রবিবার, আগস্ট ৩১, ২০২৫

Debian 13 Trixie ইন্সটলের পর করণীয়: Cinnamon ডেস্কটপের জন্য ধাপে ধাপে সম্পূর্ণ গাইড

 


Debian, রক-সলিড ডিস্ট্রিবিউশন হিসেবে যার খ্যাতি বিশ্বজোড়া, সম্প্রতি মুক্তি দিয়েছে তাদের নতুন সংস্করণ Debian 13 “Trixie”। এই রিলিজে যুক্ত হয়েছে নতুন হার্ডওয়্যার সাপোর্ট, প্রায় ৭০ হাজার নতুন ও আপডেটেড প্যাকেজ, নিরাপত্তায় আরও উন্নয়ন, এবং প্রথমবারের মতো 64-bit RISC-V আর্কিটেকচার সাপোর্ট। পাশাপাশি ডেক্সটপ এনভায়রনমেন্টগুলোর নতুন সংস্করণ— GNOME 48, KDE Plasma 6.3, LXDE 13, LXQt 2.1.0 এবং Xfce 4.20—ব্যবহারকারীদের জন্য আরও সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে।

সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো non-free-firmware রিপোজিটরি এখন ডিফল্টভাবে সক্রিয় থাকে, ফলে Wi-Fi, Bluetooth ও গ্রাফিক্স কার্ডের জন্য প্রয়োজনীয় ড্রাইভার ইন্সটল আরও সহজ হয়েছে।

এইবার আমি আমার ডেক্সটপ এনভায়রনমেন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছি Cinnamon। এর সহজবোধ্য ইন্টারফেস, আধুনিক ফিচার, হালকা রিসোর্স ব্যবহার এবং কাস্টমাইজেশনের স্বাধীনতা এটিকে সত্যিই ব্যবহারযোগ্য করে তুলেছে। যারা দীর্ঘদিন ধরে Windows ব্যবহার করেছেন, তাদের জন্য Cinnamon হতে পারে একদম পরিচিত-স্বাচ্ছন্দ্যময় ডেস্কটপ পরিবেশ।

এই পোস্টে আমি দেখাবো Debian 13 Cinnamon ইন্সটলের পর করণীয় ধাপে ধাপে কাজগুলো, যা করলে সিস্টেম হবে আরও সম্পূর্ণ, কার্যকরী ও দৈনন্দিন ব্যবহারের উপযোগী।

Debian 13 Trixie কে Cinnamon ডেক্সটপ সহ ইন্সটলের পর ডেক্সটপ এর Menu হতে Terminal টি চালু করে নিন। এরপর নিচের ধাপে থাকা কমান্ড গুলো ব্যবহার করুন।


◈ সিস্টেম আপডেট করা

ইন্সটলেশনের পর প্রথমেই সিস্টেম আপডেট করা জরুরি, যাতে সর্বশেষ নিরাপত্তা আপডেট ও সফটওয়্যার পাওয়া যায়।

sudo apt update && sudo apt install -y netselect-apt && sudo netselect-apt && sudo apt full-upgrade -y
sudo apt autoremove --purge -y

এই কমান্ড দুটো সিস্টেমকে আপডেট করবে এবং অপ্রয়োজনীয় প্যাকেজ মুছে ফেলবে।


◈ Non-Free Firmware সক্রিয় করা

নতুন Debian রিলিজে non-free-firmware রিপোজিটরি সহজে সক্রিয় করা যায়, যা বিভিন্ন প্রাইভেট হার্ডওয়্যার ড্রাইভারের জন্য জরুরি।

sudo sed -i 's/main$/main contrib non-free-firmware/' /etc/apt/sources.list
sudo sed -i 's/main contrib$/main contrib non-free-firmware/' /etc/apt/sources.list
sudo apt update


◈ Firmware ইন্সটল করা

এটি Intel/AMD এর মাইক্রোকোডসহ প্রয়োজনীয় ফার্মওয়্যার ইন্সটল করবে, যা সিস্টেমের স্থায়িত্ব ও হার্ডওয়্যার কম্প্যাটিবিলিটি বাড়াবে।

sudo apt install -y firmware-linux firmware-linux-nonfree firmware-misc-nonfree dkms linux-headers-$(uname -r) intel-microcode amd64-microcode mesa-utils


◈ প্রয়োজনীয় টুলস ও সফটওয়্যার ইন্সটল করা

এই ধাপে সিস্টেমের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু টুল ও সফটওয়্যার ইন্সটল করা হবে।

sudo apt install -y curl wget git build-essential gnome-software synaptic gdebi gparted gnome-disk-utility libfuse2


◈ অফিস, মাল্টিমিডিয়া ও গ্রাফিক্স অ্যাপ সহ আরও কিছু প্রয়োজনীয় এ্যাপ ইন্সটল করা

sudo apt install -y libreoffice libreoffice-impress libreoffice-writer libreoffice-calc celluloid rhythmbox gimp gimp-data gimp-data-extras inkscape bleachbit gedit gedit-plugins gedit-plugins-common nala p7zip p7zip-full unzip


◈ মাল্টিমিডিয়া কোডেক ও প্লেয়ার ইন্সটল করা

Deb-Multimedia রিপো যোগ করে VLC, FFmpeg, Audacious, HandBrake ও kodi ইন্সটল করা হয়, যাতে সব ধরনের অডিও-ভিডিও ফরম্যাট চালানো যায়।

sudo wget -qO /tmp/dmo-keyring.deb https://www.deb-multimedia.org/pool/main/d/deb-multimedia-keyring/deb-multimedia-keyring_2024.9.1_all.deb && sudo dpkg -i /tmp/dmo-keyring.deb && echo "Types: deb\nURIs: https://www.deb-multimedia.org\nSuites: trixie\nComponents: main non-free\nSigned-By: /usr/share/keyrings/deb-multimedia-keyring.pgp\nEnabled: yes" | sudo tee /etc/apt/sources.list.d/dmo.sources >/dev/null

sudo apt update && sudo apt install -y vlc ffmpeg libavcodec-extra libdvdcss2 gstreamer1.0-plugins-bad gstreamer1.0-plugins-ugly audacious audacious-plugins handbrake-gtk kodi


