন ভাবে বেজে চলেছে। যে বাইরে ছিল, সে যেন আপন প্রস্থানেই তার অস্তিত্ব ফেলে গেছে আমার মনের গহীনে। এখন এই অখণ্ড নীরবতার কোন অর্থ নেই। বেজে যাওয়া টোকার শব্দেই ডুবে আছে মন....




সোমবার, জুলাই ২৫, ২০১৬

বদি এণ্ড রঞ্জুর কথোপকথন — ৬



বদি ভাইঃ রঞ্জু, তুই মুভি দেখিস?

রঞ্জুঃ দেখি তো বদি ভাই!

বদি ভাইঃ কি কি মুভি দেখিস?

রঞ্জুঃ বাংলা, ইংলিশ কিছু কিছু হিন্দি, কোরিয়ান, জাপানি, থাই সহ প্রায় সব ধরণের মুভিই দেখি। কেন বদি ভাই?

বদি ভাইঃ এই যে এত মুভি দেখেছিস ঐগুলির মাঝে কোন ভাম্পায়ারের মুভি ছিল না?

রঞ্জুঃ হ্যাঁ, ছিল তো। এই তো কিছুদিন আগে ডিজনি'র রিলিজ করা হোটেল ট্রানসিলভেনিয়া-২ দেখলাম। অসাম মুভি একটা।

বদি ভাইঃ হুম, অসাম মুভি। বুঝলাম।

রঞ্জুঃ কেন বদি ভাই! কোন সমস্যা?

বদি ভাইঃ না কোন সমস্যা না। আচ্ছা ঐ যে ভাম্পায়ার ছিল, ওরা কি খেয়ে বেঁচে থাকে বল তো দেখি।

রঞ্জুঃ ইয়ে! মানে... মুভিতে তো দেখায় ভাম্পায়ারেরা মানুষের রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে।

বদি ভাইঃ হুম, ভাম্পায়ার চরিত্রটার চরিত্রায়ন করা হয়েছে এমন ভাবে যেখানে দেখানো হয় ঐগুলি মানুষের রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে। আগে তো ভাম্পায়ার শুধু ভৌতিক সাসপেন্স আর ভায়োলেন্স যুক্ত মুভিতেই ভাম্পায়ারের চরিত্র থাকত। তবে এখন ভাম্পায়ারের চরিত্রের প্রসার ঘটেছে অনেক। রোমান্টিক, কমেডি, যুদ্ধ, কভার্টস্ট্রাইক টাইপের মুভিতেও চলে এসেছে ভাম্পায়ার। আর সাথে ডিজনি তো রয়েছেই তাদের চমৎকার সৃষ্টিশীল কাজ নিয়ে।

রঞ্জুঃ বুঝলাম। কিন্তু আজ আপনি হুট করে ভাম্পায়ার নিয়ে এত কিছু কেন বলছেন ঐটাই শুধু বুঝতে পারি নাই।

বদি ভাইঃ হা হা হা! বুঝিস নাই!
আসলে ভাবিতেছিলাম রঞ্জু, এই যে ভাম্পায়ার গুলিরে ওরা বানাইল। তারপর এত শত ব্যবহার করল। কিন্তু তারপরেও ভাম্পায়ারের খাবারের কিন্তু কোন পরিবর্তন করতে পারলো না। সেই আগের মতই সব ভাম্পায়ার মানুষের রক্তই খাইয়্যা বাইচ্চা থাকে। চিন্তা করে দেখো তো দুনিয়াতে এত এত খাবার থাকতে ভাম্পায়ার গুলিরে নাকি হুদা মানুষের রক্ত খাইয়্যা বাইচ্চা থাকতে হয়!

রঞ্জুঃ হুম, সেইটা তো আসলেই ভাববার মত বিষয়।

বদি ভাইঃ আচ্ছা বলতো রঞ্জু, ভাম্পায়ার গুলির চরিত্র এমন করে কেন তৈরি করেছে, যে সে না চাইলেও বাধ্য তাকে হয়ে মানুষের রক্ত খেতেই হয়?

রঞ্জুঃ কেন বদি ভাই?!

