মঙ্গলবার, আগস্ট ০১, ২০১৭

মজার ছবি-ব্লগঃ ভাস্কর্যের সাথে তাহারা!

সব ভুলে গিয়ে নিজের মত করে আনন্দ খুঁজে নেয়াটা বড় কঠিন। এই কাজ সবাইকে দিয়ে হয় না। তবে যারা করতে পারে তাদের যেন কিছুতেই বাধা দিয়ে রাখা যায় না। নেট ঘেঁটে এমন সব মানুষদের মজার কিছু পিক খুঁজে নিয়ে আসলাম আজকের আয়োজনে। চলুন, তাদের আনন্দে আমরাও কিছুটা সামিল হয়ে আসি...



একদিন পার্কে, কুম্ফু ক্যারাতে!

হাই ফাইভ!

এই মিউজিকটা কিন্তু জোস, বুঝলে!
নাও, শেয়ারইট চালু করে তোমার মোবাইলেও নিয়ে নাও

ওরে রে! ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার হয়ে গেল!!

এভাবে আর কতকাল অভিমান করে কাটাবে, সেনোরিটা!

দেখলে খোকা! ভয়ের কিস্যু নেই। আমি আছি না!


এই দাড়া! আমাকেও নিয়ে যা তোদের সাথে...!

ছাড়! ছাড় আমাকে!

ইয়্যো! এ কি করছো ড্যুড!!

এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলতো ♪♫♪

তোমার জন্যে অলিম্পিকও নস্যি জেনো প্রিয়!

ঐ ব্যাটা, পাওনা টাকা দিস না কেন তুই!

দিলো রে! মাথাটারে গুড়িয়ে!

আআআআআ..... আমার এত সাধের চুল...!

ইইই হা! দৌড়া পাগলা! দৌড়া!!

আহ দিদি! একটা আঙ্গুর তো ফেলো এদিকে!

আম্মু! দ্রুত খেলার মাঠে নিয়ে চল!!


দাড়াও! আপেলটাতে বিষ মাখানো আছে, ধরো না ওটা!

আজ তোর কল্লাটাই যাবে...!

হায়...! সত্যি?

টুং টাং ছন্দটা আমার জন্যেই তো...মিষ্টার?

শোন! তোমাকে গোপন কথাটা বলি, তুমি আবার কাউকে বলো না যেন!

হ্যা স্যর! এই যে এই প্যারাটা। দেখলেন তো কতটা মজার....‍!

যখন আইনস্টাইন তোলে সেলফি 😜

এই তো বাবু, আর কাঁদে না..!

জলপরি! তুমি শুধুই আমার... 😝

স্যর! স্যর!! স্যর!!!
এইবারের মত ক্ষেমা দেন! আর কুনুদিন ঐকাম করুম না! 

দাড়াও মেয়ে! এই চুম্বনের মালিক কেবলই আমি... 😆

ম্যাচটা আনতে ভুলে গেছি! ধর, একটু আগুনটা জ্বেলে নেই...

ফুউউউউ............!‍

আমার নৌকা নিয়ে আর কোন বাজে কথা বলবে কখনো..?

এই! দাড়া দাড়া! প্রথম কামড়টা আমি দেবো বলছি....!

দেখি তো বিগফুট! তোমার সুড়সুড়ি আছে নাকি..!

বেবি! ইউ আর অনলি মাইন!

এই তো! এখানেই সেটা আছে, দেখলে তো..!

ড্রিকটা দারুন, একটু খেয়ে দেখো..!

আর কখনো ওর দিকে তাকাবি ছ্যাচড়ার মত! বল!!

তোর ঐ নাক আমায় দিয়ে দে...!

এই যে, গুটিটা এখানে ফেলেছো তুমি..!

উউউপপপপসসস.....!

এই ছোকড়া! ক্লাস ফাকি দিয়ে আর গার্লস কলেজের সামনে ঘুরবি?

ছক্কা...!

ঐ দেখো! ওটাকে বলে লক্ষ্মী তারা!

নাহ ম্যাডাম! এই ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র আইডিয়া নেই..!

শেষ চালে কে বেইমানি করেছিস বল তো..!

তুমি সুন্দর! তাই অপলক চেয়ে থাকি...!

ঐ ছোকড়া! ঐদিন আমার পিৎজা নিয়ে ভাগলি কেন এমন করে?

হা! হা! হা! মটু, তোকে মেরে ভাগলাম আমি! 

পড়া না শিখে দুষ্টামি করলে একদম ছুড়ে ফেলবো তোকে....! 

দাড়াও! আমি উঠিয়ে দিচ্ছি তোমায়..!

ড্যান্স মুভ এভ্রিহয়্যার!

ছেড়ে দে শয়তান! এই বাবু কেবলই আমার..!

এই সুযোগ! ব্যাগটা নিয়ে ভাগি আমি!

আআআ! ছোকরাটার সাহস দেখেছ!!

বিল না দিয়ে কোথায় ভাগছো, অ্যা!?

ডক্টর! ডক্টর! হেল্প প্লিজ!!
পোষ্ট পড়ে মহিলাটা অজ্ঞান হয়ে গেছে...!





………………………………………………………
পিক কার্টেসিঃ স্ব-স্ব ফটোগ্রাফার
পিক সোর্সঃ Google Image Search
Pinterest.com
imgur.com



বৃহস্পতিবার, জুলাই ২৭, ২০১৭

অনুবাদ গল্পঃ হারানো ওয়ালেট


দিনটি আর দশটি দিনের মতই সাধারণ একটি দিন ছিল। বেশ ঠাণ্ডা পড়ছিল ঐ দিনগুলোতে। সেদিন যখন বাসায় ফিরবার পথ ধরে হেটে যাচ্ছিলাম তখন বেখেয়ালেই কিছু একটা পা দিয়ে মারিয়ে গেলাম। নিচু হয়ে দেখলাম একটা ওয়ালেট পড়ে আছে সেখানে। কেউ সম্ভবত তার ওয়ালেটটি এ পথে হাটতে গিয়েই হারিয়েছে। উবু হয়ে ওয়ালেটটি তুললাম রাস্তা থেকে। কার ওয়ালেট তা জানার জন্যে ভেতরে ঠিকানা খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু মাত্র তিনটি ডলার আর এক কোণে থাকা এক দুমড়ানো একটা ভাজ করা কাগজ ছাড়া তাতে আর কিছুই দেখতে পেলাম না। মনে মনে আশা করলাম কাগজটিতে হয়তো তার পরিচয় পাওয়া যাবে। 