◈ LocalSend (ক্রস-প্লাটফর্ম ফাইল শেয়ার অ্যাপ) ইন্সটল করা

wget -O localsend.deb https://github.com/localsend/localsend/releases/download/v1.17.0/LocalSend-1.17.0-linux-x86-64.deb;dpkg -i localsend.deb
rm -rf localsend*.deb


◈ লগইন স্ক্রিন কাস্টমাইজ/টুইক করা

sudo grep -q '^greeter-hide-users=' /usr/share/lightdm/lightdm.conf.d/01_debian.conf && sudo sed -i 's/^greeter-hide-users=.*/greeter-hide-users=false/' /usr/share/lightdm/lightdm.conf.d/01_debian.conf || echo "greeter-hide-users=false" | sudo tee -a /usr/share/lightdm/lightdm.conf.d/01_debian.conf


◈ Cinnamon এর জন্য থিম ইন্সটল

wget http://packages.linuxmint.com/pool/main/m/mint-themes/mint-themes_1.8.3_all.deb
wget http://packages.linuxmint.com/pool/main/m/mint-x-icons/mint-x-icons_1.5.3_all.deb
sudo apt install -y mint-y-icons
sudo dpkg -i *.deb
rm -rf mint-*.deb


◈ তারিখ ও সময় সেটিংস পরিবর্তন করা

নেটওয়ার্ক থেকে বাংলাদেশের জন্যে সময় ও তারিখ ঠিক করা ও ১২-ঘন্টার ঘড়িকে ডিফল্ট করা

timedatectl set-timezone Asia/Dhaka
timedatectl set-ntp true
gsettings set org.cinnamon.desktop.interface clock-show-date true
gsettings set org.cinnamon.desktop.interface clock-use-24h false


◈ বাংলা ফন্ট সাপোর্ট

এই ধাপে প্রয়োজনীয় বাংলা ফন্ট গুলো ইন্সটল করা হবে, আর বাংলা লেখাকে সুন্দর দেখানোর জন্য সিস্টেমে বাংলা ফন্ট সেট করা হবে

sudo apt install -y fonts-noto fonts-noto-color-emoji fonts-noto-extra fonts-noto-unhinted
sudo cd /tmp;wget --no-check-certificate https://github.com/r-not/unibnfonts/archive/master.tar.gz -O ubf.tar.gz;sudo tar -xvf ubf.tar.gz -C /usr/share/fonts/;rm ubf.tar.gz
cd /tmp;wget --no-check-certificate https://raw.githubusercontent.com/r-not/MyLinuxConfFiles/refs/heads/master/Common-Configs/bn-font-set.sh -O bn-font
set.sh;sh ./bn-font-set.sh


◈ ব্রাউজার ইন্সটলেশন

Debian এর সাথে ডিফল্ট ভাবে Firefix-ESR সংস্করণ দেয়া থাকে। আমরা এখানে এই সংস্করণটি বাদ দিয়ে ফায়ারফক্সের রেগুলার সংস্করণ ইন্সটল করব। একই সাথে Cromium ব্রাউজার ও Brave ব্রাউজারটি ইন্সটল করব।

sudo apt remove --purge -y firefox-esr*
sudo install -d -m 0755 /etc/apt/keyrings
wget -q https://packages.mozilla.org/apt/repo-signing-key.gpg -O- | sudo tee /etc/apt/keyrings/packages.mozilla.org.asc > /dev/null
gpg -n -q --import --import-options import-show /etc/apt/keyrings/packages.mozilla.org.asc | awk '/pub/{getline; gsub(/^ +| +$/,""); if($0 == "35BAA0B33E9EB396F59CA838C0BA5CE6DC6315A3") print "\nThe key fingerprint matches ("$0").\n"; else print "\nVerification failed: the fingerprint ("$0") does not match the expected one.\n"}'
FILE="/etc/apt/sources.list.d/mozilla.list"
LINE='deb [signed-by=/etc/apt/keyrings/packages.mozilla.org.asc] https://packages.mozilla.org/apt mozilla main'
sudo touch "$FILE"
grep -qxF "$LINE" "$FILE" || echo "$LINE" | sudo tee -a "$FILE" > /dev/null
echo '
Package: *
Pin: origin packages.mozilla.org
Pin-Priority: 1000
' | sudo tee /etc/apt/preferences.d/mozilla
sudo apt update && sudo apt install -y firefox firefox-l10n-bn chromium
curl -fsS https://dl.brave.com/install.sh | sh


◈ পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট টুল ইন্সটল করা

ল্যাপটপে যারা ব্যাটারি পার্ফোমেন্স নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন তারা এই কমান্ড দুটো ব্যবহার করে দেখতে পারেন। এই ধাপে বহুল পরিচিত পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট টুল tlp ইন্সটল করে তা সক্রিয় করে দেয়া হবে।

sudo apt install -y tlp tlp-rdw
sudo systemctl enable tlp


◈ সিস্টেম ব্যাকআপ/রেসকিউ টুল (Timeshift) ইন্সটল করা

এই ব্যাকআপ টুলটি দারুণ কার্যকর। যারা ইতোমধ্যে ব্যবহার করেছে তারা এর কার্যক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা রাখে। সহজ করে বললে, এটি দিয়ে একটি ব্যাকআপ রাখা থাকলে আপার সিস্টেম ক্রাশ করা অবস্থা থেকে পুনরায় ফাংশনাল অবস্থায় ফেরত যেতে পারবেন নিমিষেই।

sudo apt install -y timeshift


◈ Flatpak সাপোর্ট চালু করা

নিচের কমান্ড দুটো ব্যবহার করে লিনাক্স জগতের জনপ্রিয় প্যাকেজ ফরম্যাট Flatpak এর সাপোর্ট সক্রিয় করা হবে। সাথে ইন্সটল হবে ফ্লাটপ্যাক এ্যাপ খোজার জন্যে এ্যাপস্টোর

sudo apt install -y flatpak gnome-software-plugin-flatpak
flatpak remote-add --if-not-exists flathub https://flathub.org/repo/flathub.flatpakrepo‌