বদি ভাইঃ তোর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি যারপরনাই হতাশ রঞ্জু! তুই এখনো ওয়াইড মাইন্ডে কিছু বোঝার চেষ্টা করিস না! এমন করে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে যে তোর কি হবে তাই নিয়ে আমি বড়ই শঙ্কায় থাকি মাঝে মাঝে।

রঞ্জুঃ আহ্‌ বদি ভাই! আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে পরে শঙ্কা করলেও চলবে, আগে আপনে বলেন কেন ভাম্পায়ার গুলিকে অনিচ্ছাতেও রক্ত খেতে হয়।

বদি ভাইঃ আচ্ছা শোন মন দিয়ে।
ভাম্পায়ারের মুভিতে তো দেখেছিস, ওরা হাজার হাজার বছর কফিনে বসবাস করে। দিনের বেলাতে ঘুম আর সন্ধ্যার পর জেগে উঠে। তারপর যায় মানুষের রক্তের সন্ধানে।

রঞ্জুঃ হুম দেখেছি।

বদি ভাইঃ আবার এইটাও নিশ্চই দেখেছিস যে ওরা সূর্যের আলো সহ্য করতে পারে না। সূর্যের আলো গায়ে পড়লে হয় ধোঁয়া হয়ে উড়ে যায় কিংবা বালির মত ঝড়ে যায়।

রঞ্জুঃ হ্যাঁ, এটাও দেখেছি। ওদের জন্যে সূর্যের আলো হচ্ছে মৃত্যু স্পর্শের সমতুল্য।

বদি ভাইঃ তাহলে এই থেকে কি প্রমাণ হয়?

রঞ্জুঃ কি প্রমাণ হয় বদি ভাই!!

বদি ভাইঃ আরে গাধা এই থেকে প্রমাণ হয় যে জন্মের পর ওরা আমাদের মত সূর্যের আলো গায়ে মেখে ভিটামিন 'ডি' নিতে পারে না। আর ভিটামিন 'ডি' না থাকলে শরীরের হাড়গোড় শক্ত হয় না। আর হাড়গোড় শক্ত না হলে হাজার হাজার বছর ক্যামনে বেঁচে থাকবে বল?
তাই ওরা শুধুমাত্র ভিটামিন 'ডি' পাওয়ার জন্যে অনিচ্ছাতেও মানুষের রক্ত খেয়ে বেড়ায়! বুঝলি রে আহাম্মক!

রঞ্জুঃ হা হা হা হা!
একেবারে টু দ্যা পয়েন্টে বুঝতে পেরেছি!






রবিবার, জুলাই ২৪, ২০১৬

কমিকঃ নক্ষত্রজ্ঞানী




কমিকটি পিডিএফ হিসেবে ডাওনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন







────────────────────────────
♦ কমিক : নক্ষত্রজ্ঞানী | Stargazer
♦ সংগ্রহ : Stumbleupon.com Stream
♦ জঘন্য অনুবাদে : আমি :p

বুধবার, জুলাই ২০, ২০১৬

অনুবাদ গল্পঃ আত্মমূল্যায়ন



একবার এক যুবক এক জ্ঞানী সন্ন্যাসীর সাথে দেখা করতে গেল। সন্ন্যাসীর সাক্ষাত পেয়ে তাকে বলল-
'আমি আপনার পরামর্শের জন্যে এসেছি। এখন পর্যন্ত আমার অযোগ্যতার জন্যে আমি কোন কিছুই করতে পারি নি। পরিচিত, স্বল্প-পরিচিত আর স্বজনেরা আমার ব্যর্থতার জন্যে আমাকে ভৎর্সনা করে আর আমার বোকামির জন্যে আমাকে ঠাট্টার পাত্র বানিয়ে রেখেছে। আমার এই ব্যর্থ জীবনের নিয়ে আমি বড় কষ্টে রয়েছি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এ জীবনের মায়া ত্যাগ করতে। আপনি দয়া করে আমাকে একটু সাহায্য করুন। আমার ব্যর্থতাকে উৎরে যাবার উপায় বলে দিন।"

জ্ঞানী সন্ন্যাসী যুবকটিকে একটু ভালো করে দেখলেন, তারপর দ্রুত বললেন-
"আমাকে ক্ষমা কর, এই মুহূর্তে আমি এত ব্যস্ত সময় পার করছি যে তোমাকে কোনরূপ সহায়তা করার সুযোগ আমার নেই। আমাকে খুব জরুরী ভিত্তিতে কিছু কাজ করতে হবে..." এতটুকু বলে তিনি একটু থামলেন। তারপর এক মুহূর্ত চিন্তা করে আবার বললেন, "কিন্তু তুমি যদি আমাকে আমার কাজে একটু সহায়তা করতে রাজী থাকো তবে আমি খুব দ্রুতই তোমার সমস্যায় তোমাকে সাহায্য করতে পারব।"