ওয়ালেটের কোণ থেকে ঐ দুমড়ানো কাগজটি সাবধানে বের করে নিয়ে আসলাম। দেখলাম প্রায় বিবর্ণ একটি চিঠির খাম সেটা। আর এমন ভাবে ওয়ালেটের কোণে রাখা ছিল খামটি, যেন বহুবছর ধরেই তার ঠিকানা ঐ কোণটি। খামটির অবস্থা প্রায় যাচ্ছেতাই রকমের ছিল, শুধুমাত্র ফিরতি ঠিকানাটি বাদে আর কিছুই খামটি গা থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হল না। তবে আশার কথা হচ্ছে, খামটির ভেতর একটি চিঠির অস্তিত্বও অনুভব করতে পারছিলাম। শুধুমাত্র ওয়ালেটটির মালিকের খোঁজের আশায় আমি চিঠিটি খাম থেকে বের করে নিলাম। কিন্তু চিঠিটির উপরে থাকা তারিখটি দেখে আমার চোখ প্রায় কপালে উঠার যোগাড়। সেখানে তারিখ দেয়া আছে ১৯২৪ সালের একটি দিনের। আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে লেখা চিঠি এটি!

দেখে বুঝলাম কোন এক মেয়েলি হাতের গুটি-গুটি অক্ষরে লিখা রয়েছে চিঠিটি। কাগজটি ছিল অমসৃণ নীল বর্ণের, যার বাম দিকের এক কোনায় চমৎকার একটি ফুল আকা। চিঠিটি পড়ার পর বুঝলাম এটি প্রিয় মানুষের কাছে লেখা এক পত্র, যেখানে লেখিকা হান্যা তার প্রিয় মানুষ মাইকেলের কাছে নিজের অপারগতা প্রকাশ করেছে। একই সাথে হান্যা যে তাকে মন থেকে প্রচণ্ড পরিমাণে ভালোবাসে তাও লিখা আছে চিঠিটিতে। শুধুমাত্র তাদের বয়সের পার্থক্য আর হান্যার মায়ের শক্ত বাঁধার কারণে সে তার প্রিয়পাত্রের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারছে না বলেই এই অপারগতার প্রকাশ। হান্যা আরও লিখেছে, সে আজীবনই মাইকেলকে ভালোবেসে যাবে।

সন্দেহ নেই এটি হৃদয়বিদারক কিন্তু চমৎকার একটি চিঠি। কিন্তু শুধুমাত্র মাইকেলের নামটি ছাড়া চিঠি থেকে ওয়ালেটটির মালিক সম্পর্কে কোন ধারণাই পাওয়া গেল না। যেহেতু হান্যার একটি ফিরতি ঠিকানা ছিল, তাই আশা করলাম অপারেটরের সহায়তা নিয়ে এই ঠিকানার একটা কূল কিনারা করা সম্ভব হবে। ঠিকানাটির বিপরীতে যদি কোন ফোন নম্বর রেজিস্টার করা থাকে তাহলে কাজটি আমার জন্যে বেশ সহজ হয়ে যাবে।

চিঠিটি পকেটে ভরে ওয়ালেটটি হাতে নিয়েই দ্রুত বাড়ির দিকে রওনা হলাম। একটু দ্রুত করলে হয়তো সন্ধ্যার আগে আগেই ওয়ালেটটি তার মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারবো। বাসায় পৌঁছেই দ্রুত জামা পাল্টে অপারেটরকে ফোন দিলাম। বললাম- "অপারেটর, একটি অযাচিত অনুরোধ করতে যাচ্ছি আমি।" অপারেটর আমার কথাটি শুনে একটু সময় নিয়ে বলল, "বলুন"। সম্মতি পেয়ে আমি বললাম, "আসলে আমি একটি ওয়ালেট খুঁজে পেয়েছি রাস্তায়, আর ওয়ালেটটির মালিকের খোঁজ করতে চাচ্ছিলাম। আপনি কি আমাকে একটি ঠিকানার বিপরীতে কোন ফোন নম্বর রেজিস্টার করা আছে নাকি তা বলতে পারবেন? ঠিকানাটি আমি ঐ ওয়ালেটের ভেতর একটি চিঠি থেকে পেয়েছি।"

ওপাশ থেকে অপারেটর বলল- "আসলে এমন ব্যাপারে সরাসরি আমার সুপিরিয়রের সাথে কথা বললেই আপনার জন্যে ভালো হবে।" এরপর একটু থেমে যোগ করল- "আমি আপনার সমস্যাটির কথা বুঝতে পেরেছি। আর ঠিকানাটি চেক করেও দেখলাম এখানে একটি ফোন নম্বর রেজিস্টার্ড আছে। কিন্তু গ্রাহক নিরাপত্তার খাতিরে আমি আপনাকে ঐ নম্বরটি দিতে পারছি না। কিন্তু আপনার উদ্দেশ্যের প্রতি সম্মান করে আমি আপনার হয়ে সেখানে কথা বলতে পারি। আপনার ঘটনাটিও আমি সবিস্তরে তাদের জানাবো। এরপর যদি তারা যোগাযোগ করতে আগ্রহী হয় তাহলে আপনার সাথে তাদের যোগাযোগ করিয়ে দেবো।" 

সন্দেহ নেই, এটি একটি চমৎকার প্রস্তাব। আমি অপারেটরের কথায় রাজি হয়ে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রাখলাম। তবে আমাকে খুব বেশি সময় ফিরতি ফোনের জন্যে অপেক্ষা করতে হয় নি। অল্প কিছুক্ষণ পরেই আবার অপারেটর আমাকে ফোন করল। বলল- "আপনার ঐ ঠিকানায় থাকা নম্বরটিতে আমি ফোনে কথা বলেছি। আপনার ঘটনা শুনে একজন ভদ্রমহিলা আপনার সাথে যোগাযোগ করতে সম্মত হয়েছেন।" এরপর অপারেটর আমাকে একটি নাম্বার দিয়ে ফোন রাখলেন।

অপারেটর থেকে পাওয়া নম্বরটিতে রিং করতেই ওপাশ থেকে একজন মহিলা ফোনটি রিসিভ করল। আমি খুব বিনীত ভাবে তাকে জিজ্ঞাস করলাম তিনি হান্যাকে চিনেন কি না। হান্যার নামটি শুনে মহিলা খুব অবাক স্বরে বললেন- "ওহ! আমার স্বামী এই বাড়িটি যে পরিবারের কাছ থেকে কিনেছিলেন তাদের একটি মেয়ে ছিল হান্যা নামে। কিন্তু সে তো প্রায় ৩০ বছর আগেকার কথা!" 

আমি আবার মহিলাটিকে জিজ্ঞাস করলাম- "আপনি কি জানেন ঐ পরিবারটি এখন কোথায় আছে?"