◈ ফায়ারওয়াল

সবশেষে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে জোড়দার করতে ইন্সটল ও সক্রিয় করে নিন Firewall প্রোগ্রাম

apt install -y ufw gufw
sudo ufw status | grep -q "Status: active" || { sudo ufw --force enable && sudo systemctl enable --now ufw; }

 

 

এবার সিস্টেমটিকে একবার রিস্টার্ট করুন সকল পরিবর্তন গুলো সক্রিয় করার জন্য। তারপর আপনার পছন্দসই একটি থিম বেছে নিন Menu > Themes হতে।


◈ চলুন সহজে করি!!

যারা এত লম্বা ধাপ গুলো দেখে বিরক্ত হচ্ছেন, অথবা ঝামেলা মনে হচ্ছে তাদের জন্যে কাজটি সহজ করার জন্যে একটি স্ক্রিপ্ট লেখা হয়েছে। আপনি চাইলে এই সম্পূর্ণ কাজটি শুধুমাত্র নিচের কমান্ডটি ব্যবহার করে করতে পারেন।

wget https://shorturl.at/gZxeE -O deb13PIS.sh;sh ./deb13PIS.sh


Debian 13 Cinnamon Post Install Guide with Essential Tweaks
 

আপাতত এখানেই শেষ করছি। লেখায় অথবা কমান্ড গুলোতে ভুল থাকা স্বাভাবিক। আমার নজরে পড়লে সংশোধন করে দেয়ার চেষ্টা করব। পাশাপাশি কমান্ডগুলো ব্যবহার করতে গিয়ে আপনার কোথায় সমস্যা হয়েছে তা জানালে তা সমাধান করা অথবা প্রয়োজনীয় পরিবর্তন গুলো করে নেয়া সহজ হবে। এই পুরো ব্যাপারটি সাজানো হয়েছে একজন (আমার নিজের) ব্যবহারকারীর প্রয়োজন ও পছন্দের উপর ভিত্তি করে। কিছু অংশ অথবা হয়ত পুরো প্রকৃয়াটিই হয়ত আপনার জন্য অপ্রাসঙ্গিক। তাই অনুরোধ থাকবে নিজের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে প্রয়োজনীয় অংশটি ব্যবহার করে দেখবার জন্য।


লিনাক্সের গ্যালাক্সিতে ডেবিয়ানকে নিয়ে আপনার জার্নি হয়ে উঠুক আনন্দময়।


সোমবার, আগস্ট ২৫, ২০২৫

ডায়েরিঃ আগস্ট ২৫, ২০২৫ঈ ॥ ১০১ দিন

পৃথিবী তার নিজস্ব নিয়মে চলছে। সূর্য ওঠছে, আবার নিয়ম মেনে অস্ত যাচ্ছে; রাত নামছে, ফের ভোর আসছে; মানুষ আসছে-যাচ্ছে, বাঁচছে-মরছে; সবকিছু আগের মতোই চলছে। কিন্তু আমার কাছে পৃথিবীর রূপ আর আগের মতো নেই। পৃথিবীটাকে আমি আর আগের চোখে দেখতে পারি না। কারণ এই পৃথিবীতে জীবনধারণের ধরণ বদলে গেছে। সম্পর্কের ধরন পাল্টে গেছে, বিশ্বাসের ভিত্তি নড়ে গেছে, আর ভরসার জায়গাগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে।


আমি ভেবেছিলাম- কষ্ট গুলো ধীরে ধীরে মুছে যায়, সময়ের সাথে সাথে ক্ষতস্থান শুকিয়ে আসে। কিন্তু বাস্তবতা আমাকে অন্য শিক্ষা দিয়েছে। কষ্ট আসলে কখনোই মুছে যায় না, ম্লান হয়ে বিবর্ণও হয় না; বরং সময় তাকে আরও প্রকট ভাবে দৃশ্যমান করে তোলে। যত দিন যায়, কষ্ট তত গভীরভাবে হৃদয়ে গেঁথে বসে। ক্ষণিকের আঘাত সময়ের প্রবাহে গাঢ় ক্ষতচিহ্নে পরিণত হয়, আর সেই দাগ চিরস্থায়ী হয়ে যায়।


মানুষের প্রতি বিশ্বাস, ভরসা আর সম্মান- যা একসময় আমার কাছে অবিচল সত্য মনে হয়েছিল; এখন ক্রমেই ক্ষয়ে যাচ্ছে। জীবনের অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে, মানুষকে সহজভাবে বিশ্বাস করা ছিল মস্ত ভুলের একটি। আমি যাদের কাছে আদর্শ খুঁজি, যাদের চোখে সাধুতা দেখি, তাদের ভেতরে আসলে এমন কিছু নেই। সবাই প্রয়োজনের খাতিরে সাধু হয়, আর প্রয়োজন ফুরোলেই সাধু ভং ধরা মুখোশটা খুলে কুটিলতায় ভরা প্রকৃত মুখটি প্রকাশ পায়। মানুষের এই দ্বিমুখী চরিত্র এত কাছ থেকে না দেখলে হয়ত কখনো বিশ্বাস করতাম না।