"অবশ্যই...অবশ্যই আমি আপনার কাজে সহায়তা করতে পারব" দ্রুতই উত্তর দিল যুবকটি।

যুবকের কথা শুনে জ্ঞানী সন্ন্যাসী বললেন, 'ভালো'। তারপর তার আঙ্গুলে থাকা একটি পাথর খচিত আংটি খুলে নিয়ে যুবকের হাতে দিলেন। তারপর বললেন, "আমার কিছু ঋণ রয়েছে কারও কাছে, তাই আংটিটি বিক্রি করা খুবই জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুমি আমার ঘোড়াটি নিয়ে দ্রুত বাজারে যাও, আর আমার হয়ে আংটিটি বিক্রি করে আসো। তবে অবশ্যই তোমাকে আংটিটি একটু ভালো মূল্যে বিক্রি করার চেষ্টা করতে হবে। কোন অবস্থাতেই একটি স্বর্ণমুদ্রার কমে আংটিটি বিক্রি করো না, আর বিক্রি করে খুব দ্রুতই আমার কাছে ফিরে এসো।"

যুবকটি আংটিটি নিয়ে দৌড়ে ঘোড়ায় চড়ল এবং খুব দ্রুত স্থানীয় বাজারে গিয়ে পৌঁছল। সেখানে তখন অনেক বনিক ক্রেতাই দ্রব্যাদি ক্রয় বিক্রয়ে ব্যস্ত ছিল। যুবক আংটিটি নিয়ে ঐ বনিকদের নিকট গেল এবং তাদের সেটা দেখিয়ে বিক্রি করার চেষ্টা চালাতে লাগল। সকল বনিকই প্রথমে খুব আগ্রহ  নিয়ে আংটিটি দেখছিল, কেউ কেউ ক্রয় করার ইচ্ছেও প্রকাশ করছিল। কিন্তু যখনই যুবক তাদের বলল অন্তত একটি স্বর্ণমুদ্রা না হলে সে আংটিটি বিক্রি করবে না, তখনই তাদের সব আগ্রহ উবে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত এক বুড়ো বনিক যুবকটিকে ডেকে বুঝিয়ে বলল যে, এটি অত্যন্ত নিম্নমানের ধাতুর তৈরি আংটি আর আংটিতে থাকা পাথরটিও অনেক পুরানো। কোন বনিকই আংটিটি স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে ক্রয় করতে রাজী হবে না। আর এই আংটির জন্যে একটি স্বর্ণমুদ্রা অনেক অনেক বেশি। তবে বৃদ্ধ বনিক বলল, যুবক যদি রাজী থাকে তবে তিনি কিছু তাম্র-মুদ্রা কিংবা অল্প কিছু রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে আংটিটি ক্রয় করতে ইচ্ছুক।

বৃদ্ধ বনিকের এমন কথা শুনে যুবক আবারও হতাশ হয়ে পড়ল। যেহেতু জ্ঞানী সন্ন্যাসী তাকে এক স্বর্ণমুদ্রার কমে আংটিটি বিক্রয় করতে মানা করেছে তাই সে ভদ্রভাবে বৃদ্ধ বনিককে ব্যাপারটি জানিয়ে বিক্রি করতে পারবে না বলে জানাল। ইতোমধ্যে বাজারের প্রায় সকল বনিকের কাছে আংটিটি দেখানো সম্পন্ন হয়ে গেছে। বৃদ্ধ বনিক ব্যতীত আর কেউই আংটিটি ক্রয় করতে চায় নি। স্বর্ণমুদ্রা ব্যতীত আংটি বিক্রি করতে ব্যর্থ হয়ে যুবক আবারও নিজের ভাগ্যকে মনে মনে গালমন্দ করতে লাগল। ঘোড়া চড়ে ফিরে চলল জ্ঞানী সন্ন্যাসীর কাছে।

"জনাব, আমি আপনার কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছি", জ্ঞানী সন্ন্যাসীর কাছে ফিরে এসে যুবকটি বলল। আরও বলল, 'বাজারে যারাই আংটিটি ক্রয় করতে চেয়েছিল তাদের সকলেই কিছু তাম্র কিংবা রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে তা ক্রয় করতে চেয়েছে, কিন্তু আপনি আমাকে অন্তত এক স্বর্ণমুদ্রার কমে তা বিক্রি করতে মানা করায় আমি আংটিটি বিক্রি করতে পারিনি। শেষে এক বনিক আমাকে বললেন স্বর্ণমুদ্রার তুলনায় আংটিটি প্রায় মূল্যহীন, তাই কেউ কিনতে রাজী হবে না। এ কারণেই আমি ব্যর্থ হয়ে আপনার কাছে ফিরে এসেছি।'