"ওভাবে তো জানা নেই, তবে শুনেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে এখানকার এক নার্সিং হোমে হান্যার মা'কে ভর্তি করাতে হয়েছিল", জবাবে বললেন মহিলা। "আশা করি ঐ নার্সিং হোমে খোঁজ নিলে তুমি হান্যার খোঁজ বের করতে পারবে।"

তিনি আমাকে ঐ নার্সিং হোমের নাম বললেন। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রাখলাম আমি। এরপর ফোন ডিরেক্টরি ঘেঁটে ঐ নার্সিং হোমের ফোন নম্বরটি বের করে ফোন লাগালাম সেখানে। রিসিপশন থেকে আমার ফোনটি রিসিভ করল। রিসিপসনিষ্টকে হান্যার মা'য়ের বর্ণনা দিয়ে জানতে চাইলাম তার সম্বন্ধে। রিসিপশন একটু সময় নিয়ে পুরানো আর্কাইভ ঘেঁটে জানাল- বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা সেটি, আর একই সাথে সে দুঃখও প্রকাশ করলেন। জানালেন এখানে আনার কিছুদিন পরই মহিলাটি মারা যায়। তবে তাদের কাছে একটি ফোন নম্বর আছে ঐ মহিলার এক স্বজনের। আরও জানালেন তাদের কাছে থাকা ঐ ফোন নম্বরটি সম্ভবত তার মেয়ের।

রিসিপশনিস্টের কাছ থেকে নম্বরটি নিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রাখলাম। আবার ফোন লাগালাম নতুন নম্বরটিতে। সেখানেও এক মহিলা আমার ফোনটি রিসিভ করলেন। তার কাছে হান্যার খোঁজ করলে তিনি জানালেন, হান্যা নিজেও এখন একটি নার্সিং হোমে রয়েছে। 

এতদূর এসে পুরো ব্যাপারটিকেই এখন আমার বোকামি মনে হচ্ছিল। মনে মনে ভাবছিলাম, কেন এই ছোট একটা ব্যাপার নিয়ে আমি এভাবে মেতে আছি?! এমন নয় যে ওয়ালেটটিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে কিংবা অনেক টাকা আছে ওয়ালেটটিতে। মাত্র তিনটা ডলার, আর আছে ৬০ বছর পুরনো একটি চিঠি। হয়তো ওয়ালেটের মালিকের কাছেও চিঠিটি এখন মূল্যহীন। আর আমি যেভাবে ব্যাপারটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করছি তা কি এখন যথেষ্ট হাস্যকর হয়ে উঠে নি?

কিন্তু এত ভাবনার পরেও আমি আবার নার্সিং হোমে ফোন করলাম, যেখানে এখন হান্যা অবস্থান করছে। এবারেও যথারীতি রিসিপশন থেকে ফোন রিসিভ হল। তাকে হান্যার সম্বন্ধে জিজ্ঞাস করলে তিনি জানালেন- "হ্যাঁ, আমাদের এখানে হান্যা অবস্থান করছে।"

ফোন ধরে রেখেই ঘড়ির দিকে তাকালাম। সময় যেন এর মাঝে উড়ে চলে গেছে। রাতের ১০টা বাজতে আর কিছু সময় বাকি। কারও সাথে দেখা করবার জন্যে এটা মোটেই ভালো সময় নয়। তারপরও আমি রিসিপশনে থাকা ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞাস করলাম আমি আজ হান্যার সাথে দেখা করতে পারবো কি না। লোকটি একটু ভেবে বললেন- "যদিও ব্যাপারটির অনুমতি নেই, তারপরও আপনি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। তবে হান্যা যদি এর মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে আর আপনাকে আমি কোন সহায়তা করতে পারবো না।"

অনিশ্চিত সুযোগ পেয়েও আমার বেশ আনন্দ লাগছিল এই ভেবে যে, অবশেষে আমি হান্যাকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছি। আমি খুব দ্রুত নার্সিং হোমটিতে পৌঁছলাম। তখন সময় ১০টা পার হয়ে একটু বেশি। রিসিপশনে পৌছলে রিসিপশনিস্টের সাথে দেখা হল। পরিচয় দিতেই লোকটি আমাকে চিনতে পারলেন, একটু আগে তার সাথেই কথা হয়েছিল আমার। জানালেন হান্যা 'ডে রুমটিতে' এখনো টিভি দেখায় ব্যস্ত। তিনি নিজেই আমাকে হান্যার সাথে দেখা করাতে ডে রুমটিতে নিয়ে গেলেন এবং হান্যার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

রুপালি চুলের মায়াভর্তি চেহারার এক বৃদ্ধা বসে ছিলেন সেখানে। উষ্ণ হাসি উপহার দিয়ে তিনি আমাকে জিজ্ঞাস করলেন এভাবে হন্ত-দন্ত হয়ে এত রাতে কি প্রয়োজনে এসেছি আমি। হান্যাকে আমি একদম শুরু থেকে সব বিস্তারিত বললাম। কিভাবে ওয়ালেটটি পেয়েছি, তারপর ওটা থেকে চিঠিটি পেয়ে কিভাবে হান্যার খোঁজ বের করেছি তার সবই তাকে জানালাম। এরপর পকেট থেকে চিঠিটি বের করে তার হাতে দিলাম। অবিশ্বাসী চোখে কাঁপা-কাঁপা হাতে তিনি চিঠির ভাজ খুললেন। চিঠির কোনায় থাকা ঐ ফুলটি দেখেই তিনি এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর ধীর-কণ্ঠে বললেন- "তুমি কি জানো? এই চিঠিটিই ছিল মাইকেলের সাথে আমার শেষ যোগাযোগ!"

এর বেশ কিছু সময়ের জন্যে আরেকদিকে ফিরে চুপচাপ বসে রইলেন। হঠাত এসে তার ক্ষত-স্মৃতি মনে করিয়ে দেবার জন্যে নিজেকে খুব বড় দোষী মনে হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর হান্যা আমার দিকে ফিরে বললেন- "আমি তাকে প্রচণ্ড ভালবাসতাম। কিন্তু তখন সবে মাত্র আবার বয়স ১৪, আর এসব জানতে পেরে মা খুব চটেছিলেন আমার উপর। বলেছিলেন আমি নাকি এসবের জন্যে তখনও বেশ ছোট। কিন্তু মাইকেল! তার মত হ্যান্ডসাম ছেলে এ জীবনে খুব কমই দেখেছি আমি। অবিকল যেন সেন কনারি ছিল সে!"

তার কথার প্রতিধ্বনি তুলেই যেন বললাম- "সেন কনারি! অভিনেতা?"