এই অল্প কয়েকদিনে জীবনের আরেকটি কঠিন সত্যও উপলব্ধি করেছি। যে সকল মানুষের হৃদয়ের ভেতর কুটিলতা ভর করেছে, যার হৃদয় কালশিটে ময়লা পড়ে পচে গেছে, যার চিন্তাধারায় কুটিলতা আর অনিষ্ট ছাড়া ভিন্ন কিছু কাজ করে না; তার সাথে আপনি যতই ভালো ব্যবহার করেন না কেন, যতই ধৈর্য ধারে সহ্য করে সমস্যার সমাধান খুঁজতে চান না কেন, কোনো লাভ নেই। তাদের স্বভাব পাল্টায় না, পাল্টাবার নয়। এদের মোহর লাগানো হৃদয়ের কথাই ওপরওয়ালা আমাদের বলেছেন, বিধাতার হুকুম ছাড়া এই মোহর আর কখনোই পরিষ্কার হবে না। বরং এই কুটিলতায় পূর্ণ নরকের কীট গুলো খুঁজে খুঁজে আপনার দুর্বলতা খুঁজে বের করে আপনাকে আরও গভীর সমস্যায় ফেলে দেবে।


আমার শূন্য হয়ে পড়া পৃথিবীটার বয়স আজ ১০১ দিন। ঠিক ১০০ দিন পূর্বে আমার আম্মা এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে আপন শান্ত পরিবেশ খুঁজে নিয়েছেন। দিন হিসেবে ১০০ দিন খুব নগণ্য হলেও এই ১০০ দিনের পৃথিবী আমাকে এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে, যেখানে নেই মায়ের মমতা, নেই সেই নির্ভরতার ছায়া। আছে কেবল ভান করা মায়া, সমাজের সামনে যাত্রা-নাটক প্রদর্শন করার মতো ভদ্রতা, আর স্বার্থের ফাঁদে জড়িয়ে থাকা সম্পর্ক। এই ১০০ দিনেই ‘পরিচিত’ আর ‘কাছের’ নামধারী সম্পর্ক গুলো চোখের পলকেই গিরগিটির মত রঙ বদলে নিয়েছে।


আমি কখনো ভাবিনি আম্মা আমাদের এত দ্রুত ছেড়ে চলে যাবেন। আমি ভেবেছিলাম আম্মা অন্তত আরও বিশটি বছর আমাদের সঙ্গে থাকবেন। তাঁর ছায়াশীতল মমতা আমাদের আগলে রাখবে, আমাদের আঁচল ভরসার আকাশ হয়ে থাকবে মাথার উপরে। কিন্তু হঠাৎ করেই সবকিছু থেমে গেল। যে মানুষটিকে ভরসার স্তম্ভ ভেবেছিলাম, তিনি হঠাৎ করেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। আর তার অনুপস্থিতি আমার হৃদয়ে এক বিশাল অবিশ্বাসের দেয়াল তুলে দিল।


আজ মনে হয়, ছোটবেলা থেকে যে মূল্যবোধের শিক্ষা পেয়েছিলাম, সেগুলো আসলে বাস্তব জীবনে অকার্যকর। সততা, নীতিকথা, সত্য-বচন- এসব আঁকড়ে ধরে আমি শুধু পিছিয়েই পড়েছি। আর চারপাশের মানুষগুলো নিজেদের স্বার্থের জন্য কোনোকিছু করতে দ্বিধা করেনি। এই ১০০ দিনে আমি দেখেছি রক্তের সম্পর্কও কেমন করে বিশ্বাসঘাতক হয়ে যায়। যাদের একসময় নিজের বলতে শিখেছিলাম, যাদের আপন ভেবে স্বস্তি আর মনের তৃপ্তি বুঝে নিতাম; তারাই স্বার্থ হাসিলে বেইমান হয়ে উঠেছে। মানুষ যে এতটা স্বার্থপর হতে পারে, এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, এত বড় মাপের নিমকহারাম হতে পারে; এমন করে না দেখলে কখনোই বিশ্বাস করতাম না।


সব আক্ষেপ, সব হতাশা, সব কষ্ট আর সব বেদনার শেষে আমার একমাত্র প্রার্থনা- মহান আল্লাহ যেন আমার আম্মাকে পরিপূর্ণ শান্তি দান করেন। তিনি যেন হাসরের ময়দানে আম্মাকে হাউজে কাউসারের শীতল পানীয় দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করান। আর জান্নাতুল ফেরদৌসকে আম্মার জন্যে স্থায়ী আবাস হিসেবে ঘোষণা করে দেন।


আমার জীবন আজ শূন্যতায় ভরা। কিন্তু সেই শূন্যতার ভেতরও আমি মায়ের শান্তির জন্য হৃদয়ের অন্তঃস্থল হতে দোয়া করি। কারণ আমার সমস্ত বিশ্বাস, ভরসা আর আশ্রয় এক মানুষেই ছিল- আমার আম্মা। আর আজ তিনি নেই… ১০১ দিন।

সোমবার, আগস্ট ১৮, ২০২৫

একদিন ঠিক হারাবো গিয়ে বনে…

 

⠀⠀⠀⠀

প্রায়ই আমার এই শহরের ভিড় থেকে পালাতে ইচ্ছা করে। 

এই যে অলিগলি রাস্তা জুড়ে হাজর মানুষের হাঁটা-চলা, যান্ত্রিক জীবনের অনবরত শব্দ; এসবের মাঝে নিজেকে আমার দারুণ বন্দী মনে হয়। যদিও খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার জন্যই এই শহর জীবন, কিন্তু সে তো আমাকে মুক্ত ভাবে শ্বাস নিতে দেয় না। কংক্রিটের এই জঙ্গলে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন মনে হয়, আমি ভুলে যাচ্ছি মুক্ত জীবনের স্বাদ।