সব কথা শুনে জ্ঞানী সন্ন্যাসী বলল,
'তুমি যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে এসেছ, তা কি তুমি জানো?
আংটিটি বিক্রি করার আগে তার প্রকৃত মূল্য সম্বন্ধে জানা খুব জরুরী, আর তা যদি তোমার জানা না থাকে তবে তুমি কখনোই সঠিক মূল্যে আংটিটি বিক্রি করতে পারবে না। আর এমন একটি আংটির মূল্য নিশ্চই তুমি শুধুমাত্র বাজারের বনিকের কথায় নির্ধারণ করবে না!
এক কাজ কর, তুমি বরং আংটিটি একজন জহুরির কাছে নিয়ে যাও। তার কাছ থেকে এর প্রকৃত দাম জেনে আসো। তবে এইবারে তুমি তার কাছে আংটিটি এবারে বিক্রি করো না, শুধু আংটিটির প্রকৃত দাম জেনেই আমার কাছে ফিরে আসবে।"

জ্ঞানী সন্ন্যাসীর কথা শুনে যুবক আবারও দ্রুততার সাথে ঘোড়া ছুটাল জহুরির সন্ধানে। পরে এক জহুরির কাছে গিয়ে আংটিটি পরীক্ষা করতে দিল। জহুরি অনেক লম্বা সময় ধরে আতশি কাঁচের নিচে রেখে আংটিটি নিরীক্ষণ করলেন। তারপর খুব সাবধানে আংটিটি একটি তুলাদণ্ডে রেখে ওজন পরিমাপ করলেন। সবশেষে যুবকের নিকট আংটিটি ফেরত দিয়ে বললেনঃ

"তুমি আংটির মালিককে গিয়ে বল তিনি যদি এখনই জরুরী ভিত্তিতে আংটিটি বিক্রি করতে চান তবে আমি তাকে এখন সর্বাধিক ৫৮টি স্বর্ণমুদ্রা দিতে পারব। কিন্তু তিনি যদি আমাকে কিছু সময় দিতে রাজী হন, তবে আমার বিশ্বাস এই আংটিটি আমি অন্তত ৯০ টি স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে বিক্রি করে দিতে পারব।"

"৯০ স্বর্ণমুদ্রা!" , বিস্ময় নিয়ে যুবকটি চিৎকার দিল!
তারপর আনন্দে হেসে জহুরিকে ধন্যবাদ দিয়ে সেখান থেকে বের হল এবং দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে জ্ঞানী সন্ন্যাসীর কাছে ছুটল।

যুবক যখন ফিরে এসে জ্ঞানী সন্ন্যাসীকে জহুরির বলা কথাগুলো জানাল তখন সন্ন্যাসী তাকে বলল,
"ছেলে, মনে রেখো, তুমিও এই আংটিটির মত বহু-মূল্যবান এবং অনন্য একজন! বাজারের বোকা বনিকদের মত তুমিও যদি তোমার পরিচিত, অপরিচিত আর আত্মীয়দের কথায় নিজেকে মূল্যায়ন কর আর এভাবে ভেঙ্গে যাও তবে কখনোই নিজের প্রকৃত মূল্য আবিষ্কার করতে পারবে না। তারচেয়ে বড় তোমার মেধা, তোমার বুদ্ধি আর তোমার যোগ্যতাকে আরও নিবিষ্ট ভাবে কাজে লাগাও। আর তা যদি করতে পারো তবে জহুরির মত বিজ্ঞ লোকই তোমার মূল্য বুঝতে পারবে। তাদের কাছেই তোমার নিজের প্রকৃত মূল্যায়ন তুমি বুঝে পাবে।"





বদি এণ্ড রঞ্জুর কথোপকথন — ৫



বদি ভাইঃ বলত রঞ্জু, একজন ভালো লেখক সেটা কিভাবে যাচাই করা যায়?

রঞ্জুঃ কিভাবে বদি ভাই?

বদি ভাইঃ কিভাবে সেইটাই তো আমি তোমাকে জিজ্ঞাস করলাম।

রঞ্জুঃ উম্‌ম, সবাই যখন তার লেখা পড়বে তখন তাকে ভালো লেখক বলা যায়।

বদি ভাইঃ তা তো অবশ্যই যায়।
কিন্তু চিন্তা কর এমন তো অনেক লেখকই রয়েছে যাদের লেখা প্রায় সকলেই পড়ে। তাহলে এই ভালো লেখকদের মাঝেও আরও ভালো লেখক কে, তা কিভাবে বুঝবা?