'হ্যাঁ', বললেন হান্যা."মাইকেল ছিল চমৎকার ব্যক্তিত্বের একজন। তুমি যদি তার খোঁজ বের করতে পারো তবে তাকে জানাবে, আমি এখনো প্রায়ই তাকে নিয়ে ভাবি। আর..."। বলে থামলেন তিনি; দেখে বোঝাই যাচ্ছিল কথাটা বলতে বলতে তার দারুণ সংকোচ হচ্ছে। ঠোট কামড়ে যেন নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। বললেন- "...আর বলো, তাকে এখনো আমি ভালোবাসি, ঠিক যেমনটি আগে বাসতাম"। বলতে বলতেই চোখ থেকে তার অশ্রুফোটা গাল গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। কিন্তু ঠোটের কোনে হাসির রেখা টেনে বললেন- "আমি কখনো বিয়ের কথা ভাবতে পারি নি, জানো? সম্ভবত মনের গহীনে যে মাইকেল লুকিয়ে ছিল, তার সমকক্ষ আর কাউকে ভাবতে পারিনি বলেই..."

বুঝলাম, হান্যাকে তো বের করতে পারলাম ঠিকই, কিন্তু তার মনের উঠানে উঠিয়ে দিয়ে গেলাম একরাশ বেদনা মিশ্রিত ঝড়ো বাতাস। মাইকেলের খোঁজ আর পাওয়া হল না। এতকিছু করেই বা কি করতে পারলাম তবে? 

হান্যাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম তার কাছ থেকে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলাম নিচে। নার্সিং হোম থেকে বের হবার সময় দারোয়ান আমাকে জিজ্ঞাস করল- "যার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন তার দেখা মিলল তবে?"

হেসে বললাম- "হ্যাঁ, মিলেছে।" এও জানালাম কেন দেখা করতে এসেছিলাম আমি। লাভের মাঝে একটা লাভ বলতে আমি এখন মাইকেলের শেষ নামটুকুও জানি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এর বেশি এগিয়ে যাওয়াটা আমার জন্যে আর সমীচীন হবে না। কথা বলতে বলতে কুড়িয়ে পাওয়া ওয়ালেটটাও পকেট থেকে বের করে এনেছিলাম। 

দারোয়ান যখন আমার হাতের দিকে নজর দিল তখন আমার হাতে ধরা ওয়ালেটটি দেখে বলল- "এই দাড়াও! এটাই কি সেই কুড়িয়ে পাওয়া ওয়ালেট, যার মালিককে তুমি খুঁজছ?" একটু অবাক হলেও বললাম- "হ্যাঁ, এটিই সেই ওয়ালেট।" জবাবে দারোয়ান বলল- "আমি নিশ্চিত করেই জানি এটা মি. গোল্ডস্টাইনের ওয়ালেট! আমি এটাকে যে কোন অবস্থাতেই দেখে চিনতে পারবো। দেখো ঐ যে, এর ভেতর দিকে লাল সুতোর কাজটা, ওটা কেবল মি. গোল্ডস্টাইনের ওয়ালেটেই আমি দেখেছিলাম। আর সেও ক'দিন পরপর এই ওয়ালেটটা এখানে সেখানে হারিয়ে ফেলে। এই তো, এ সপ্তাতেই তো তিনবার করে হারাল ওটা! কিন্তু তার ভাগ্য ভালো বলতে হবে, প্রতিবারই তার হাতেই ফিরে এসেছে ওয়ালেটটি।"

এবারে অবাক হবার পালা আমার। বিস্ময় নিয়েই জিজ্ঞাস করলাম- "কে এই মি. গোল্ডস্টাইন?" 

দারোয়ান বলল- এই নার্সিং হোমেরই আট তলায় থাকেন তিনি। বেশ অনেক বছর ধরেই এখানে তিনি, মোটামুটি এখানে সবাই তাকে চেনে। আজ বিকেলেই তিনি একটু বাইরে বের হয়েছিলেন। এখন বুঝেছি আপনি কিভাবে পেলেন এই ওয়ালেটটি।

আনন্দের অতিসায্যে কোনরকম গার্ডকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি আবার ছুটলাম সিড়িমুখে। লিফটের জন্যে অপেক্ষা করার তর সইছিল না। সিঁড়ি ভেঙ্গে যেন উড়ে উঠলাম আট তলায়। মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলাম যেন আজ একটু দেরিতে ঘুমুতে যায় মি. গোল্ডস্টাইন। আট তলায় এক নার্সের দেখা পাওয়া মাত্রই তাকে জিজ্ঞাস করলাম- "মি. গোল্ডস্টাইনকে কোথায় পাওয়া যাবে?" অবাক হলেও নার্স বলল- "গোল্ডস্টাইন স্যার তো প্রায়ই রাত জেগে লাইব্রেরিতে পড়ালেখা করে সময় কাটান। সম্ভবত এখনো সেখানেই আছেন তিনি।"

এরপর নার্স আমাকে তার সাথে করে লাইব্রেরির দিকে নিয়ে চললেন। এর মাঝেই তাকে আমি সংক্ষিপ্ত করে বললাম কেন আমি মি. গোল্ডস্টাইনের খোঁজ করছি। লাইব্রেরিতে পৌঁছে দেখলাম প্রায় সবগুলো লাইটই বন্ধ, শুধু এক কোনায় একজন ঠোটে হাসি নিয়ে কোলে রাখা একটি বইয়ের ভিতর ডুবে আছেন। সন্দেহ রইলো না, ইনিই মি. গোল্ডস্টাইন। নার্স একটু এগিয়ে গিয়ে মি. গোল্ডস্টাইনের কাছে কোমল স্বরে জানতে চাইলেন- "স্যার, আপনি কি আজও আপনার ওয়ালেটটি হারিয়েছেন?" 

নার্সের প্রশ্ন শুনে মি. গোল্ডস্টাইন তার পেছনের পকেটে হাতড়াতে শুরু করলেন, তারপর লাজুক হেসে বললেন- "ওহ! আবারও হারিয়েছি ওটা!"

"এই ভদ্রলোক একটি ওয়ালেট খুঁজে পেয়েছেন, আর আমাদের মনে হচ্ছে এটিই আপনার ওয়ালেট" -বললেন নার্স।

আমি এগিয়ে গিয়ে মি. গোল্ডস্টাইনের হাতে ওয়ালেটটি দিলাম। ওয়ালেটটি হাতে পেয়েই তৃপ্তির হাসি চলে আসল তার ঠোটে। বললেন- "হ্যাঁ, এটিই সেই ওয়ালেট! সম্ভবত আজ বিকেলে যখন বাইরে বের হয়েছিলাম তখন এটি কোনভাবে আমার পকেট গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল।" তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- "ইয়ং ম্যান, এর জন্যে তুমি পুরস্কার পাবে!"