হয়ত এই কারণেই মনে মনে ইচ্ছে হয় কোন এক হাঁটা-পা এর রাস্তা ধরে অচেনা কোন গহিন বনে হারাতে। আঁকাবাঁকা পথ, পাতায় ঢাকা, রঙে রঙে মোড়া পথ, কোলাহল বিহীন সেই পথে হেঁটে বেড়াতে। সেই বন আর বনের পথটি হবে একান্তই আমার নিজের।

শহরে বুকে কখনো যে গন্ধ মিলে না, সেই গন্ধে ভরে থাকবে আমার সেই বুনো পথ। মাটির কাঁচা গন্ধ, ঝড়া পাতার অচেনা সুরভি, আর হয়ত কোন অদৃশ্য ফুলের মৃদু সুবাস। সেখানে শ্বাস নিতে গিয়ে মনে হবে- আমি বেঁচে আছি, সত্যিই বেঁচে আছি। শহরের ধোঁয়া, গ্যাস, বর্জ্য কিংবা কৃত্রিম সুবাস এই সবই সেখানে থাকবে কেবলই এক দুঃস্বপ্ন হয়ে।

বনের গভীর নিস্তব্ধতাকে আগলে নেবো নিজের অস্তিত্বের সাথে। সেখানে থাকবে না এলোমেলো ব্যস্ত পদচারণা, থাকবে না কুৎসিত হর্ন, থাকবে না ট্র্যাফিক জ্যাম, থাকবে না পিচের গরম। থাকবে কেবল পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ, থাকবে শুকনো পাতার উপর দিয়ে দৌড়ে যাওয়া অচেনা কোন প্রাণীর পদচারণা, থাকবে বাতাসের ফিস‍্‍‍ফিসানি আর থাকবে অন্তর জুড়ানো গাছের ছায়া। এই সবই প্রকৃতির আপন স্পর্শ, এগুলোই পৃথিবীর আসল ভাষা; যা আমরা ভুলে গেছি এই কোলাহলে মত্ত হয়ে। 

ফ্লুরোসেন্টের আলোর নিচে বসে এখন আমি এক অন্ধকার পৃথিবী দেখি। এই আলো হৃদয়ের গহিন কোণকে আলোকিত করতে পারে না। অথচ আমার সেই অরণ্যে খেলা করে বিস্ময়ের আলো নিয়ে। পাতার ফাঁক গলে যখন সূর্যের আলো যখন মাটির গায়ে পড়ে, মনে হয় যেন ছোট ছোট আলোর কণা মিছিল করছে সেখানে। আবার মাঝে মাঝে আলোর রশ্মি গুলো এমন এক বিভ্রম তৈরি করে, যেন মনে হয় সেখানে রয়েছে এক আলোর ঝলমলে দেয়াল। দেয়ালের ওপারে রয়েছে অন্য এক জগৎ, যেখানে নেই কোন দায়িত্ব, নেই কোন দৌড়ঝাঁপ, নেই কোন একঘেয়েমি। শুধু শান্তি- নির্মল, অনাবিল শান্তির বাস সেখানে।

এই যে শহরজুড়ে গায়ের সাথে গা ঘেঁষে তৈরি হয়েছে আকাশছোঁয়া দালানের জঞ্জাল। একের পর এক বিল্ডিং, যার জানালা দিয়ে নিচে তাকালে কেবল দেখা মেলে ছুটে চলা শহর, ধুলো, কালো ধোঁয়া আর মেকি জীবনের দৌড়ঝাঁপ। এখানকার প্রতিটি দালান, প্রতিটি ফ্ল্যাট, প্রতিটি খোপ-খোপ রুম যেন এক একটি কারাগার। জীবনের মায়ায় অন্ধ হওয়ার দোষে সবাইকে সেই কারাগার যাপনের আদেশ দেয়া হয়েছে এখানে। অথচ আমার বনে প্রতিটি গাছই জানালা, প্রতিটি পথ মুক্তির, আর বহমান বাতাসে বাজে জীবনের সুর।

আমার ভেতরের আমিটা বারবার বলে উঠে- “বারবার হারিয়ে যাও তোমার আরণ্যের গভীর থেকে গভীরে; ক্লান্তি ঘিরে ফেলার আগ পর্যন্ত হেঁটে বেড়াও আঁকাবাঁকা পথটি ধরে।” হয়ত কোনো একদিন সত্যিই সব ছেড়ে দিয়ে চলে যাবো। খুঁজে বের করবো আমার সেই প্রিয় বনটিকে অজানা কোন প্রান্তে। যেখানে আমার সাথে থাকবে কেবল ‘আমি’। গাছ, পাখি, পো‌ঁকা আর মাটি -সবাই মিলে ঘুচিয়ে দিবে আমার হৃদয়ের অসীম নিঃসঙ্গতা। 

⠀⠀⠀⠀

তখন আর আমি এই শহুরে মানুষ থাকবো না; আমি হবো বনের সন্তান… 

⠀⠀⠀⠀

⠀⠀⠀⠀

⠀⠀⠀⠀

ছবি-সূত্রঃ u/myriyevskyy

শনিবার, আগস্ট ১৬, ২০২৫

তুমি তো আমাকে চেনো…

 


প্রথম ভাগঃ প্রারম্ভিকা

জানোই তো, ঘুম হল এক ধরনের প্রতারণা। ক্লান্ত হলে বিশ্রাম নিতে তুমি চোখটা বন্ধ কর, ধীরে ধীরে তোমার শরীর শিথিল হতে শুরু করে। হৃৎস্পন্দন কমে আসে, কমে আসে শরীরের তাপমাত্রা। তুমি তখন নিজেকে নিরাপদ ভেবে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে শুরু কর। 

আর ঠিক সেই সময়টাতেই তোমার বুকের উপর এমন কিছু একটা উঠে বসে, যার অস্তিত্বের কথা তোমার জানা নেই!