রঞ্জুঃ ভালো লেখকদের মাঝেও আরও ভালো লেখক থাকে নাকি? ভালো লেখক মানেই তো যে ভালো লিখে। আর সেই কারণেই তো সে ভাল লেখক।

বদি ভাইঃ উহু, এই ভালো লেখকদের মাঝেও আরও ভালো লেখক থাকে রঞ্জু।

রঞ্জুঃ কিভাবে? বুঝিয়ে বলেন না একটু।

বদি ভাইঃ এই হল তোমার সমস্যা। নিজে নিজে ভালো ভাবে কিছুই চিন্তা করবা না, শুরুতেই হাল ছেড়ে দিবা। তোমারে নিয়ে আমি বড়ই হতাশ রঞ্জু।

রঞ্জুঃ আহ! বলেন না। কিভাবে আরও ভালো লেখক যাচাই করে বের করব?

বদি ভাইঃ আচ্ছা শোন।
লেখক কোন লেখা লিখলে অবশ্যই কোন না কোন পাঠক তা পড়বে। আর পাঠকের সংখ্যা যত বাড়বে লেখকের মূল্যায়ন তত বাড়বে, আর মূল্য বাড়ে তার লেখার। কিন্তু সবার লেখার কিন্তু একই মূল্যায়ন সকল পাঠকের কাছে থাকে না। পাঠকের স্বাদের ভিন্নতার কারণে লেখার মূল্যেরও পরিবর্তন হয়।

একটা লেখা যখন কিছু মানুষের কাছে খুব ভালো লাগবে, তখন ঐ একই লেখা অন্য কিছু লোকের কাছে খুবই বাজে মনে হবে। আর যাদের কাছে ঐ লেখাটা বাজে মনে হল তারা কিন্তু লেখকেও বাজে লেখক হিসেবেই ধরে নেবে।

আর সাধারণত কোন লেখকের লেখা খারাপ হলে পাঠক ঐ লেখকের আর কোন লেখা পড়তে যায় না।

রঞ্জুঃ এটাই তো স্বাভাবিক।

বদি ভাইঃ হ্যাঁ, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি এমন হয় যে কেউ একজন লেখক আছে, যার লেখা তোমার মোটেই ভালো লাগে না। কিন্তু তোমার পরিচিত কিংবা অপরিচিত কেউ কেউ ঐ লেখকের লেখায় অনেক মজা পেল। আর তুমিও সেটা জানতে পারলে। তখন তুমি কি করবে?

রঞ্জুঃ কি আর করব? যদি খুব ভালো প্রশংসা শুনি তবে অবশ্যই তার অন্য কোন লেখা পড়ব।

বদি ভাইঃ আচ্ছা। তার অন্য কোন লেখা তুমি পড়লা। কিন্তু লেখা পড়ার পর তোমার কাছে মনে হল এটাও সেই আগের মতই বাজে লেখা, তখন কি করবে?

রঞ্জুঃ তার লেখা পড়া পুরোপুরিই বাদ দিবো।

বদি ভাইঃ হ্যাঁ, এতক্ষণে তুমি লাইনে আসছো রঞ্জু।
কোন একজন লেখকের লেখা তোমার যতই খারাপ লাগুক, তারপরও যখন তার লেখা কত খারাপ এইটা জানার জন্যে তুমি তার অন্য লেখা প্রায় নিয়মিত পড় তাহলে বুঝতে হবে লেখকটি শুধু ভালোই নয়, সমসাময়িক অন্য লেখকদের তুলনায় অনেক বেশি ভালো লিখে।

তেমনি একজন লেখক যত বাজেই হোক না কেন, তার কাজে তুমি যতই বিরক্ত হও না কেন। তাকে ছাপিয়েও যখন তার লেখা তোমার ভালো লাগবে তখনও বুঝবে তুমি একজন চমৎকার লেখকের লেখা পড়ছ।

রঞ্জুঃ আচ্ছা! তাই বলেন।
কিন্তু বদি ভাই, এমন তো অনেক লেখকই রয়েছে যাদের একটা লেখা খারাপ হলেও অন্য লেখাগুলি পরবর্তীতে ভালো লেগেছে।

বদি ভাইঃ হ্যাঁ, এমন লেখকও রয়েছে। তবে তুমি ভালো করে চিন্তা করে দেখো, তাদের মাঝেও কেউ একজন রয়েছে, যাকে নিয়ে মানুষ অনেক খারাপ মনোভাব প্রকাশ করে। কিন্তু হাজার খারাপ হলেও তার লেখা ঠিকই মনোযোগ দিয়েই পড়ে।

রঞ্জুঃ হ্যাঁ, এমন লেখকও রয়েছে।

বদি ভাইঃ তাহলে এখন বুঝছো তো একজন ভালো লেখক কিভাবে যাচাই করা যায়?

রঞ্জুঃ হুম, এবার বুঝতে পেরেছি।