"না স্যার, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ" দ্রুত বললাম তাকে। "কিন্তু, আপনাকে খুঁজে বের করতে গিয়ে আপনার ওয়ালেটটির ভিতরে আমাকে দেখতে হয়েছে। আর সেখানে থাকা আপনার চিঠিটিও পড়তে হয়েছিল আমাকে।"

একথা শুনে তার মুখের হাসি হুট করেই গায়েব হয়ে গেলো, সেখানে ভর করল বিষাদ। বিড়বিড় করে জিজ্ঞাস করলেন- "তুমি পড়েছ ঐ চিঠিটা!"

"শুধু তাই না", দুষ্ট একটা হাসি এনে বললাম "আমি এও জানি এখন হান্যা কোথায় আছে।"

হঠাৎই যেন তিনি ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন। "হান্যা! তুমি জানো সে কোথায় আছে? কেমন আছে সে? সে কি এখনো আগের মত সেই অনিন্দ্য সুন্দরী রয়েছে? প্লিজ, প্লিজ বল আমাকে...", মরিয়া হয়ে জানতে চাইলেন তিনি। 

"সে ভালো আছে.... ঠিক যেমনটি আপনি কল্পনা করছেন, ঠিক তেমনি সুন্দর আছে সে", মৃদু স্বরে বললাম তাকে।

প্রত্যাশা পূর্ণের হাসি মুখে মি. গোল্ডস্টাইন জানতে চাইলেন- "তুমি কি আমায় বলতে পারবে সে কোথায় আছে? আমি তার সাথে একটাবারের জন্যে একটু কথা বলতে চাই"। বলতে বলতেই তিনি হুট করে আমার হাতটি চেপে ধরলেন, বললেন- "তুমি কি জানো? তাকে আমি প্রচণ্ড পরিমাণে ভালবাসতাম, কিন্তু তার এই চিঠিটা যখন হাতে এসে পৌছায় তখন মনে হল আমার জীবনটাই শেষ হয়ে গেছে। আমি আর কাউকে তার মত করে গ্রহণ করতে পারি নি, হয়তো তার প্রতি আমার ভালোবাসাটাই কখনো কাউকে আর আপন করে ভাবতে দেয়নি আমায়।"

"মি. গোল্ডস্টাইন," বললাম আমি, "আপনি কি আমার সাথে একটু আসতে পারবেন?"

আমরা লিফটে চড়ে উঠলাম, লিফট আট তলা থেকে তিন তলাতে নেমে আসল। হলওয়ের প্রায় পুরোটাই তখন অন্ধকার, হালকা আলোর কয়েকটি লাইট তখন জ্বলছে সেখানে। হান্যাকে আমরা পেলাম সেই ডে রুমটিতেই। অসাড় ভঙ্গিতে তিনি তখনও টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। 

আমাদের সাথে থাকা নার্স তখন হান্যার দিকে এগিয়ে গেলো, মৃদু স্বরে বলল- "হান্যা", তারপর দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকা মাইকেলের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বলল, "তুমি কি ঐ লোকটিকে চিনতে পারছ?"

হান্যা তার গলায় ঝুলে থাকা গ্লাসটি একটু পরিষ্কার করে চোখে পড়ল, তারপর একমুহুর্ত সময় নিয়ে তাকাল মাইকেলের দিকে, কিন্তু একটি কথাও বলল না। একটু সময় পর একদম শোনা যায় না এমন ক্ষীণস্বরে মাইকেল বলল, "হান্যা, আমি মাইকেল, আমার কথা কি তোমার মনে আছে?"

হান্যা ফুঁপিয়ে উঠল, "মাইকেল! আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না! মাইকেল! এটা কি সত্যিই তুমি? সত্যিই কি তুমি আমার মাইকেল?"। এভাবেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে উঠে এগিয়ে যেতে থাকল সামনের দিকে। এত যুগ পরেও যেন একজন আরেকজনকে চোখের সামনে পেয়েও বিশ্বাস করতে পারছিলো না। নার্স আর আমি তাদের ওভাবে রেখেই ডে রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। বলতে লজ্জা নেই, আমাদের উভয়ের চোখই তখন ভিজে ছিল এক অপার্থিব আনন্দে। হলওয়েতে এসে নার্স আস্তে করে বলল, "দেখলে! কিভাবে সৃষ্টিকর্তার আশ্চর্য বলয় আমাদের জড়িয়ে রাখে? যদি কিছু একটা তোমার হবার থাকে, তবে তা হবেই; হাজার প্রতীক্ষার পর হলেও তোমার পাওনা তোমায় সে মিটিয়েই দেবে!"


এরপর প্রায় তিন হপ্তা বাদে এক ব্যস্ত দুপুরে অফিসে আমার জন্যে একটি কল আসল ঐ নার্সিং হোম থেকে। সেদিনের সেই রিসিপসনিষ্ট আমাকে বলল- "তুমি কি সামনের রবিবার একটু সময় করে আমাদের এখানে আসতে পারবে? ঐ দিন মাইকেল আর হান্যা তাদের ঐ দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটাতে যাচ্ছে!" এমন প্রস্তাবের বিপরীতে না বলার কোন ইচ্ছেই আমার ছিল না, সময় নষ্ট না করে সাথে সাথে নিমন্ত্রণটি গ্রহণ করে নিলাম।


আমার জীবনে যে অল্প ক'টা চমৎকার দিনের কথা আমি বলতে পারব, তার মধ্যে ঐ রবিবারটি ছিল অন্যতম। নার্সিং হোমটিতে পৌঁছে আমার মনেই হয়নি আমি কোন নার্সিং হোমে এসেছি। তখন সেখানে সবদিকেই একটা উৎসব উৎসব আমেজ। হলঘর জুড়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কিন্তু যে কেউ তাদের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবে কতটা আনন্দ নিয়ে তারা এই সময়টাকে উপভোগ করছেন।

হান্যা হালকা কিন্তু উজ্জ্বল রঙ এর একটি বিয়ের ড্রেস পড়েছিল সেদিন, আর আমি বাজি ধরে বলতে পারি এরচেয়ে সুন্দর তাকে কখনোই লাগেনি। মাইকেল পড়েছিল একটি গাড় নীল সুট আর লম্বা একটি হ্যাট, তাকে দেখতে সত্যিই সেদিন দারুন হ্যান্ডসাম লাগছিল। তারা তাদের বিয়েতে আমাকে তাদের 'বেস্ট ম্যান' বানিয়েছিলেন।

নার্সিং হোম থেকে শুধুমাত্র তাদের জন্যে একটি আলাদা রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেদিন আমি দেখেছিলাম ৭৬ বছরের এক কণে আর ৭৯ বছরের এক বরকে টিনেজারদের মত উচ্ছ্বাসে মেতে উঠতে। 

বয়সটা আসলেই তাদের জন্যে কোন বিষয় ছিল না সব শেষে!