তবে আমি জানি, কারণ আমি তো সেটা দেখেছি।

আচ্ছা চল, তোমাকে আমার ঘটনাটা বলি, তাহলেই তুমি বুঝতে পারবে আমি কীসের কথা বলছি।

প্রথম রাতে আমি শুধু একটা মৃদু শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম। শব্দটা মৃদু হলেও তার তীক্ষ্ম একটা অনুভূতি আমাকে ছুঁয়ে দিয়েছিল। নিঃশ্বাসের শব্দ ছিল সেটি। অন্ধকারে, ঠিক আমার বিছানার কোণ থেকে শব্দটা হয়েছিল। কেমন একটা ঠান্ডা, গভীর, লম্বা একটা টান। আমি ভেবেছিলাম মনের ধোঁকা হয়তো, এত রাতে একা ঘরে কার নিঃশ্বাসের শব্দ হবে!

দ্বিতীয় রাতেও আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল, খুব অস্বস্তি লাগছিল। ওটা তখন আমার বুকের উপর বসে আছে। নড়তে পারছিলাম না, শ্বাসও নিতে পারছিলাম না। শুধু অনুভব করছিলাম সেই ঠান্ডা নিঃশ্বাসের মতই- ঠান্ডা, ভেজা হাতটি গলার চেপে ধরে আছে। চাপটা খুব অদ্ভুত, না শক্ত - না নরম; তবে ততটাই, যতটা থাকলে পরে তোমাকে আতঙ্ক আঁকড়ে ধরে।

দিনের আলোতে এই কথাগুলো নিজের কাছেই হাস্যকর লাগছিল। বিশ্বাস কর, মাকে গিয়ে যে কথা গুলো বলব, আমার তো নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল ছ’বছরের বাচ্চারা রাতে স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে যা করে, আমিও তেমন করছি।

তৃতীয় রাতেও আমি সেই ঠান্ডা হাতের অনুভব পেলাম। আমি ঠিক-ঠিক গুনে ফেললাম- সেখানে মোট ছ’টা আঙ্গুল আছে। তিনটা বামে, আর তিনটা ডানে। বরফ শীতল আঙ্গুলগুলো যেন গলার চামড়া ফুড়ে মেরুদন্ড ছুঁয়ে দিতে চাইছে!

তারপর, চতুর্থ রাত, আমি বুঝলাম ও আমাকে ডাকছে। ওকে আমি ঠিক দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু ওর কণ্ঠটা যেন আমার মস্তিষ্কের ভেতর ভেসে বেড়াচ্ছে। বলছে- ‘তুমি তো আমাকে চেনো….’

পরদিন সকালে মা আমাকে ডাকতে এসে দেখলেন, আমি চুপচাপ শুয়ে আছি। ডাক্তার বলল- ‘হার্ট অ্যাটাক’। সবাই সেটা বিশ্বাসও করে নিল। অথচ, আমি সেখানেই ছিলাম, আয়নাটার সামনে। যেখান থেকে আমি সেই ছায়াটাকে ধীরে ধীরে সরে যেতে দেখছিলাম, আর তার দৃষ্টি ছিল… থাক সে কথা।

⠀⠀⠀

এর ক'দিন বাদেই ওরা সবাই বাড়িটা খালি করে কোথায় যেন চলে যায়। আমি ওদের দেখেছি, ওরা ঘরের আসবাবপত্র বের করছে, সামানা গোছাচ্ছে, ভ্যানে ভরছে। কিন্তু ওরা আমাকে দেখে না। জানালা দিয়ে আমি কেবল ওদের চলে যাওয়াটুকুই দেখলাম। এরপর থেকেই আমি একা, একদম একা।

⠀⠀⠀

⠀⠀⠀

দ্বিতীয় ভাগঃ বাড়ির নতুন বাসিন্দা...

শহর ছেড়ে এই গ্রামে এসেছি দিন দশেক হয়েছে। একটা প্রজেক্ট চলছে এখানে, আরও কয়েক মাস চলবে। প্রথম কয়েকদিন তো এখানকার কাজ-কর্মের কোন আগা-মাথা বুঝে পাচ্ছিলাম না। সবই চলছে নিয়ম মাফিক, আবার সবই এলোমেলো। সে সব গোছাতেই চলে গেছে এই কয়েকদিন। হেড অফিস থেকে জানাল, তারা এখানে নতুন কাউকে পোস্টিং দিবে বলে ভাবছে। তবে সেটা হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাকে একটু কাজগুলো গুছিয়ে দিতে বলল।

শহরের বাইরে আমার তেমন করে কখনো থাকা হয়নি। এখন এই কাজের কারণে না আসলে হয়ত এভাবে এতদিনের জন্যে আসা হতো না। শহরেই জন্ম, বেড়ে উঠা, আর শহরেই জীবনটার ইতি হতো। সারাদিন ভালোই কাটে, কাজের ব্যস্ততায়, সাইট ঘুরে দেখে। কিন্তু বিকেলের পর আর সময় কাটতে চায় না। তার উপর এমন একটা জায়গায় থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে! ছোট একটা একতলা বাড়ি, একদম গ্রামের সীমান্ত ঘেঁষে। বাড়িটা অফিসের, এখানে তারা অন্য একটা প্রজেক্টের জন্য জমি কিনার সময় খুব কম দামে পেয়ে যায়, তাই কিনে নেয়। কারও থাকার উদ্দেশ্য না হলেও এখন এই প্রজেক্টের জন্যে আমার থাকার জায়গা হয়েছে।

ছিমছাম শান্ত পরিবেশ ঘেরা, ঝুপ করে সন্ধ্যা নামার পর নাম না জানা পোকার ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। এখানকার ম্যানেজার প্রথমে তার বাসাতেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার কারও বাসায় এভাবে থাকাটা পছন্দ হচ্ছিল না, তাই সেটা বাতিল করেছিলাম। এরপর তিনি একপ্রকার জোড় করেই খাবারের ব্যবস্থাটা নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিলেন। এখন টিফিন কেরিয়ারে করে সন্ধ্যার পরপর খাবার চলে আসে তার বাড়ি থেকে। তবে এক ফাঁকে তিনি আমাকে জানালেন, এই বাড়িটার ব্যাপারে কিছু আজেবাজে কথা শোনা যায়। যদিও বিশ্বাস করার মত তেমন কোনো ভিত্তি নেই। তারপরও রাতে বাড়ি থেকে বের হতে বারণ করলেন। আর কোনো সমস্যা হলে যত রাতই হোক, তাকে যেন নির্দ্বিধায় ফোন করে জানাই -সে আশ্বাস আদায় করে নিলেন।

দিনভর দৌড়োদৌড়ির পর শান্ত পরিবেশ আর পেট পুরে খানা পেয়ে এখন ঘুমও চলে আসে দ্রুত। বড় জোড় রাত ১০টা পর্যন্ত জাগে থাকতে পারি, তারপর টুপ করে ঘুম ধরে বসে। অবশ্য আমিও যে খুব জেগে থাকতে চাই, তা না। সকাল সকাল খুব ফ্রেশ একটা ভাব চলে আসে এত লম্বা ঘুম পেয়ে। দিনের ক্লান্তিটা তখন আর তেমন গায়ে লাগে না।

এগারো তম রাতে হঠাৎ করেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। কেমন একটা অস্বস্তি লাগছিল, ঠিক বোঝানোর মত না। কেমন যেন একটা অস্বাভাবিক নীরবতা নেমে এসেছে। জানালার ফাঁকা দিয়ে ফ্যাকাশে চাঁদের আলো এসে বিছানার একপাশে থেমে আছে। মনে হচ্ছে যেন সময়টাও আটকে গেছে। অস্বস্তিটা আমাকে এমনভাবে ঘিরে ধরেছে যে, উঠে বসে টেবিল থেকে মোবাইল বা ঘড়িটা পর্যন্ত নিতে ইচ্ছে হলো না। বেশ অনেকটা সময় পর হঠাৎ করেই সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। যেন কেউ রিমোট থেকে প্লে বাটনে চাপ দেয়ার সাথে সাথেই সব আগের মতই চলতে শুরু করেছে। অস্বস্তিটাও কেটে গেল প্রায় সাথে সাথেই। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি আবার ঘুমের সাগরে ডুবে গেলাম।

পরদিন আর এটা নিয়ে তেমন কিছুই মনে থাকলো না। সাইট ঘুরে কাজ দেখতে দেখতে দিন কেটে গেল।

সমস্যাটা হলো আবার রাতে। গতদিনের মতই ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। ঠিক ভেঙ্গে গেল কিনা সেটাও নিশ্চিত করে বলতে পারছিলাম না। যেন ঘুমের গভীর কোন স্তরে ডুবে আছি, কোন নড়াচড়া কিংবা সাড়াশব্দ কিচ্ছু নেই। কেবল একটা চাপা অস্বস্তি।

হঠাৎ বুকের উপরে ভারী আর ঠান্ডা একটা চাপ অনুভব করলাম। কারও উপস্থিতি… না, কারও বসে থাকা। শরীর শক্ত হয়ে গেছে, আঙুল পর্যন্ত নড়ছে না। চিৎকার করতে গেলেও শব্দ বের হচ্ছিল না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।

তারপর ঠান্ডা, ভেজা একজোড়া হাত গলার দুই পাশে চেপে ধরলো। এমনভাবে চাপ দিচ্ছিল- যেন নিখুঁতভাবে আমার শ্বাস বন্ধ করতে চাইছে। চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে, মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। আর কানের ভেতর একটা ফিসফিসানি-
"তুমি তো আমাকে চেনো…"

আজকের পূর্বে আমার নিজেকে কখনো ভীতু মনে না হলেও, আজ আমার বুকের ভেতর ভয় ভয় জমে বরফ হয়ে গেল। হঠাৎ মনে হলো নিঃশ্বাসও নেওয়ার দরকার পড়ছে না। গলার চাপ কমেনি, বরং বেড়েছে বলা যায়। অথচ শ্বাস টানার কোন আকুতি আর ফুসফুস করছে না। হয়ত অক্সিজেনের অভাবে উল্টোপাল্টা ভাবছি। কিন্তু এটাও বুঝতে পারছি যে মস্তিষ্ক পরিষ্কার চিন্তা করতে পারছে। আর প্রশ্নটা নিজে থেকেই এলো- তবে কি আমি মারা গিয়েছি? নাকি এটা পুরোপুরি কল্পনা? অথবা এই অনুভূতিটাই মৃত্যুর পরের অংশ?