………………………………………………………
গল্পঃ হারানো ওয়ালেট
লেখকঃ অজ্ঞাত
সোর্সঃ "Stories of life" via pinterest.com


মঙ্গলবার, জুলাই ২৫, ২০১৭

অনুবাদ গল্পঃ বিস্ময়কর সাত



ছোট্ট এক গ্রামের ৯ বছর বয়সী এক মেয়ে 'অ্যানা'। গ্রামের এক স্কুল থেকেই সে ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেছে। এরপর আরও উন্নত শিক্ষার জন্যে শহুরে ভালো স্কুল গুলির ৫ম শ্রেণীতে ভর্তি হবার আবেদন করল, আর তার ভালো ফলাফল এবং মেধার ভিত্তিতে শহরের এক নামকরা স্কুলে সে ভর্তি হবার সুযোগও পেয়ে গেলো। নতুন স্কুলে আজ তার প্রথম ক্লাস, সে রাস্তার ধারে স্কুল বাসের জন্যে অপেক্ষা করছিল। স্কুল বাস পৌঁছোবার সাথে সাথেই সে খুব দ্রুত তাতে উঠে পড়ল। আজকের দিনের তার উচ্ছ্বাসটি ছিল দেখবার মত!

বাসটি স্কুল চত্বরে পৌঁছোবার সাথে সাথেই ছাত্র-ছাত্রীরা যার যার ক্লাসের উদ্দেশ্যে ছুট লাগাল। বাকি সকলের মত অ্যানাও কয়েকজনকে জিজ্ঞাস করে তার ক্লাস রুমের অবস্থান জেনে ক্লাসের দিকে চলে গেলো। ক্লাসে পৌঁছোবার পর তার সাদাসিধা গ্রাম্য পোশাক আর ভেষভুষা দেখে ক্লাসের শহুরে ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে নিয়ে উপহাস করা শুরু করল, তাদের সেই উপহাসের মাত্রা আরও বেড়ে গেল যখন তারা জানতে পারল অ্যানা সত্যি সত্যি গ্রাম থেকেই এখানে ক্লাস করতে এসেছে। ক্লাসের সময় হবার সাথে সাথেই ক্লাসে শিক্ষিকা চলে আসলেন এবং সবাইকে শান্ত হয়ে নিজ নিজ ডেস্কে বসতে বললেন। এরপর তিনি অ্যানাকে ডেকে এনে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, বললেন আজ থেকে অ্যানাও আমাদের সাথে নিয়মিত ক্লাস করবে। 

পরিচয়পর্ব শেষে শিক্ষিকা তার ছাত্র-ছাত্রীদের বললেন, এখন তোমরা দ্রুত তোমাদের ক্লাস টেস্টের জন্যে প্রস্তুত হয়ে নাও! তিনি সবাইকে পৃথিবীর সেটা ৭টি আশ্চর্যের কথা লিখতে বললেন। প্রশ্ন শুনে সকলেই খুব দ্রুত নিজ নিজ খাতায় ৭টি আশ্চর্যের নাম লিখতে শুরু করল। অ্যানা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে শেষে সেও নিজের খাতাটি বের করে ধীরে ধীরে প্রশ্নের উত্তর লিখতে শুরু করল।

যখন অ্যানা বাদে প্রায় সবাই নিজ নিজ উত্তর শিক্ষিকাকে দেখানোর জন্যে জমা দিল তখনও অ্যানা নিজের খাতায় মুখ গুজে লিখতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই দেখে শিক্ষিকা এগিয়ে গিয়ে অ্যানাকে জিজ্ঞাস করলেন- "কি ব্যাপার অ্যানা, তুমি কি প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে গেছো? ঘাবড়াবার কিছু নেই, এই অল্প ক'দিন আগেই আমরা পৃথিবীর আশ্চর্য গুলি শিখেছি। তোমার কি এই প্রশ্নটির উত্তর জানা নেই?"

উত্তরে অ্যানা বলল- " আসলে ম্যাম, আমি ভাবছিলাম পৃথিবীতে তো অসংখ্য আশ্চর্য ছড়িয়ে আছে, লিখার জন্যে আমি আসলে কোন ৭টি আশ্চর্যকে বেছে নেব তা নিয়েই ভাবছিলাম" এবং তারপর অ্যানা তার খাতাটি শিক্ষিকার দিকে বাড়িয়ে দিল।  

শিক্ষিকা অ্যানার খাতাটি নিয়ে তার ডেস্কে চলে গেলেন, এরপর একে একে সবার খাতা দেখতে শুরু করলেন। ক্লাসের প্রায় সবাই পৃথিবীর ৭টি আশ্চর্য হিসেবে চীনের মহাপ্রাচীর, চিচেন ইতজা, স্ট্যাচু অব ক্রাইট দ্য রিডিমার, মাচুপিছু, পেত্রা নগরী, রোমের কল'সীয়াম, তাজমহল সহ আরও নানা স্থানের নাম লিখেছিল। শিক্ষিকা খুবই খুশি হলেন, কারণ তার শিক্ষার্থীরা প্রায় সকলেই সঠিক উত্তরটি লিখতে পেরেছে। সবশেষে শিক্ষিকা অ্যানার উত্তরটি পড়তে শুরু করলেন।

অ্যানা তার খাতায় ৭টি আশ্চর্য হিসেবে লিখেছে- "দেখতে পারা, শুনতে পারা, অনুভব করতে পারা, হাসতে পারা, ভাবতে পারা, দয়া দেখাতে পরা, ভালবাসতে পারা!"