পরের মুহূর্তেই উঠে বসলাম। বুক ধড়ফড় করছে, কিন্তু ঘরের পরিবেশ একদম স্বাভাবিক। জোরে জোরে ফুসফুস ভরে শ্বাস নিচ্ছি, বা হাঁপাচ্ছি। বিছানাটা এলোমেলো, চাদর গুটিয়ে গেছে।

নামলাম বিছানা থেকে, হেঁটে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলাম। একটু আগে যে আতঙ্ক ভর করেছিল, তার ছিটে-ফোটাও লাগছে না এখন। উলটো নিজেকে যেন আরও হালকা লাগছে। বেসিনের ট্যাপ ছেড়ে চোখে-মুখে ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে দিলাম। মাথা কিছুটা পরিষ্কার হলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বোকামিতে হেসে ফেলতে গেলাম,কিন্তু হাসি মিলিয়ে গেল পরের সেকেন্ডেই।

গলার দুই পাশে তিনটা করে সমান লালচে দাগ। যেন কারও আঙুলের চাপের ছাপ। আমি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম, হালকা গরম, কিন্তু কোনো ব্যথা নেই। আমার আতঙ্কিত হওয়ার কথা, কিন্তু তেমন কোন অনুভূতি হচ্ছে না। যেন এমনটা হবে আমি জানতাম!

এরপর আর ভালো ঘুম হলো না। বারবার কেবল ঘুরে ফিরে ঐ ফিস্‌ফিস শব্দটা মাথায় চলে আসছিল। "তুমি তো আমাকে চেনো…"

পরদিন সকালে অফিসে গিয়েই এখানকার ম্যানেজার সাহেবকে জানালাম জরুরি কাজে বাড়ি যাচ্ছি। হাতের কাজগুলো তাকে বুঝিয়ে দিয়েই গাড়িতে উঠলাম। হেড অফিসে কেবল অসুস্থতার ছুটির জন্য একটা মেইল পাঠিয়ে রাখলাম।

আট ঘণ্টার জার্নি দিয়ে ফিরলাম বাসায়। আমার কেবল মনে হচ্ছিল আমাকে যে করেই হোক ঐ জায়গাটা ছেড়ে আসতে হবে। তাই আর সামনে-পেছনে কোন কিছুই চিন্তা না করে সোজা বাসায় এসেছি। অবশ্য বাসায় এসে কাউকে কিছু বলে ভরকে দিতে ইচ্ছা হল না। ছুটি নিয়েছি, জানালাম কেবল। ওরা ভাবল, এভাবে হঠাৎ করেই শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে থাকা, আর লম্বা জার্নির কারণে আমাকে এমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।

ফ্রেশ হয়ে কোনোরকম রাতের খাবার শেষ করেই আমার রুমে গিয়ে ঢুকলাম। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম ঘুম ভাব চলে আসল। অনিচ্ছাতেও গভীর ঘুমে নিপতিত হতে থাকলাম।

⠀⠀⠀

⠀⠀⠀

তৃতীয় ভাগঃ অবশেষ…

একটা ঘোরের মন লাগছে। মনে হচ্ছে জেগে আছি, আবার মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। বিছানায় উঠে বসতেই আলমারির আয়নার দিকে চোখ পড়ল। পেছনে বাথরুমের দরজা আধখোলা, আর তার ফাঁক দিয়ে মনে হলো কেউ দাঁড়িয়ে আছে- অস্পষ্ট, ছায়ার মতো।

আমি চোখ মুছলাম, আবার তাকালাম- কই? কেউ তো নেই!

হঠাৎ বাতাস থেমে গেল।
না, আসলে বাতাস নয়, নিশ্বাস নেয়ার আকুতি; থেমে গেলো।

আয়নার ভেতরে আমার পেছনে অন্ধকার জমতে শুরু করলো। প্রথমে মনে হলো ছায়া, কিন্তু তা ধীরে ধীরে আকার নিচ্ছে- লম্বা, কঙ্কালসার হাত… প্রতিটি হাতে তিনটি লম্বা আঙুল।

আমার কাঁধের উপর দিয়ে সেই হাতের ছায়া এগিয়ে এলো। আয়নায় হাত দেখা গেলেও আমার গায়ে কোন কিছুর ছোঁয়া অনুভব করলাম না। আমি স্থির হয়ে রইলাম, চোখের পাপড়িও ফেলতে পারছি না।

তারপর সেই ছায়ার মাথাটা ঝুঁকে এল আমার ঠিক কানের পাশে। কোনো ঠোঁট নড়ছে না, কিন্তু এক বরফশীতল ফিসফিসানি মাথার ভেতর এক স্বরে বলেই চলেছে-
"তুমি তো আমাকে চেনো…"

আমি তখন আয়নার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম প্রতিফলনে দাঁড়িয়ে থাকা আমিটা আসলে আমি নই।

প্রতিফলনের চোখ গাঢ় কালো হয়ে গেছে, ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি, আর গলার দাগগুলো রক্তিম লাল হয়ে জ্বলজ্বল করছে। ওটা আমাকে দেখছে… কিন্তু আমি ওটাকে... কি জানি!

⠀⠀⠀

বাথরুমের দরজা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল। অন্ধকার পুরো ঘরটাকে গিলে নিল।

⠀⠀⠀

⠀⠀⠀

⠀⠀⠀

বুধবার, আগস্ট ১৩, ২০২৫

বিকেলের রঙে হারানো দিনগুলো

 

⠀⠀⠀


মনিটরের পর্দায় এই ছবিটা দেখে মনে হল যেন কেউ আমার ভেতরের স্মৃতির দরজাটা আস্তে করে খুলে দিচ্ছে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই শৈশবের বিকেলগুলো- যখন গরমের দুপুর গুলিতে ভাতঘুম দিয়ে বিকেলের আগে আগে উঠতাম। তারপর বিকেল নামলে পরে যেতাম মাঠের দিকে। চারপাশে শুধু বিস্তীর্ণ সবুজ, দূর-সুদূরে অল্প কয়টিা বাড়ি আর ওপরে অনন্ত নীল আকাশ। মনে হতো, যদি কোনোভাবে ওই আকাশে উঠার সিঁড়িটা খুঁজে পেতাম! ভাবতাম নিশ্চই আকাশের একটা গোপন রাস্তা আছে, যা কেবল আমার চোখে ধরা পড়ে না!