অ্যানার উত্তরটি পড়ে শিক্ষিকা একদম স্থিরভাবে খাতা হাতে দাড়িয়ে রইলেন, আর ক্লাস একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলো। এরপর শিক্ষিকা শান্তকণ্ঠে বললেন- আজকে, গ্রামের একটি ছোট্ট মেয়ে আমাদের মনে করিয়ে দিল ঐ সব মহামূল্যবান উপহারের কথা যা না চাইতেও আমরা ঈশ্বর থেকে পেয়েছি; যার প্রতিটিই এক একটি সত্যিকারের আশ্চর্য! আশা করি তোমরাও তোমাদের এই মূল্যবান উপহার গুলির যথাযথ মূল্যায়ন করতে শিখবে আমাদের ছোট্ট বন্ধু অ্যানার মত করে।

এরপর গ্রামের ঐ পিছিয়ে পড়া মেয়েটিই হয়ে উঠল তাদের আরেক আদর্শ। 






⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎  নীতিনিষ্ঠ মূল্যায়ন  ⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎⚌⚍⚌⚎

আমাদের সকলেরই উচিৎ ঐ সব জিনিষ গুলোর মূল্যায়ন করা, যা আমাদের আছে, যা আমরা ব্যবহার করতে পারি, যার উপর আমরা আস্থা রাখতে পারি। অনুপ্রেরণার জন্যে সবসময় নতুন কিছুর খোঁজ করার প্রয়োজন নেই। বরং ঈশ্বর আমাদের ঐ সবই দিয়ে পাঠিয়েছেন, যা আমাদের একান্ত প্রয়োজন।










……………………………………………

মূল লেখকঃ অজ্ঞাত
সোর্সঃ "Moral Stories" via pinterest.com


রবিবার, জুন ২৫, ২০১৭

ওমিক্রনের কথাঃ হস্তাক্ষর (শর্ট ফিকশন)



বেশ অনেক সময় ধরে চেষ্টা করছি মানুষের মত লিখার জন্যে, কিন্তু হচ্ছে না। মানুষের এই ব্যাপারটি একদম অন্যরকম, ঠিক যেমন তাদের স্বভাবের মত। এক একজন মানুষের স্বভাব যেমন এক এক রকম হতো, ঠিক তাদের হাতের লেখা গুলিও এক এক রকমের। যদিও অনেকের সাথে অনেকের স্বভাব আর হাতের লেখার মিল পাওয়া যেতো, তবুও সূক্ষ্ম একটা পার্থক্য কোথাও না কোথাও ঠিকই থেকে যেতো। যদিও কখনো ক্রিয়েটিভ হিসেবে ব্যাপারটাকে গ্রহণ করা হয়নি, তবুও আমার যুক্তি অনুযায়ী এটা তাদের ক্রিয়েটিভিটির একটা অংশ হিসেবেই ছিল।

এই যেমন আমি চেষ্টা করছি আমার নিজের, একদম আমার নিজের মত করে লিখার জন্যে। কিন্তু এতটা সময় নষ্ট করার পরও আমি তা পারছি না। অবশ্য এর পেছনে অনেক অনেক যুক্তি দেখানো যেতে পারে। এই যেমন তারা লিখার জন্যে কলম বা পেনসিল জাতীয় কিছু একটা ব্যবহার করত। কিন্তু আমি তেমন কিছু করতে পারছি না। আমাকে আমার প্রিন্টিং ডিভাইসের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। আমার প্রিন্টিং ডিভাইসটিকে নানা রকম সিগন্যাল পাঠিয়ে তারপর আমার লেখাটি প্রিন্ট করছি। কিন্তু যতবারই প্রিন্ট করছি, ততবারই কোন না কোন ফন্ট স্টাইলের সাথে ওটা ম্যাচ হয়ে প্রিন্ট হচ্ছে। 

এতবার চেষ্টার পর মানুষ হয়তো ক্লান্তি অনুভব করত। কিন্তু ওমিক্রন হবার সুবিধা হচ্ছে এইসব অনুভব আর অনুভূতি থেকে আমরা মুক্ত। কপোট্রন অবশ্য বেশ অনেক পরিমাণে এনার্জি ব্যবহার করছে সেই শুরু থেকে। আধুনিক কপোট্রন বলেই হয়তো এত সময় কাজ করার পরও সেটাতে কোন সিগন্যাল জ্যাম হয়ে যাচ্ছে না বা রিবুট নিতে চাচ্ছে না। কিন্তু আমি ধারণা করতে পারি, আমার স্থানে কোন ৫ম প্রজাতির ওমিক্রন হলে সেটি এরই মাঝে কয়েকবার রিবুট করতে চাইতো। 

আমার আজকের এই আজব কাজটি করার পেছনে কারণ হিসেবে বলতে গেলে বলতে হবে একটা ভিডিও ক্লিপের কথা। ভিডিও ক্লিপটি অনেক অনেক পুরনো একটি আর্কাইভ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। সময়কাল হিসেব করলে ওটা বিংশ শতাব্দীর কোন একটা সময়ের হবে। সেখানে মানব প্রজাতির এক মা তার ছেলেকে হাতের লিখা শেখাচ্ছে। আর ছেলেটি লিখতে লিখতে ধীরে ধীরে তার মত করে লিখতে শিখে যাচ্ছিল। আর সেখানে মা'য়ের লেখাটার সাথে ছেলের লেখাটার বেশ কিছু মিল আর অমিলও থেকে যাচ্ছিল।

মানুষের লেখা গুলি যেন শুধুমাত্র তার লেখা নয়, বরং তার থেকেও বেশি কিছু। যেন তার ব্যক্তিত্বের প্রকাশ থাকে তাদের ঐ হাতের লেখাতে। তাদের রুচি আর সংস্কৃতি যেন উঠে আসে ঐসব আঁকা-বাঁকা চিহ্ন গুলিতে। তাদের মনের ভাবনা গুলি শুধুমাত্র তাদের শব্দের বুননে নয়, বরং ঐসব আঁকিবুঁকিতেও উঠে আসত। আর এই ব্যাপারটা আমাকে বেশ আকৃষ্ট করেছে। এরপর আমি আর্কাইভ থেকে মানুষের লেখা এই ব্যাপার নিয়ে আরও বেশ কয়েকটি ফুটেজ দেখেছি। যদিও ফুটেজ গুলোর বিষয়বস্তু ভিন্ন ভিন্ন ছিল। কিন্তু প্রতিটি ফুটেজেই এই ব্যাপার গুলিই আমার কাছে একটা আলাদা বিষয় মনে হয়েছে।

এর পর থেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছি আমার মত করে লিখার জন্যে, যা একদম আলাদা হবে। একদম ভিন্ন কিছু, ঠিক মানুষের লিখার মত। কিন্তু যতবারই আমি আমার ইমেজিং প্রসেসরে কিছু একটা লেখা রেন্ডার করতে চাইছি ততবারই কোন না কোন টেক্সট স্যাম্পলের ব্যবহার হয়ে সেটা রেন্ডার হচ্ছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষে এসেও এই জায়গাটাতে ওমিক্রনেরা যে কতটা অপারগ সেটাই যেন প্রমাণ করছে ছোট্ট এই ব্যাপারটি। আমার এই লিখতে না পারাটাই যেন আমার অক্ষমতা। হাজার হাজার ইউনিট এনার্জি নষ্ট করেও আমার বিফলতা যেন আমাকেই বিদ্রূপ করছে। 

কপোট্রনের সিগন্যালের একটা চাপ খুব ভালোই বুঝতে পারছি। আগেও বলেছি, অনুভূতি বা অনুভব ব্যাপারটি থেকে আমরা মুক্ত। কিংবা আমাদের এই অগ্রগামী প্রযুক্তিও অক্ষম আমাদের মত ওমিক্রনকে এইসব অনুভূতি কিংবা অনুভব দেবার ব্যাপারে। যদি আমার ডেটা বিশ্লেষণ ভুল না হয়ে থাকে তবে কপোট্রনের সিগন্যালের ঐ অতিরিক্ত চাপটুকুকে মানুষের অনুভূতির সাথে তুলনা করলে তা তাদের অক্ষমতার আর নিজের সাথে যুদ্ধে হেরে যাবার অনুভূতির কাছাকাছিই কিছু একটা হবে। তবে চেষ্টা করা ছেড়ে দিচ্ছি না। কিছু একটা আছে এর মধ্যে, যেন আমাকে বলছে এক সময় না এক সময় আমি ঠিকই মানুষের মত করে লিখতে পারবো, একদম আলাদা রকম একটা লেখা, একদমই আমার নিজের একটা লেখা!





শনিবার, জুন ০৩, ২০১৭

মুখোশ



মাঝে মাঝে হারিয়ে যাবার প্রচণ্ড তৃষ্ণা পায় আমার। হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে পরিচিত এই ভুবন ছেড়ে। কিন্তু এটা নিছকই এক ছেলেমানুষি ইচ্ছা। যেখানে ভুবন বলতে আমার জানা শোনা রয়েছেই কেবল এই একটাই, সেখানে আর কোথায় গিয়ে হারাবো?

কিন্তু তবুও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। সমাজবদ্ধ হয়ে ভদ্র মুখোশের ভিড়ে আমি যেন দিনকে দিন কেবল হাঁপিয়ে উঠছি। দৈনন্দিন জীবনে এখানে কারও বেঁচে থাকার ছোঁয়া দেখি না আর আমি। আমি শুধু দেখি একদল মানুষ কেবলই একটা ঘোরে পড়ে ছুটছে। মানুষের চামড়ার আড়ালে এরা যেন এক একটা চলমান যন্ত্র-মানব। যেন কলকব্জা গুলোর উপরে স্তর স্তরে চামড়া জুড়ে দিয়ে মানুষের রূপে নিজেকে টিকিয়ে রাখছে। এদের ছুটোছুটি দেখলে মনে হয় নিশ্বাসটাও যেন এরা নিজের জন্যে নেয় না। কেবল পচে গলে পিছু পড়ে যাবে বলেই ভয়ে ভয়ে নিশ্বাস টেনে চলেছে নিয়ম করে।

এদের খাবার আছে, সেই খাবারও নিয়ম করে গ্রোগ্রাসে গিলছে, কিন্তু এদের খিদে নেই। খাবারের স্বাদ এদের জিহ্বাকে স্পর্শ করে না। এদের মনে স্বাদকে উপভোগের সখ জাগে না, আহ্লাদ করে এরা দু'টুকরো রুটিও চিবায় না। এরা কেবল নিয়ম করে তিন বেলা খাবার গিলতে পারে। কেবল পরে সকাল, সন্ধ্যা আর রাতে মেকি আয়োজনে নিজের ভাগের খাবার সাবাড় করতে। আর পারে খাওয়া শেষে ফের নিজেকে ঘোরে টেনে নিয়ে ছুটতে। 

তবে এদের জন্যে আমার আফসোস হয় না, দুঃখও হয় না। কেবল নিজের মনে বিষাদ জাগে। জীবনকে এরা কখনোই জীবনের মত করে দেখতে পারে না বলেই এই বিষাদ জাগে। সুশৃঙ্খল হতে গিয়ে এরা বিশৃঙ্খলার আনন্দ নিতে ভুলে গেছে বলে বিষাদ জাগে। ছন্দে চলার লোভে পড়ে ছন্দ পতনের বিরক্তি বোঝার ক্ষমতা হারিয়েছে বলে আমার বিষাদ জাগে। আমার বিষাদ লাগে, কারণ এরা উড়তে চায়, কিন্তু বাসাতকে স্পর্শ করতে চায় না বলে। বিষাদ লাগে, কারণ এরা সাতরে যায়, কিন্তু নিজেকে পানিতে ছোঁয়ায় না বলে। প্রকৃতির মাঝে কৃত্রিমতা যেন এদের গ্রাস করে নিয়েছে।

কোন একদিন হুট করে যদি এদের মোহের অবসান ঘটে, তবে আমি নিশ্চিত এরা নিজ নিজ বিছানা ছাড়বার আগেই আত্মহত্যার পথ খুঁজবে। মায়ামরা এই প্রকৃতি দেখে নিজেরাই ডুকরে কাঁদবে। সু-শৃঙ্খল জীবনে বাঁচতে গিয়ে এরা যে শৃঙ্খলে বন্দী দাশ ছিল তা অনুধাবন করে এরা নিজেদের আফসোসের আগুনে পুড়িয়ে মারবে। 

এরা কখনো সূর্যোদয় দেখে না, এরা শুধু দিনের শুরু হতে দেখে। এরা কখনো সূর্যাস্তের কোমলতাও অনুভব করে না, এরা কেবলই দিনের সমাপ্তি দেখে। এরা সন্ধ্যার মায়ায় নিজেকে নিমজ্জিত করতে জানে না, রাতের নিস্তব্ধতার ছন্দ শুনতে পারে না। এরা জাগে না, এরা ঘুমায় না। এরা কেবলই ছোটে, শুধু ছুটেই চলে।

আর এসব দেখেই আমার হারিয়ে যাবার তৃষ্ণা বাড়ে। বাড়তে বাড়তে একদম অতিষ্ঠ করে তোলে। ছটফট করে, চিৎকার করে, ভাংচুর করে সেই তৃষ্ণা মেটাতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে ইকারাসের মত ডানা ছড়িয়ে দিগন্তের এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়াতে।

কিন্তু এসবের কিছুই আমার করা হয় না। আফসোসকে আবারও চেপে রেখে আমি সামনে এগিয়ে যাই। চুপিসারে আমিও আমার মিথ্যে মুখোশটা পড়ে নেই। সেই মুখোশের চোখ দিয়ে আমিও এক অদৃশ্য মোহের দেখা পাই। এটাই সেই মোহ, যা সবাইকে এই একঘেয়ে যান্ত্রিক গতিতে চালিয়ে নিচ্ছে। আর এভাবেই আমার আর হারিয়ে যাবার তৃষ্ণাটা মেটানো হয় না। অতৃপ্ত তৃষ্ণাকে মিথ্যে মুখোশে মুড়িয়ে আমিও বাকি সবার মত ছুটে চলি। ছুটে চলি এক মিথ্যে আশ্বাসের গন্তব্যে...